images

লাইফস্টাইল

স্বর্ণের দাম বাড়ে কমে কেন? 

নিশীতা মিতু

২৩ অক্টোবর ২০২৫, ১২:৫২ পিএম

সোনার দাম যেন হয়ে গেছে কিশোরী প্রেমিকার মন। তার মতিগতি বোঝা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দাম বাড়ছে তো এই কমছে। স্বর্ণ কেনার কথা যারা ভাবছেন তারাও আছেন দোটানায়। এখন কিনবেন? নাকি কমলে কিনবেন? স্বর্ণ কিনে জিতবেন না কি ঠকবেন? 

চলতি বছর এখন পর্যন্ত মোট ৬৭ বার দেশের বাজারে সমন্বয় করা হয়েছে স্বর্ণের দাম। দাম বেড়েছে ৪৮ বার, আর কমেছে মাত্র ১৯ বার। এর আগে, ২০২৪ সালে দেশের বাজারে মোট ৬২ বার স্বর্ণের দাম সমন্বয় করা হয়েছিল। যেখানে ৩৫ বার দাম বেড়েছিল আর কমেছিল ২৭ বার।

কারো কারো মনে প্রশ্ন জাগে, স্বর্ণের দাম এত বাড়ে-কমে কেন? এর কারণ কী? স্বর্ণে কি বিনিয়োগ করা উচিত?— সব প্রশ্নের উত্তর জানুন এই প্রতিবেদনে:

gold1

সোনার দাম বাড়ে কেন?

সাধারণত, সোনার দাম বৃদ্ধি পেছনে যে কারণগুলো দায়ী তা হলো- 

  • যেকোনো কারণে চাহিদা বৃদ্ধি
  • অর্থনৈতিক বা ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা
  • মুদ্রাস্ফীতি

সোনার দাম কমে কেন?

নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে সোনার দাম প্রায়ই কমে যায়-

  • যেকোনো কারণে চাহিদা কমে যাওয়া
  • উচ্চ সুদের হার
  • বাজারে নতুন সোনার আগমন

gold4

সোনার দাম কীভাবে নির্ধারণ হয়? 

সোনার মূল্য বিভিন্ন কারণের ওপর নির্ভর করে। পরিস্থিতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সোনার দামও পরিবর্তিত হয়। যেসব বিষয়ের ওপর নির্ভর করে সোনার দাম ঠিক করা হয়- 

সরবরাহ

সোনা একটি সীমিত সম্পদ। পৃথিবীতে যতটুকু সোনার খনি আছে তা থেকে বিশাল অংশ খনন করা হলেও সেই তুলনায় নতুন মজুদ হয় সামান্য। সব খনি থেকেও সোনা উত্তোলনও সম্ভব হয় না। তাই বাজারে সরবরাহ হওয়া সোনার পরিমাণ প্রতিবছর পরিবর্তন হয়। 

নতুন খনি আবিষ্কার করা গেলে তা হয় ইতিবাচক। তখন সোনার দাম হয়তো কিছুটা কমে। অন্যদিকে পরিবেশগত বিধিনিষেধের কারণে খনন করা সোনার পরিমাণ কমতে পারে। তখন আবার দাম বাড়ে। সহজ কথায়, বাজারে কী পরিমাণ সোনা সরবরাহ হচ্ছে তার ওপর দাম নির্ভর করে। 

gold3

চাহিদা

অবশ্যই, সোনার চাহিদার সঙ্গে সরবরাহের সম্পর্ক রয়েছে। অন্যান্য সম্পদের পাশাপাশি যেহেতু মানুষ প্রচুর সোনাও কেনে তাই এটি অর্থনীতির ওপরও প্রভাব ফেলে। যদি বিনিয়োগকারী এবং সাধারণ ভোক্তাদের ব্যয় করার জন্য কম ব্যয়যোগ্য আয় থাকে, তাহলে সোনার দাম সেই অনুযায়ী প্রভাবিত হয়। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংক

কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুরক্ষা ও সম্পদ উভয়ের জন্যই প্রচুর পরিমাণে সোনা কিনে। যতন তারা বেশি সোনা কেনে, তখন সাধারণের জন্য থাকা সোনার পরিমাণ স্বাভাবিকভাবেই কমে। ফলে দাম বাড়ে। আবার অনেক বিনিয়োগকারীরা যখন দেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো বেশি সোনা কিনছে, তখন তারাও একে বেশি সোনা কেনার ইঙ্গিত মনে করেন। ফলে সাধারণ বাজারে ঘাটতি সৃষ্টি হয়। দাম আরও বেড়ে যায়।

অর্থনীতি এবং নিরাপদ বিনিয়োগ

সামগ্রিক অর্থনীতিও সোনার ওপর প্রভাব ফেলে। যখন অর্থনীতির বেহাল দশা থাকে, তখন স্টক বা বন্ডের মতো অন্যান্য বিকল্পের তুলনায় সোনাকে একটি নিরাপদ বিনিয়োগের সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি সোনার চাহিদা বৃদ্ধি করে, সরবরাহ সীমিত করে এবং মূল্যবান এই ধাতুর দাম বাড়ায়।

1679849099163

সোনার দামকে প্রভাবিত করতে পারে এমন নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে মুদ্রাস্ফীতি এবং সুদের হার। যখন মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পায়, তখন সোনার দামও বৃদ্ধি পায়, কারণ চাহিদা বৃদ্ধি পায় (কারণ সোনাকে ‘নিরাপদ’ বিকল্প হিসাবে দেখা হয়)। বিপরীতে, যখন সুদের হার বেশি থাকে, তখন চাহিদা সাধারণত হ্রাস পায়। ফলে সোনার দাম কমে। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘যদি মুদ্রাস্ফীতি অব্যাহত থাকে এবং উচ্চ অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা অব্যাহত থাকে, তাহলে সোনা শক্তিশালী থাকবে। যখনই বিশ্বব্যাপী অনিশ্চয়তা থাকে, তখন মানুষ এমন জিনিসের ওপর অর্থ বিনিয়োগ করতে পছন্দ করে যা তাদের জানা মূল্য ধরে রাখে। এক্ষেত্রে সোনা বারবার প্রমাণ করেছে যে এটি তার মূল্য ধরে রাখে।’

রাজনীতি

কেবল অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কথা বললেই হবে না। সোনার দাম বাড়া-কমার পেছনে রাজনৈতিক অস্থিরতাও যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। একটি নির্দিষ্ট দেশের মুদ্রার বিপরীতে, সোনা বিশ্বব্যাপী মূল্যবান হিসেবে স্বীকৃত এবং প্রয়োজনে রাজনৈতিক অস্থিরতার অঞ্চল থেকে একে শারীরিকভাবে স্থানান্তর করা যেতে পারে। 

gold6

আবেগ

এক্ষেত্রে মা-খালাদের বলা সেই পুরনো কথাই বলা যায় যে সোনা হলো বিপদের বন্ধু। যেহেতু বছরের পর বছর এর ভালো বাজারমূল্য রয়েছে তাই অদূর ভবিষ্যতের জন্য হাতের সম্বল বা নিশ্চিত সম্পদ হিসেবে অনেকেই সোনা বেছে নেন। সম্ভবত এই কারণে আমাদের দেশে বিয়েতে স্বর্ণের গয়না দেওয়ার অলিখিত রেওয়াজ রয়েছে। 

সোনার দাম হ্রাস-বৃদ্ধির আরও কিছু কারণ

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনভেস্টোপিডিয়ায় স্বর্ণের দাম হ্রাস-বৃদ্ধির বিষয়ে কিছু ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। এতে বলা হয়েছে, ডলার বাজারে অস্থিরতা, জ্বালানি তেলের দাম, মূল্যস্ফীতি, ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ব্যাংক ঋণের সুদহার স্বর্ণের বাজারে বড় প্রভাব রাখে। যেমন– ডলারের দাম বাড়লে স্বর্ণের দাম কমে। ডলার দুর্বল হলে, তেজ বাড়ে স্বর্ণের। 

