images

লাইফস্টাইল

‘কাগজের নৌকা’য় চড়ে শীতের সুনামগঞ্জ ভ্রমণ

লাইফস্টাইল ডেস্ক

৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:৫২ পিএম

images

বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে কোথাও ঘুরতে যাওয়া চাই-ই, এই চিন্তা মাথায় আসার পর প্রথমেই মনে হলো সিলেট বিভাগের যেকোনো জায়গার কথা; কেননা চাকরিসূত্রে আমি পাক্কা হবিগঞ্জবাসী। কই গেলে ভালো হবে ভাবতে ভাবতেই সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরের সুন্দর সুন্দর হাউজ বোট নিয়ে গবেষণা শুরু করি। 

অনলাইন পেইজ ঘেটেঘুটে যা বুঝলাম যে শীতকাল হচ্ছে হাওরের অফ-সীজন, তাই ট্যুরিস্ট কম হয় ও বোট সার্ভিসও কম। অবশেষে অনেক খুঁজে যে বোট ঠিক করি তার নাম ছিল ‘তরী-ময়ূরাক্ষী’। মাথাপিছু ৬০০০/- খরচে দুইদিন-একরাতের এই প্যাকেজে কাপল কেবিনে থাকা, তিনবেলা খাবার, সন্ধ্যার নাশতা এবং সাইট সিয়িং সবই ইনক্লুডেড ছিল।

e8461f92-5f6d-4862-b2bc-70c8585eb125

ট্যুরের নির্দিষ্ট দিনের আগের দিন সন্ধ্যা নাগাদই আমরা (আমি এবং আমার হাজবেন্ড) পৌঁছে যাই সুনামগঞ্জ শহরে। ছোটখাটো, ছিমছাম শহর সুনামগঞ্জ। বড় শহরের মতোন আলো ঝলমলে কিংবা জনসমাগম কম হলেও মোটামুটি শান্তিময় পরিবেশ। ওখানকার হোটেল রয়েল ইনের একটা কাপল রুম ঠিক করি রাত্রিযাপনের উদ্দেশ্যে। রাতের খাবার লোকাল পানসি হোটেলে সেরে নেই আমরা। 

সেই রাতেই আমাদের জানানো হয় অনিবার্য কারণবশত আমাদের হাউজ বোট পরিবর্তন হয়েছে, এখন আমাদের ট্যুর হবে ‘কাগজের নৌকা’ নামক বোটের সাথে। যেখানে আমাদের সফরসঙ্গী হিসাবে বারোজনের একটি ফ্যামিলিও থাকবে। এমনিতে পুরো প্যাকেজ-এর সবকিছুই সেইম থাকবে। নৌকার ছবি দেখে কিছুটা মন খারাপ হলেও ভাবলাম চলেই যখন এসেছি, দেখি কী হয়...

c0012678-30c7-4ca2-8914-ea0441fa0405

প্রথম দিন
 
পরদিন ভোরে উঠেই ব্যাগ পত্তর গুছিয়ে আমরা সুনামগঞ্জ থেকে তাহিরপুর যাবার জন্য সিএনজি ভাড়া করি। গুগল ম্যাপে দূরত্ব মোটামুটি এক ঘন্টা পনেরো মিনিট দেখাচ্ছিল, তবে যেতে দেড়ঘন্টার মতোন লেগেছিল। কয়েকজন মিলে গেলে কম খরচে যাওয়া যায়; তবে আমরা দুজন যেহেতু রিজার্ভ গিয়েছি, আমাদের ৫০০/- লেগেছিল। এক্ষেত্রে অবশ্যই দামাদামি করতে হবে। বর্ষা মৌসুমে যারা আসে তাদের সম্ভবত এই এক্সট্রা রাস্তাটুকু পেরোতে হয় না। অফ-সীজনে পানি কমে যায় দেখেই বোট ছাড়ে তাহিরপুর থেকে। 

যাইহোক তাহিরপুর বাজারে পৌঁছার পর আরেকটা অটো ধরে আমাদের যেতে হয় নৌকার ঘাটে। ততক্ষণে আমাদের মনে হচ্ছিল আমরা বোধহয় দেশের শেষ প্রান্তেই চলে এসেছি। ঘাটে পৌঁছে আরও একটা ডিঙ্গি চড়ে আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত ‘কাগজের নৌকা’য় আসি।

