কাজী রফিক
১৯ আগস্ট ২০২৪, ০৯:০৯ পিএম
চঞ্চল তরুণ মো. সাগর হোসেন। পড়াশোনার পাশাপাশি পরিবারের হালও ধরেছিলেন। পরিবারকে একটি ভালো অবস্থানে দাঁড় করাতে চেষ্টার কমতি ছিল না তার৷ তবে সব যেন থমকে গেছে। গত ১৯ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে গুলি লাগে এই তরুণের। এক মাস ধরে রয়েছেন হাসপাতালের বিছানায়৷ থাকতে হতে পারে আরও কয়েক মাস। আর সুস্থ হতে সময় লাগবে অন্তত তিন বছর।
২৪ বছর বয়সে পরিবারের হাল ধরা ছেলেটি এখন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে চোখের জল ফেলছেন। আর ক্ষণেক্ষণে বলে উঠছেন, আবার বোনদের কী হবে? আমার পরিবারের কী হবে?
পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাগর রাজধানীর মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজের হিসাব বিজ্ঞান অনুষদের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আর দুটি বছর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোনোর কথা তার। তবে কলেজ জীবন থেকেই অভাবের সংসারের হাল ধরেন সাগর।
সাগরের বাবা ড্রাইভার হিসেবে চাকরি করেন। একার আয়ে পাঁচ সদস্যের পরিবারের পড়াশোনার খরচ চালানো বেশ কঠিন। ফলে কলেজে পড়া অবস্থাতেই খাবার সরবরাহকারীর কাজ নেন সাগর। নিজের খরচ চালানোর পাশাপাশি সংসার খরচেও তার উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল।
সাগরের মা ফাতেমা বেগম ছেলের কথা জানাতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন৷ বলেন, 'আমার একটাই ছেলে। যেদিন দেখছি রংপুরে আবু সাঈদ মারা গেছে, ওইদিন আমার ছেলেরেও আমি আর আন্দোলনে যাইতে বাধা দেই না। আমার ছেলেটা অনেক কষ্ট কইরা পড়াশোনা করে। নিজের খরচ নিজে চালাইতো, সংসারে টাকা দিতো। সারাদিন ওর দুইটা ছোট বোন আর আমাদের কথা ভাবতো। আমগো তো কোনো কোটা নাই। কোটার জন্য যদি আমার পোলার চাকরিডা না হয়, তাইলে ওর কষ্টডা ফাও যাইবো না? ও আন্দোলনে যাইতে চাইছে, আমরা যাইতে দিছি।'
'কিন্তু আমার পোলাডারে গুল্লি কইরা দিলো'- বলেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন ফাতেমা বেগম।
আরও পড়ুন
শরীরে ২১২ গুলি, চোখ হারাতে বসেছেন হাবিব
চোখ হারাতে বসেছেন গুলিবিদ্ধ রাব্বি, অর্থাভাবে বন্ধের পথে চিকিৎসা
নিজেকে সামলে নিতে বেশ খানিকটা সময় নেন। জানান সাগরের বর্তমান অবস্থা। সাগরের পেটের পাশের অংশ গুলি লাগে। যা পেছনের হাড় ভেঙে বের হয়ে যায়৷
ফাতেমা বেগম বলেন, 'গুল্লি লাগার পর ওর বন্ধুরাই হাসপাতালে নিয়া আইছে। আমার দেড় লাখ টাকার মতো খরচ হইছে৷ এরমধ্যে এক লাখ টাকার বেশি আমি ধার করছি। গত ছয় দিন ধইরা ফ্রি চিকিৎসা হইতাছে।'
চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, 'ডাক্তার বলছে, আগামী সপ্তাহে একটা অপারেশন করবে৷ তিন মাস পর আরও একটা অপারেশন। আগেও তিনটা অপারেশন হইছে।'
সাগরের বন্ধু আবু রাইয়ান ঢাকা মেইলকে বলেন, 'ওর ঠিক হইতে প্রায় তিন বছরের মতো লাগবে। যেহেতু হাড় ভাঙছে, ও চাইলেও আর তেমন ভারী কাজ করতে পারবে না। এখন না হয় হাসপাতালে ফ্রি চিকিৎসা হচ্ছে, একটা পর্যায়ে তো হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেবে। তখন তো অবশ্যই ওষুধ লাগবে, অন্যান্য জিনিস লাগবে। সেগুলো ম্যাসেজ করার মতো অবস্থায় ওর পরিবার নাই। এমনিতেই আগেই এক লাখ টাকার বেশি ধার করা হয়েছে।'
আবু রাইয়ান বলেন, 'ও এখন বিছানায় শুয়ে শুয়ে পরিবারের চিন্তা করে। সেটাই হয়ত স্বাভাবিক। ও পরিবারের বড় ছেলে৷ ছোট দুইটা বোন, দুইজনই স্টুডেন্ট।'
সাগরকে দেখতে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান এই প্রতিবেদক। অস্ত্রোপচারের পর রোগীকে যে পর্যবেক্ষণ কক্ষে রাখা হয়, সে কক্ষে শুয়ে আছেন সাগর। পাশে দাঁড়িয়ে তার ছোট বোন।
সাগরের কাছে তার বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এখন কিছুটা ভালো আছি৷ হয়ত ভালো হয়ে যাবো৷ একটু টাইম লাগবে৷ কিন্তু আমার পড়াশোনাটা আটকে যাবে, আমার পরিবারের কী হবে? আমার পরিবারের জন্যই আমার চিন্তা হচ্ছে।'
ছেলের এই অবস্থায় পরিবারের দায়িত্ব এবার নিজের কাঁধেও নিতে চান সাগরের মা ফাতেমা বেগম। বলেন, 'আমার ছেলেটা সব সময় বলতো- ১০ বছরেও বিয়া করুম না। দুই বোনকে পড়াশোনা করাবো। ওদের বিয়ে দিবো। তারপর নিজের চিন্তা করব। এখন আমার ছেলেটাই বিছনায়৷ আমি এখন পর্যন্ত কোনো কাজ করি নাই। এখন হয়ত আমারও কাজ করা লাগবে। ছেলে তো এখন আর চাকরি করতে পারবে না। ব্যবসা করবো, সেই টাকাও আমাদের নাই। আমাগো বাড়িতে জমাজমি তো নাই, থাকার ঘরও নাই।'
কারই/জেবি