মোস্তফা ইমরুল কায়েস
০৯ মার্চ ২০২৪, ০৮:৩৮ এএম
ধানমন্ডির জিগাতলা থেকে শংকর পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে গড়ে উঠেছে অনেক হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও রেস্তোরাঁ। বিকেল হলেই গরগরম হয়ে উঠতো এসব দোকান। কিন্তু কয়েকদিন ধরে আগের মতো চিত্র এখন নেই। এখন অনেকটা নীরবতা বিরাজ করছে এসব হোটেল-রেস্তোরাঁয়। বন্ধ হয়ে আছে অনেক প্রতিষ্ঠান। যেগুলো খুলছে সেগুলোতেও নেই তেমন ক্রেতা। ঢাকার বিভিন্ন এলাকার রেস্টুরেন্টগুলোতে ঝুঁকিপূর্ণ সিলিন্ডার ও অনিয়ম তদারকি করতে প্রশাসনের সাঁড়াশি অভিযান শুরুর পর হোটেল মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে এখন গ্রেফতার আতঙ্ক বিরাজ করছে।
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনের নিচতলায় আগুন লাগে। দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভবনে। ভয়াবহ এই আগুনে মারা গেছেন ৪৬ জন। এ ঘটনায় ১ মার্চ পুলিশ রমনা থানায় মামলা করে। এরপর থেকেই রেস্টুরেন্টগুলোতে ঝুঁকিপূর্ণ সিলিন্ডার ও অনিয়ম তদারকি করতে একযোগে মাঠে নামে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিসসহ সরকারি বেশ কয়েকটি সংস্থা। অভিযানে জরিমানা, ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজাসহ অনেক প্রতিষ্ঠান সিলগালা করে দেওয়ায় হোটেল সংশ্লিষ্টদের মাঝে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেইলি রোডের ঘটনার পর গত কয়েকদিনে ঢাকা মহানগর পুলিশ, রাজউক, ফায়ার সার্ভিস ও সিটি করপোরেশন মিলে অন্তত দেড় হাজারের মতো অভিযান চালিয়েছে। এর মধ্যে গত পাঁচ তিন দিনে হোটেল রেস্তোরাঁয় ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার দোকান ও কেমিক্যাল গোডাউনে শুধুমাত্র ডিএমপি ১ হাজার ৩৪৭টি অভিযান চালিয়েছে। এসব অভিযানে এখন পর্যন্ত ৮৭২ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এছাড়াও মামলা হয়েছে ২০টি। তাৎক্ষণিক অ্যাকশন নেওয়া হয়েছে ২০৪ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।
জরিমানা এড়াতে হোটেল-রেস্টুরেন্ট মালিকদের নানা কৌশল
মতিঝিল এলাকার বাংলাদেশ ব্যাংকের উত্তর পাশের সামনে গড়ে ওঠা ক্যাফে মাওলা সুইটস অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। কয়েকদিন আগেও সেটির বাইরে মোগলাই, পরোটা এবং মুরগির চাপ তৈরি করা হতো। কিন্তু বেইলি রোডের ঘটনার পর রেস্টুরেন্টটির বাইরে রাখা গ্যাস সিলিন্ডার, চুলা ও যাবতীয় সরঞ্জাম ভেতরে নিয়ে গেছেন তারা। গত কয়েকদিন থেকে ভেতরেই চলছে রান্নার কাজ।
রেস্টুরেন্টটির একজন কর্মী জানান, তারা আতঙ্কে আছেন। কখন জানি ভ্রাম্যমাণ আদালত আসে। এই ভয়ে এখন তারা ভেতরে বিকল্পভাবে রান্না করছেন।
