সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের গড়ে ওঠা আন্দোলনে সারাদেশে ঝরেছে শত শত প্রাণ। সবচেয়ে বেশি মারা গেছে রাজধানী ঢাকায়। এই আন্দোলনে মৃতের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে রয়েছে নানা বক্তব্য। বিভিন্ন সূত্রে যে সংখ্যা গণমাধ্যমে এসেছে প্রকৃত বিচারে মৃতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। স্বৈরাচারী সরকার আন্দোলন দমাতে যেমন বেপরোয়া ছিল তেমনি লাশ গোপন করতেও তাদের চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না বলে অভিযোগ আন্দোলনকারীদের।
জনসম্মুখে আসা সংখ্যার বাইরে যে মৃতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি সেটা কিছুটা অনুমান করা যায় আন্দোলনের কয়েক দিন বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা লাশের সংখ্যা থেকে। কেবল রাজধানীর রায়েরবাজার গোরস্থানেই জুলাই মাসের শেষ ১০ দিনে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে ৪৬ জনকে।
বিজ্ঞাপন
দেশের সবচেয়ে বড় এই গোরস্থানের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা মাওলানা ফেরদৌস ঢাকা মেইলকে জানিয়েছেন, গত ২২ জুলাই একদিনে ১১ জনকে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে৷ ২৩ জুলাই ১ জন, ২৪ জুলাই ৯ জন, ২৫ জুলাই ৩ জনকে দাফন করা হয়।
২৬ জুলাই কোনো বেওয়ারিশ লাশ দাফন হয়নি। ২৭ জুলাই ৭ জন, ২৮ জুলাই ১১ জন, ২৯ জুলাই ১ জন এবং ৩১ জুলাই ৩ জনকে বেওয়ারিশ বলে গোরস্থানটিতে দাফন করা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
এই কর্মকর্তার ভাষ্য, আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম থেকে এই লাশ পাঠানো হয়৷ লাশের বিস্তারিত তথ্য গোরস্থান কর্তৃপক্ষের কাছে নেই।
প্রশ্ন উঠেছে, জুলাইয়ের শেষ ১০ দিনের এই বেওয়ারিশ কবরে কারা শুয়ে আছেন? এই সময়ে ৪৬টি লাশ অজ্ঞাত পরিচয়ে আসাটা স্বাভাবিক কি-না?
গোরস্থান কর্তৃপক্ষের রেজিস্ট্রার খাতা বলছে, ১৮ থেকে ২১ জুলাই রায়ের বাজার গোরস্থানে একটি বেওয়ারিশ লাশও দাফন হয়নি। আবার আগস্টের ১৮ দিনে বেওয়ারিশ লাশ এসেছে মাত্র দুটি।
গোরখোদকদের দাবি, ১৯ জুলাই থেকে রাজধানীর রায়েরবাজার গোরস্থানে অজ্ঞাত পরিচয়ের লাশের সংখ্যা হঠাৎ করেই বেড়ে যায়৷ যদিও গোরস্থানের রেজিস্ট্রার খাতায় ১৯ জুলাই কোনো বেওয়ারিশ লাশ দাফন হয়নি।
সরেজমিনে দেখা যায়, গোরস্থানটির ৪নং ব্লকে প্রায় দেড়শ কবর৷ যার কোনোটির সামনেই মৃত ব্যক্তির নামফলক নেই।
৪নং ব্লকের কবরগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে একজন গোরখোদকের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, 'এইগুলা বেওয়ারিশ লাশ। আঞ্জুমান (আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম) থেকে পাঠায়। আমরা দাফন করি। কিছু নতুন আছে, কিছু পুরনো আছে।'
অপর একজন গোরখোদক বলেন, 'সেই শুক্রবার (১৯ জুলাই) রাইত থেকে বেওয়ারিশ লাশ বেশি৷ শনিবার (২০ জুলাই) একদিনেই দাফন দিছি ১৪টা। শুক্রবার থেকে বুধবার পর্যন্তই (১৯ থেকে ২৪ জুলাই) ৩৬টা দাফন দিছি।'
অর্থাৎ রেজিস্ট্রার খাতার সঙ্গে গোরখোদকদের তথ্যের বিশাল ফারাক রয়েছে। এ বিষয়ে মাওলানা ফেরদৌসের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমাদের গেট থাকে আটকা। লাশ যা আইছে আঞ্জুমান থেকে আইছে। হিসাব ঠিক আছে।'
রায়েরবাজার গোরস্থানটির মসজিদের ইমাম জহিরুল ইসলামের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম থেকে লাশ পাঠায়৷ তারা গোসল করিয়েই পাঠায়। আমরা এখানে শুধু জানাজা দিয়ে দাফন করি। মুখও খোলা হয় না।'
বিভিন্ন গোরস্থানে পাঠানো বেওয়ারিশ লাশগুলো স্বাভাবিক সময়ের মতোই কি না, নাকি এরমধ্যে কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত কারও লাশও আছে? এমন প্রশ্নের জবাবে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের বেওয়ারিশ লাশ দাফন কর্মকর্তা মো. কামরুল ইসলাম বলেন, 'এ বিষয়ে আমরা এখনো পর্যালোচনা করিনি। এটা আমাদের রুটিন কাজ৷ আমরা সব সময় এভাবেই করি। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মর্গ বা পুলিশ থেকে ডাকা হয়। লাশের সংখ্যা স্বাভাবিক এমনই থাকে।'
কারই/জেবি