আবার বিশ্বের কোনো দেশে যুদ্ধ শুরু হলে অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। ফলে বিনিয়োগকারীরা অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ না করে স্বর্ণকে নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন। ব্যাংকে সুদহার কমে গেলে বিনিয়োগকারীরা হাত বাড়ান স্বর্ণের দিকে। তখনও দাম বাড়ে এই ধাতুর। 

gold5

মানুষ কেন সোনায় বিনিয়োগ করে?

সকালে সোনার দাম বাড়ে তো রাতে কমে। রাতে বাড়ে তো সকালে কমে। তারপরও কেন অসংখ্য মানুষ সোনায় বিনিয়োগ করে? কী এমন আছে সোনায় যে মানুষ এই ধাতুর পেছনে ছোটে? এর উত্তর হলো- 

সীমিত: বাজারে সোনার সীমিত সরবরাহ রয়েছে, অতিরিক্ত সোনা মুদ্রণ বা তৈরি করা যাবে না। আর সীমিত জিনিস অবশ্যই মূল্যবান। 

মূল্যবান: আপনি যে দেশেই থাকুন না কেন, সোনার মূল্য পাবেন। কেননা এটি বিশ্বব্যাপী মূল্যবান।

বৈচিত্র্যময় বিনিয়োগ: যাদের বিস্তৃত বিনিয়োগ আছে তারা পোর্টফোলিওতে বৈচিত্র্য আনার জন্য ভিন্ন উপায় পছন্দ করেন। সেক্ষেত্রে সোনায় বিনিয়োগ তাদের পছন্দের তালিকায় থাকে। 

gold7

লাভজনক: সোনা এমন একটি জিনিস যা আপনি সহজে মজুদ করতে, সুরক্ষিত করতে বা স্থানান্তর করতে পারবেন। শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের তুলনায় যা বেশি লাভজনক। 

এসব সুবিধা থাকলেও সোনায় বিনিয়োগের কিছু ঝুঁকিও থাকে। কারণ এর দাম কখনো এক জায়গায় স্থির থাকে না। ওঠা-নামা করে। তাই ভালোমন্দ বুঝেই আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সোনায় বিনিয়োগ করবেন কি না। 

আপনার কি সোনায় বিনিয়োগ করা উচিত?

যেকোনো বিনিয়োগে বুদ্ধিমানের কাজ হলো কম দামে কেনা এবং বেশি দামে বিক্রি করা। বিনিয়োগের আগে, বর্তমান সোনার দাম এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দেখুন। যদি দাম বর্তমানে কম থাকে এবং বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে, তাহলে বিনিয়োগের জন্য এটি একটি উপযুক্ত সময় হতে পারে। 

gold8

তবে সোনার ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ করা উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ, দ্রুত মুনাফা অর্জনের জন্য সোনা উপযুক্ত নয়। উল্লেখযোগ্য লাভ পেতে কয়েক দশক সময় লাগে এবং এর সুবিধা প্রায়শই কেবল ক্রমবর্ধমান দামের সময়কালেই লক্ষ্য করা যায়।  

তবে জীবনের সব সম্বল (অর্থ, জমি) বিক্রি করে সোনায় বিনিয়োগ করা মোটেও উচিত নয়। বরং আপনার যদি পর্যাপ্ত অর্থ, সম্পদ থাকে তাহলে বাড়তি সম্পদ হিসেবে স্বর্ণে বিনিয়োগ করতে পারেন। 

স্বর্ণে দাম বাড়ুক বা কমুক, দিনশেষে এটি মূল্যবান। সময়ে সঙ্গে সঙ্গে এর দাম বাড়তেই থাকবে। তাই দীর্ঘ বিনিয়োগের জন্য স্বর্ণকে বেছে নিতেই পারে। দাম কমলেও লোকসান হবে না। 

এনএম