শুধু ক্যাফে মাওলাই নয়, ঢাকার অধিকাংশ হোটেল ও রেস্টুরেন্ট মালিকরা জরিমানা এড়াতে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছেন। কেউ কেউ নিজ উদ্যোগে হোটেল থেকে বাইরে বের হওয়ার রাস্তা কাটছেন, আবার কেউ আগুন ধরলে দ্রুত নামার সিঁড়িও বানাচ্ছেন। এজন্য অনেকে দোকান বন্ধ রেখে সেই সংস্কারে মন দিয়েছেন।
আসন্ন রমজানে ব্যবসা সচল রাখতে কেউ কেউ বাসায় বসেও খাবার সরবরাহ রাখার চিন্তা করছেন। তাদের ভাষ্য হলো- যেসব ভবনে তারা ভাড়ায় হোটেল বা রেস্টুরেন্ট চালাচ্ছেন সেইগুলোর অধিকাংশতে নামার বিকল্প সিঁড়ি, বিকল্প দরজা নেই। ফলে দোকান খুললেই তাদের জরিমানা গুণতে হতে পারে। এই ভয়ে এখন অনেকে কর্মীদের ছুটি দিয়ে দোকানের সংস্কারে মন দিচ্ছে।
বদ্ধ রেস্টুরেন্টগুলোতে ক্রেতা কম
বেইলি রোডের ঘটনার পর আতঙ্ক শুধু হোটেল ও রেস্টুরেন্ট মালিকদের মাঝে ছড়িয়েছে তা নয়। ক্রেতার মাঝেও ঢুকেছে নানা ভয়।
শুক্রবার সন্ধ্যায় গুলশান লেকপাড় ঘুরে দেখা যায়, একটি রেস্টুরেন্টে মাত্র তিনজন ক্রেতা বসে আছেন। এর মধ্যে দুজন নারী ও একজন পুরুষ। সেখানে প্রায় আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করেও আর কাউকে ঢুকতে দেখা যায়নি। একই চিত্র বদ্ধ অন্যগুলোতেও। তবে খোলামেলা হোটেলগুলোতে কাস্টমার তুলনামূলক অনেক বেশি। গুলশান লেকপাড়ের খোলামেলা চায়ের দোকানগুলোর সবগুলোতে ক্রেতাদের উপস্থিতি দেখা গেছে অনেক। একই চিত্র মোহাম্মদপুর এলাকাতেও।
মোহাম্মপুর আল্লাহ করিম মসজিদের পশ্চিম পাশের রাস্তার ধারে চায়ের দোকান করেন রুহুল আমিন। তিনি বলেন, আগে আমার যে ক্রেতা ছিল এখনো একই। তবে তার পাশেই থাকা উঁচু ভবনে থাকা হোটেলে তেমন ক্রেতা নেই।
বিপাকে উঁচু ভবনের মালিকরা
বাংলামোটরে প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে হোটেল ব্যবসা করেন আলম হোসেন। একটি ভবনের নিচতলায় তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ঢাকা মেইলকে আলম হোসেন বলেন, ‘আমার ব্যবসা ভালোই চলছে। কিন্তু যারা বহুতল ভবনের ওপর তলাগুলোতে ব্যবসা করছেন তারা পড়েছেন বিপাকে। কারণ তাদের সেই তলাগুলোতে গ্রাহক উঠতে চাচ্ছে না। পরিবার স্বজনদের নিয়ে ওপর তলায় খেতে যাচ্ছে না কেউ।
তার কথার সত্যতাও মিলেছে। শুক্রবার বিকেলে ভাটারা, বাড্ডা, হাতিরঝিল ও গুলশান লেকপাড় এলাকায় এমন চিত্রই দেখা গেছে।
শাহজাদপুর লেকপাড় এলাকার আজিজুর রহমান বিজনেস সেন্টারের সামনে মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, খান্দানী খানাপিনা নামে একটি মুড়ি মেখে বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক মানুষের ভিড়। দোকানটিতে দোকানী ঢাকাইয়া মুড়ি ভর্তা বিক্রি করেন। আর সেই মুড়ি খেতেই বিকেল থেকে মানুষের জটলা। একসঙ্গে ১০ থেকে ১২ জনের মুড়ি মাখছেন। কিন্তু কুলাতে পারছেন না বিক্রেতা।
শুধু খান্দানী খানাপিনাই নয়, সেই লেকের পাশ দিয়ে গড়ে ওঠা যতো খাবারের দোকান ও হোটেল রয়েছে সবগুলোতেই কমবেশি ভিড় ও ক্রেতা দেখা গেছে।