95064318-383f-4647-a673-c8c306c89348

নৌকায় ঢুকেই আমরা আমাদের জন্য ফিক্সড কাপল কেবিনে চলে যাই। সেখানে এটাচড ওয়াশরুমে ফ্রেশ হয়ে আমরা নৌকার ছাদে চলে আসি। কারণ পুরোটা নৌকা ঘুরে দেখতে চাচ্ছিলাম তখন। নৌকার ম্যানেজার শোয়েব ভাইসহ অন্যান্য স্টাফরা আমাদের যথেষ্ট আন্তরিকতার সাথে অভ্যর্থনা করেছিলেন এবং পুরোটা সময় সঙ্গও দিয়েছিলেন। ছাদে যেতেই আমার মন ভালো হয়ে যায়। হাওরের পানির বুকে ভাসমান নৌকা, সকালের হলদে রোদ আর সেই রোদে সুসজ্জিত সেই ছাদ। একটু বাদেই আমাদের সকালের খাবার দিয়ে যাওয়া হয়। খিচুড়ি, ডিম ভুনা, আচার, বেগুন ভাজা। মজা করে খেয়ে-দেয়ে কিছু ফটোসেশান করে আমরা বোটের লবিতে নেমে আসি আয়েশ করে চা খাব বলে।

লবিটাও দারুণ সাজানো ছিল। মেঝেতে ঘাসের কার্পেট আর চারপাশে কাঠ-বেতের কাঠামো, তার ফাঁকে ফাঁকে আলো-ছায়ার খেলা দেখতে ভালোই লাগছিল। পুরো ট্যুরে চা ছিল অফুরন্ত তবে সেটা সেলফ সার্ভিস। এদিকে তখনো আমাদের সফরসঙ্গী পরিবারটি না এসে পৌঁছানোতে বোট ছাড়তে দেরি হচ্ছিল। তাই আমরা নেমে একটু আশেপাশে ঘুরে বেড়াতে শুরু করি। 

53253e4e-227c-43e9-9976-4683a8b99ca8

আশেপাশে পুরোটাই পানি দিয়ে ঘেরা। মাঝেমধ্যে একটুখানি জলাভূমি, বিস্তৃত মাঠ, গ্রামের মেঠো পথ। টুকিটাকি ছবিও তুললাম। এরমাঝে দুপুর ঘনিয়ে এলো, দুপুরের খাবারের আয়োজন সাজানো হয়েছে ছাদে। সফরসঙ্গী ফ্যামিলিটিও ততক্ষণে চলে এসেছে। একইসঙ্গে সবাই লাঞ্চ সারা হলো হাওরের ছোটমাছ, লাউয়ের তরকারি আর বোয়াল মাছ দিয়ে। এরমধ্যেই নৌকা ছেড়ে দিয়েছিল। তখন পড়ন্ত বিকেল... সেই হালকা রোদের আলোয় হাওরের জল দেখাচ্ছিল সোনালু! আমরা আবার লবিতে এসে বসলাম আর আরেককাপ চা হাতে হাওরের বুকে নৌকার সমতালে বয়ে যাওয়া উপভোগ করতে থাকলাম।

সন্ধ্যের ঠিক আগে আগে আমরা পৌঁছালাম ওয়াচ টাওয়ারের কাছাকাছি একটা জায়গায়। রাতটা আমরা এখানেই কাটাবো। নৌকা বাঁধা হলো ঘাটে। আমরা সবাই নেমে বিকেল-সন্ধ্যার মুখোমুখি সময়টুকু ঘুরে বেড়াতে লাগলাম এদিক সেদিক। কনে দেখা আলোয় চারপাশের ঘন গাছের সারি আর নির্জনতার নিস্তব্ধতায় মন উদাস হয়ে গিয়েছিল কিছু সময়ের জন্যে। 

deb566b1-337d-40da-88a3-1c8c218596c4

সন্ধ্যার পর নাশতা হিসাবে নুডুলস আর চা দেওয়া হয়। ওদিকে বোটের ছাদে চলছিল বারবিকিউ চিকেনের প্রস্তুতি। ওই ফ্যামিলির বাচ্চাকাচ্চারা গান ছেড়েছিল সাউন্ডবক্সে। এর মাঝে আবার আমরা দুইজন গিয়ে লবিতে বসলাম। দেখলাম আকাশ দেখে ঘুরতে না এলেও আজ আকাশে চাঁদমামার দারুণ উপস্থিতি! শীতের রাতে কুয়াশা আর ঠান্ডার মধ্যে ছাদে গিয়ে সবার সাথে গল্প করতে করতে জোছনাও উপভোগ করলাম কিছুক্ষণ।

