মোস্তফা ইমরুল কায়েস
৩১ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯:১২ এএম
ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে আরও একটি ইংরেজি বছর। আজ রাত ১২টায় আসবে নতুন বছর ২০২৪। বিদায় নেবে ২০২৩।
বিদায় নিতে যাওয়া বছরটিতে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য অন্য যেকোনো বছরের চেয়ে ছিল বেশি আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বছরজুড়ে টান টান উত্তেজনা ছিল রাজনীতির ময়দান। এছাড়া বিদেশি কূটনৈতিকদের দৌড়ঝাঁপ রাজনীতির মাঠকে মুহূর্তে মুহূর্তে তপ্ত করেছিল। নির্বাচন ঘিরে বছরটিতে সংঘাত হতে পারে এমন আশঙ্কা করা হলেও শেষ পর্যন্ত সহিংসতা সংঘর্ষের মধ্য দিয়েই শেষ হচ্ছে বছরটি। বছরের শুরুর দিকে সংঘর্ষ না হলেও শেষ দিকে এসে সংঘর্ষ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
চলতি বছর রাজনৈতিক সহিংসতায় হতাহতের বিষয়ে পুলিশ সদর দফতর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। তবে বেশ কিছু মানবাধিকার সংস্থা একাধিক উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, পুরো বছরজুড়ে শুধুমাত্র রাজনৈতিক সহিংসতায় ২৫৩টি ঘটনায় ১৮ জনের মৃত্যু এবং প্রায় ৪ হাজার মানুষ আহত হয়েছে।
পুরো বছরে বিরোধীমতের রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে পুলিশ ও সরকারদলের কর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলেও গত ২৮ অক্টোবর পর তা বেশি ভয়ানক হয়ে ওঠে। ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে ঢাকায় এক পুলিশ সদস্যসহ দুইজন নিহত হয়। আহত হয় ২৬ সাংবাদিকসহ পুলিশ ও বিএনপির অনেক নেতাকর্মী।
২৮ অক্টোবরের ঘটনায় প্রতিবাদে বিএনপি হরতাল ও অবরোধ ডাকলে বিভিন্ন মামলায় হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম ছাড়াও আরও কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা রয়েছেন। তারা এখনো জেলেই বন্দী। শুধুমাত্র ২৮ অক্টোবরের ঘটনাতেই ৩৬ মামলা করে পুলিশ। গ্রেফতার করা হয় দেড় হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে।
এছাড়া গত ১০ নভেম্বর থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত পুলিশের তথ্যমতে, ১ হাজার ৮১৩ জন বিএনপি কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
তবে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, অক্টোবরে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ১৫১টি মামলা হয়েছে। বিএনপির দাবি, ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৩ হাজারের বেশি কর্মীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
বিএনপির ডাকা হরতাল অবরোধকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাস ও ট্রেনসহ বিভিন্ন যানবাহনে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে।
ডিএমপির তথ্যমতে, গত ২৮ অক্টোবর থেকে ৯ নভেম্বর পর্যন্ত ৬৪টি বাসে আগুনের ঘটনায় ৬৪টি মামলা হয়েছে। তবে নাশকতার চেষ্টার সময় পুলিশ ও জনতার হাতে ১২ জন আটক হয়েছেন। আটককৃতরা যাত্রীবেশে বাসে ওঠে আগুন দেওয়ার সময় হাতেনাতে আটক হন।
গত ২৯ অক্টোবর ডেমরা এলাকায় একটি বাসে আগুনের ঘটনায় নাঈম নামে এক হেলপারের মৃত্যু ও রবিউল নামে একজন দগ্ধ হন। তারা সেদিন বাসের মধ্যে ঘুমিয়ে ছিলেন।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, গত ২৮ অক্টোবর থেকে ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত ২৮৯টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ঢাকাসহ সারাদেশে ২৮৫টি যানবাহন ও ১৫টি বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই তালিকায় ১৮০টি বাস, ৪৫টি ট্রাক, ২৩টি কাভার্ড ভ্যান, ৮টি মোটরসাইকেল এবং ২৯টি অন্যান্য যান, যার মধ্যে কয়েকটি ট্রেনের বগিও রয়েছে।
সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গত ১৯ ডিসেম্বর তেজগাঁও এলাকায় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে আগুনের ঘটনায়। সেদিন এক নারী ও শিশুসহ চারজনের মৃত্যু হয়।