তবে মুড়ি ভর্তা বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান খান্দানী খানাপিনার পাশে থাকা মায়ের দোয়া বিরিয়ানী হাউজ অ্যান্ড বাংলার খাবার নামে আরেক দোকানে ক্রেতার তেমন ভিড় নেই। বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আগুন আতঙ্ক বিরাজ করায় মানুষের অনেকে এমন হোটেলে গিয়ে খেতে ভয় পাচ্ছে বলে কেউ কেউ বলেন।
আতঙ্কে ব্যবসায়ীরা
বাংলামোটরের হোটেল ব্যবসায়ী আলম বলেন, বেইলি রোডের আগুনে ঘটনা হোটেল ব্যবসায়ীদের মনে আতঙ্ক ধরিয়ে দিয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলেও একটু ত্রুটি পেলেই জরিমানা করা হচ্ছে। ফলে এখন তো ভয় কাজ করছেই।
তিনি আরও জানান, ‘একটি হোটেল করার সময় ১৩টি সংস্থা থেকে লাইসেন্স নিতে হয়। তখন কী তারা এসব ক্রাইটেরিয়া দেখেনি। এখন কেন এই নেই, সেই বলে।’
বাংলাদেশ হোটেল-রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আজ যেসব অভিযান চালানো হচ্ছে এসবের কোনো ভিত্তি নাই।’
গত কয়েকদিনে ব্যবসার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এই সেক্টরে ২ লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ। অভিযান শুরুর পর থেকে ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে। কোথাও ক্রেতারা যাচ্ছে না। আর্থিক বহু ক্ষতি হয়েছে। অনেকেই প্রতিষ্ঠান খুলছে না, কেউ ভয়ে কেউ আতঙ্কে আছেন।
ইমরান হাসান আরও বলেন, ‘উন্নত বিশ্বে একটি কর্তৃপক্ষ থাকে। আমাদের দেশে এখনো তেমন কিছু হয়নি। যারা আছেন তারা তাদের নিজস্ব স্টাইলে অভিযান চালায়। একটি জিনিসকে বাহির থেকে পরিষ্কার করলে হবে না, ভেতর থেকে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। রাষ্ট্রের অনেক দায়িত্ব আছে। আমি বলব না, আমাদের মালিক ভালো। তাদের প্রতি ধাপে ধাপে নজরদারি করে একটি শৃঙ্খলায় আনতে হবে।’
বেইলি রোডের ঘটনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ দায় সবার, কেউ এড়াতে পারেন না। রাষ্ট্রযন্ত্রের অনেক অব্যবস্থাপনা আছে। সমন্বয়হীনতার অভাব আছে। যাতে কেউ অবিচারের শিকার না হয় সেজন্য সমন্বয় করতে হবে।’
ইমরান হাসান মনে করেন, ‘সরকারের একটি মনিটরিং সেল বা অথোরিটি থাকা দরকার। যারা হোটেল ও রেস্তোরাঁগুলো কীভাবে পরিচালিত হবে তার একটি সুন্দর গাইডলাইন তৈরি করবে। সেই অনুযায়ী তারা কোনো অসঙ্গতি দেখলে থানা, জেলা ও বিভাগীয় কমিটিদের নেতাদের নিয়ে সমন্বিতভাবে অভিযান চালাবে।’
বাংলাদেশ হোটেল-রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব জানান, গত আট দিনে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে হোটেল ও রেস্তোরাঁর ৮০০ কর্মচারী, মালিক ও ম্যানেজারকে আটক করা হয়েছে। তাদের মধ্যে কিছু জামিন হয়েছে। বাকিরা এখনো কারাগারে।
এমআইকে/এমআর