গল্প করতে করতেই রাতের খাবার তৈরি হয়ে গেলো। বারবিকিউ চিকেন আর নান খেয়ে উঠতে না উঠতেই বোটের পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ করা বাউল শিল্পীরা এসে উপস্থিত। স্থানীয় এই শিল্পীরা তাদের দরদী কণ্ঠের গান দিয়ে আমাদের মাতিয়ে রাখলেন বেশ খানিকক্ষণ। তারপর পরের দিনের প্ল্যান শুনে আমরা সবাই নিদ্রাদেবীর কোলে আশ্রয় নিলাম।

28b87b58-a2d0-4d8d-ba0b-adc166d6757f

দ্বিতীয় দিন

হাওরের বুকে একরাত শান্তির ঘুমের পর, পরদিন সকালে যখন উঠেছি ততক্ষণে বোট ছেড়ে দিয়েছে, গন্তব্য নিলাদ্রী লেক, শিমুল বাগান ও বারিক্কা টিলা। আমরা তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে, রেডি হয়ে ছাদে চলে যাই নাশতার জন্য। খিচুড়ি, ডিম ভুনা আর শেষে চা। এক/দেড়ঘন্টার ভেতরেই আমরা আরেকটা ঘাঁটে পৌঁছে যাই (অন-সিজনে নৌকা নিলাদ্রী লেকের কাছাকাছি গিয়ে নোঙর করে)। সেখান থেকে অটোয় চেপে আমাদের সাইট সিয়িংয়ের জায়গাগুলোতে যেতে হবে। অটো অব্দি যাবার জন্য আমাদের খানিকটা পথ গ্রামের ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতে হলো। শাড়ি তার উপরে জামদানী পরে বেশ বেগ-ই পেতে হয়েছিল আমাকে। ভাগ্যিস জুতা হিসাবে স্নিকার বেছে নিয়েছিলাম। তবে শাড়ি পরাটা বৃথা যায়নি সেটা পরবর্তীতে ছবি দেখে বুঝেছি।

যাইহোক অটো করে প্রায় একঘন্টার জার্নি শেষে আমরা প্রথমে এসে নামি শিমুল বাগানে। বিশাল জায়গাজুড়ে শিমুল বাগান, সারি সারি গাছ, সব এক সমান্তরালে দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে। কিন্তু একটাই আফসোস এই সীজনে একটা গাছেও ফুল নেই। তবে ফুল না থাকলেও বাগানে ঘুরতে ভালো লাগছিল। এরমাঝে কতগুলো বাচ্চাকে দেখলাম ঘোড়া নিয়ে ঘুরছে, যদি কেউ চায় ১০০/- টাকার বিনিময়ে ঘোড়ায় চড়ে শিমুল বাগান দেখতে পারবে। 

92bc0269-ae79-48c5-973e-fb5bbb4137b9

আমরা স্মৃতি হিসেবে ঘোড়ার সাথে ছবি রাখলাম। আর আমার শাড়ির ছবি তুল্লাম শখানেক। শীতের কড়া মধ্যাহ্নে শুষ্ক পরিবেশের মন কেমন করানো শিমুল বাগানকে বিদায় জানিয়ে আমরা আবার অটোয় উঠলাম। এবারের গন্তব্য বারিক্কা টিলা আর যাদুকাটা নদী। পথিমধ্যে ধুলা আর রাস্তার ঝাঁকুনি খেতে খেতে একটু দূরেই থাকা মেঘালয়ের বিশাল পাহাড়রাজি দেখতে দেখতে আগাচ্ছিলাম। বারিক্কাটিলা যেতে বেশি সময় লাগলো না। নেমেই একটা লোকাল দোকান থেকে ড্রিঙ্কো কিনে আমরা দুজন আস্তে আস্তে টিলা বেয়ে উঠতে থাকি। 

কড়া রোদে আর ধুলোয় ক্লান্তি ভর করছিল শরীরে। আমি আর যেতেই চাচ্ছিলাম না! কিন্তু কতদূর যাবার পরই টিলার ওপর থেকে যাদুকাটা নদী আর পাহাড়ের সংমিশ্রণে যে অপূর্ব দৃশ্য দেখলাম, তাতে চোখ এবং মন, দুই-ই জুড়িয়ে গেলো। অদ্ভুত শান্ত নীলচে নদী যাদুকাটা, যার বুক জুড়ে ছোট ছোট নৌকা বয়ে চলছে, তারই ওপাড়ে ভারতের মেঘালয় পাহাড় আর উপরে রৌদ্রোজ্জ্বল আসমানি আকাশ! আহা...সেই সৌন্দর্য লেখার ক্ষমতা আমার হাতে নেই একেবারেই! তাড়া থাকায় আমরা কিছু ছবি তুলে দ্রুত নিচে নেমে আসি। 