এছাড়া ২৩ নভেম্বর রাত সাড়ে ৯টার দিকে সিলেট রেলস্টেশনে পার্কিং করা আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেসের একটি কোচে দুর্বৃত্তরা আগুন দেয়। আগুনে ‘উপবন এক্সপ্রেস’ ট্রেনের এসি চেয়ার (বি) বগিতে আগুন লেগে কোচের অন্তত ২৩টি আসন পুড়ে যায়। তবে এ ঘটনায় কেউ হতাহত হয়নি।
বছরব্যাপী বিভিন্ন ঘটনায় আসকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে মারামারি, পুলিশ, বিএনপি ও বিরোধী মতের রাজনৈতিক দলের কর্মীদের সঙ্গেও দলটির কর্মীদের মারামারির ঘটনা ঘটেছে।
গত আগস্ট পর্যন্ত শুধুমাত্র বিএনপি আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ, আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ, ছাত্রলীগ-ছাত্রলীগ এবং দলটির অঙ্গ সংগঠনগুলোর সঙ্গে পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর আহত হয়েছে দেড় হাজারের বেশি। আর বিএনপি ও জামায়াতের মোট চারজন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে বিএনপির তিনজন ও জামায়াতে ইসলামীর একজন।
আরও পড়ুন
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে সংঘর্ষের ৫৫টি ঘটনায় সরকার দলীয় দলটির ৯৭২ জন আহত ও একজন নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে দলীয় কোন্দলে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের ৫৭টি ঘটনায় ৬৯৪ জন আহত ও আটজনের মৃত্যু হয়েছে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী যুবলীগের সংঘর্ষের চারটি ঘটনায় ১৭ জন আহত হয়। এসব ঘটনা ছাড়াও ছাত্রলীগ ও আওয়ামী যুবলীগের মধ্যে মারামারির চারটি ঘটনায় ২৮ জন আহত ও দুইজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ছাত্রলীগ ও ছাত্রলীগের মধ্যে ১২টি মারামারির ঘটনায় ৮৬ জন আহত এবং একজন নিহত হয়।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের তিন ঘটনায় ৩৫০ জন আহত ও একজন নিহত হয়। এছাড়াও যুবলীগ ও পুলিশের সংঘর্ষের পাঁচ ঘটনায় ৮১ জন আহত ও একজন নিহত এবং আওয়ামী ও জাপার মধ্যে এক ঘটনায় ২৫ জন আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
অন্যদিকে বিএনপি, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষে ১৮ ঘটনায় ১৯৯ জন আহত, যুবদল ও ছাত্রলীগের ৩ ঘটনায় ৬৪ জন আহত, গণঅধিকার ও ছাত্রলীগের মধ্যে একটি সংঘর্ষের ঘটনায় ১৩ জন আহত, ছাত্রলীগের সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সংঘর্ষের এক ঘটনায় ১২ জন আহত এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চের সংঘর্ষে ২৫ জন আহত হয়।
বিএনপির দুই পক্ষের ১২ সংঘর্ষে ১১২ জন আহত, যুবদল ও ছাত্রদলের সংঘর্ষে একজন আহত, ছাত্রদলের দুই পক্ষের সংঘর্ষের ৬ ঘটনায় ১৬ জন আহত ও দুইজন নিহত হয়েছেন। এছাড়াও যুবদলের দলীয় কোন্দলের আরও পাঁচ ঘটনায় ৮১ জন আহত হয়েছেন।
এসব ঘটনা ছাড়াও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পুলিশের ৩২টি সংঘর্ষের ঘটনায় ৮০৪ জন আহত হয়েছেন।
বিএনপি ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষের এক ঘটনায় ১৫ জন আহত, জামায়াত-শিবির ও পুলিশের সংঘর্ষে ১০ জন আহত, জাপা ও পুলিশ সংঘর্ষে ১৩ জন, ছাত্রলীগ-যুবদল-পুলিশ ত্রিমুখী সংঘর্ষে ৩০ জন গণসংহতি ও পুলিশের ১০ ঘটনায় ৯০ জন আহত এবং দুই জন নিহত হয়।
শুধুমাত্র একটি ইউপি নির্বাচনে একটি ঘটনায় মারামারিতে ৫ জন, জাতীয় নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার তিন ঘটনায় ১৬ জন, নির্বাচনী সাত সহিংসতায় ৭০ জন এবং সিটি নির্বাচনের সহিংসতায় ১৫ জন আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
শুধু তাই নয়, গত ২৮ জুলাই যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগ আয়োজিত শান্তি সমাবেশের শেষ দিকে রাজধানীর গুলিস্তানের গোলাপ শাহ মাজারের কাছে দুই পক্ষের সংঘর্ষে রেজাউল নামে এক মাদাসা ছাত্র নিহত এবং চার ব্যক্তি আহত হয়েছেন।
পাশাপাশি গত ৭ ডিসেম্বর ঢাকার নয়াপল্টন এলাকায় পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের মধ্যে মকবুল হোসেন নামে আহত একজন হাসপাতালে মারা যান।
এমআইকে/এমআর