মোস্তফা ইমরুল কায়েস
২৫ জুন ২০২৩, ১০:৩৪ এএম
রাজধানীতে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনায় কিশোররা যুক্ত থাকায় এই অপরাধ নিয়ন্ত্রণে নড়েচড়ে বসেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে যুক্তদের একটি তালিকা করার উদ্যোগ নিয়েছে তারা। রাজধানীতে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা কত, তাদের পরিচয় কী, অপরাধের বিস্তারিত বিবরণ এবং তাদের পেছনে কারা রয়েছে- সে বিষয়গুলো উঠে আসছে পুলিশের তালিকায়। ইতোমধ্যে এই তালিকায় হাজারের বেশি কিশোরের নাম এসেছে। তবে পুলিশ জানিয়েছে, এই তালিকা নিয়মিত আপডেট হবে। এজন্য সংখ্যা কম-বেশি হতে পারে।
২০১৭ সালে উত্তরায় আদনান কবির নামে এক কিশোর খুনের মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসে কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়টি। আগে এসব অপরাধকে শিশু আদালতে শিশু-কিশোর অপরাধ হিসেবে বিচার হতো। তবে ২০১৯ সালের পর থেকে এসব মামলা ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে চলছে।
আরও পড়ুন: কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি বন্ধের তাগিদ প্রধানমন্ত্রীর
গত কয়েক বছর ধরে ঢাকায় কিশোর গ্যাং মাথা চাড়া দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা কমানো সম্ভব হয়নি। সবশেষ কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা করার উদ্যোগ নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এই তালিকায় এখন পর্যন্ত হাজারের বেশি কিশোর গ্যাংয়ের নাম এসেছে। ঢাকা মহানগর এলাকার প্রতিটি ওয়ার্ড ও মহল্লা ধরে ধরে কিশোর গ্যাং সদস্যদের নাম, ঠিকানা ও বয়স এবং তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে তালিকা তৈরি হচ্ছে।

ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, বিষয়টি নিয়ে গত বছর থেকে কাজ চলছিল। কিন্তু এ বছরের মাঝামাঝি তা চূড়ান্ত হয়েছে। তবে এই তালিকা সবসময় এক থাকবে না। কখনো বাড়বে আবার কখনো কমবে। কারণ কেউ কেউ অপরাধ করে জেলে যাচ্ছে, কেউ এলাকা ছাড়া হচ্ছে আবার কেউ কেউ বিয়ে-শাদি করে কিশোর গ্যাংয়ের পথ থেকে সরে আসছে। ফলে এই তালিকায় আসা নাম ও সংখ্যা বাড়বে-কমবে।
আরও পড়ুন: কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে কমিউনিটি পুলিশকে কাজ করার তাগিদ
ঢাকায় কিশোর গ্যাং প্রতিরোধ নিয়ে ইতোমধ্যে বিভিন্ন সভা-সেমিনার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। প্রতিটি এলাকার কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বাবা-মাকে থানায় ডেকে তাদের ব্যাপারে সতর্কও করা হয়েছে। কিন্তু কোনো কাজের কাজ হয়নি। বাধ্য হয়ে তালিকা প্রস্তুত করছে পুলিশ। এই তালিকা করতে প্রতিটি থানা এলাকায় গোয়েন্দা সদস্যদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। থানায় থাকা অপরাধের খতিয়ান ছাড়াও মাঠ পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে তালিকা চূড়ান্ত করা হচ্ছে।
ডিএমপির সূত্র বলছে, গত ১৯ বছরে ঢাকায় ১৩০টির অধিক কিশোর হত্যার ঘটনা ঘটেছে। আর গত চার বছরে শুধু ঢাকাতেই ৪০ জনের বেশি কিশোর খুনের শিকার হয়েছে। এসব ঘটনায় আসামিও হয়েছে পাঁচ শতাধিক।
ঢাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের দিয়ে এলাকাভিত্তিক রাজনৈতিক নেতা ও মাদক ব্যবসায়ীরা নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। তাদের দিয়ে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল, জমি দখল, এলাকাভিত্তিক আধিপত্য ধরে রাখার কাজ এবং চাঁদাবাজিও করা হয়ে থাকে। আর এসব অভিযোগের কথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাসিক প্রতিবেদনে বারবার ওঠে এসেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার উত্তরা, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, মহাখালী, লালবাগ, পুরান ঢাকা, কদমতলী, হাজারীবাগ, বংশাল, ধানমন্ডি, তেজগাঁও, মুগদা, চকবাজার ও শ্যামপুর এলাকায় বিভিন্ন নামে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা সক্রিয়। তবে এসব এলাকার মধ্যে উত্তরা ও মিরপুরে বেশিসংখ্যক কিশোর সদস্য রয়েছে।
ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার ঢাকা মেইলকে বলেন, এ বিষয়ে ডাটা তৈরির কাজ চলমান। এটাতে তো কখনোই ফিক্স তালিকা করা যায় না। কারণ এই তালিকা সব সময় বদলে যায়। বাড়ে কমে। আজকের যে কিশোর আগামীকাল সে যুবক। আর এটার প্রতিনিয়ত আপগ্রেডেশনের কাজ চলবে। এটা নিয়মিত প্রক্রিয়া।
এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, কমিশনার স্যারের পক্ষ থেকে সব থানায় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল কিশোররা যেন কোনোভাবে গ্যাংয়ে জড়িয়ে না পড়ে। তারা যেন কিশোরের মতো আচরণ করে। তারা যাতে গ্যাং কালচারের সাথে জড়িয়ে না পড়ে তার জন্য আমাদের কাউন্সিলিং চলছে।
আরও পড়ুন: কিশোর গ্যাং নিয়ে একজন চিকিৎসকের ভাবনা
ডিএমপির এমন উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন অপরাধ বিজ্ঞানীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক ঢাকা মেইললে বলেন, আমরা বারবার কিশোর গ্যাংয়ের একটি তালিকা করার অনুরোধ করেছি। সর্বশেষ তারা যে একটি তালিকা করছে এটাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। যারা কিশোর অপরাধী তাদের নাম তালিকায় তোলা ও সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সেই উপযুক্ত ব্যবস্থার মধ্যে কারও জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা, কারও কর্মের ব্যবস্থা করা অথবা এর পাশাপাশি সংশোধনেরও ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু আইনগত ব্যবস্থা নিলেই অপরাধ নিয়ন্ত্রণ হয়ে যাবে ব্যাপারটা কিন্তু তেমনও নয়।

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, কিশোররা যে অপরাধপ্রবণ হয়ে পড়ছে এর পেছনে নানা প্রেক্ষাপট আছে। কখনো কখনো কিশোররা এক সাথে চলতে গিয়ে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে৷ এছাড়া বড় প্রেক্ষাপট হলো অনেকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি ও ফায়দা হাসিলের জন্য কিশোর গ্যাং তৈরি করছে৷ তারা এই কিশোর গ্যাংদের দিয়ে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে, টেন্ডারবাজি বা মাদকের মতো ব্যবসায়ও তারা নিয়ন্ত্রণ করছে। আর এগুলো নিয়ন্ত্রণ করাটা কিন্তু ডিএমপির জন্য চ্যালেঞ্জিং।
২০১৭ সালে উত্তরায় আদনান কবির নামে এক কিশোর খুনের মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসে কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়টি। আগে এসব অপরাধকে শিশু আদালতে শিশু-কিশোর অপরাধ হিসেবে বিচার হতো। তবে ২০১৯ সালের পর থেকে এসব মামলা ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে চলছে। এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ কিশোরদের তালিকার পাশাপাশি ডিএমপিকে তাদের জন্য কিশোর কারাগার তৈরির পরামর্শ দিয়ে বলেন, কিশোররা যে অপরাধ করছে তা প্রাপ্তবয়স্কদের করা অপরাধকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তাই ডিএমপিকে তালিকার পাশাপাশি তাদের জন্য একটি কিশোর কারাগার তৈরি করা যেতে পারে। সেখানে তাদের রেখে সংশোধনের ব্যবস্থা করা। আইনি ব্যবস্থা ছাড়াও যারা এসব কিশোরকে কিশোর গ্যাং হিসেবে তৈরি করছে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা। কিন্তু সেটি নিয়ে যে ভাবা হচ্ছে বা করতে হবে এ নিয়ে কোনো কথা আমরা শুনিনি। এই আবেদনটি সবসময় থাকে যারা অপরাধী তৈরি করছে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। এর পাশাপাশি যেসব কারণে কিশোর গ্যাং তৈরি হচ্ছে সেসব কারণ খুঁজে বের করে তার সমাধান করতে হবে।
সমাধান হিসেবে তিনি বলেন, কিশোরদের অভিভাবকদের ছাড়াও শিক্ষক, রাজনীতিবিদ ও সর্বস্তরের মানুষের মাঝে যদি কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আওয়াজ তোলা যায় তখনই এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
এমআইকে/জেবি