8b594c1c-65cc-4fee-8c6a-dcf7d6eeaf38

শেষ গন্তব্য নীলাদ্রি লেকে পৌঁছে যাই একটু বাদেই। নীলাদ্রি লেকে এসে শুনলাম এখানের পানি সারাবছর একইরকম থাকে, কমেও না, বাড়েও না! তাই যথেষ্ট গভীর এখানকার জল, যেটা খালিচোখে দেখে বোঝার উপায় নেই। আমাদের সফরসঙ্গী পরিবারটি লেকের ঠান্ডা পানিতে গোসল সারলো আর আমরা পাড়ে দাঁড়িয়ে লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করে গেলাম। পরিবারের সাথে ভিডিও কলে দৃশ্য দেখালাম আর তারপরই আবার নৌকার উদ্দেশ্যে যাত্রা।

নৌকায় গিয়ে ফ্রেশ হতেই বুঝলাম পেটে ততক্ষণে ইঁদুর দৌড় শুরু হয়ে গিয়েছে। ফ্রেশ হয়ে তাড়াতাড়ি খেতে বসে গেলাম সবাই। হাঁস ভুনা, ছোট মাছের চচ্চড়ি, মাছ ভাজি, সবজি দিয়ে আমাদের ট্যুরের সমাপনী খাবার আয়োজন হলো। এবার তবে ফেরার পালা।

d68e94d3-382a-4bb7-918f-a16fac471d14

নিলাদ্রী লেক, শিমুল বাগান ও বারিক্কা টিলায় নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অতিরিক্ত সময় নিয়ে ফেলায় আমাদের নৌকা ছাড়তে ছাড়তে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায়। সন্ধ্যার আয়োজনে ছিল সবজির পাকোড়া আর চা। ভরপেট খেয়ে সবাই আয়েশ করছিল। অত:পর...চায়ের কাপ হাতে শেষবারের মতোন শীতের হাওরের রূপ অবলোকন করার চেষ্টা হয়তোবা। পানি কমে যাওয়াতে নৌকা চলছিলো এঁকেবেঁকে... বোটের জানালা দিয়ে রাতের হাওরের বুকে চাঁদের প্রতিচ্ছবি, শীতের হিমেল হাওয়া, জলের স্রোত কাটিয়ে যাওয়ার ছলছল শব্দ, হাতে চায়ের কাপ আর ওপাশে প্রিয়জনের মুখ! আর কী লাগে বলুনতো? 

অবশেষে অনেকক্ষণ বাদে আমরা তাহিরপুর বাজারে পৌঁছাই; যদিও ততক্ষণে প্রায় রাত হয়ে গেছে অনেকটাই। তারপর সেখান থেকে বহুকষ্টে একটা সিএনজি যোগাড় করে দ্বিগুণ ভাড়ার বিনিময়ে আমরা সুনামগঞ্জ শহরে পৌঁছাতে সক্ষম হই। তারপর সেই রাতেই সিলেট রওনা করি কারণ পরদিন আমার হবিগঞ্জে যেতেই হবে! 

76901d75-7d02-49c0-8dd6-d8e7c63445d9

এইভাবেই আমাদের একটা জার্নিফুল কিন্তু এঞ্জয়েবল ট্যুর শেষ হয়। অফ-সীজনে যাওয়াতে রাস্তার কষ্ট কিছুটা হলেও ভীড়বাট্টা কম থাকায় আর সবগুলো জায়গা প্রপারলি ঘুরে দেখতে পারায় সেই শরীরের কষ্ট আর খুব বেশি মনে থাকেনি আমাদের। এখন তো সেই ট্যুরের সুন্দর ছবিগুলো দেখেই সময়টুকু রোমন্থন করছি। চাইলে প্রিয়জনকে সাথে নিয়ে কিংবা পরিবার নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন জল আর পাহাড়ে ঘেরা সুনামগঞ্জ থেকে। 

লেখক: মেডিকেল অফিসার, লাখাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

এনএম