জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
২৮ নভেম্বর ২০২২, ০৭:২২ পিএম
দেশের ব্যাংকগুলোতে অর্থ কেলেঙ্কারির বিষয়ে ইঙ্গিত করে হাইকোর্ট বলেছেন, সব ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। আমরা কি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখব। এটা কি হয়? এসব অর্থ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যা করছে, তাতে মনে হয়- আমরা যেন নাটক দেখছি। হাততালি ছাড়া আর কি আছে, না হয় বসে থাকতে হবে।
সোমবার (২৮ নভেম্বর) আলোচিত বেসিক ব্যাংকের অর্থপাচারের মামলার আসামি মোহাম্মদ আলীর জামিন প্রশ্নে জারি করা রুল শুনানির সময় বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এমন মন্তব্য করেন। পরে আদালত দুদকের পক্ষের বক্তব্য শুনতে এবং এ বিষয়ে রায়ের জন্য আগামীকাল মঙ্গলবার (২৯ নভেম্বর) দিন ধার্য করেন।
এ দিন আদালতে মোহাম্মদ আলীর পক্ষে শুনানি করেন মো. জোবায়দুর রহমান। এছাড়া দুদকের পক্ষে ছিলেন খুরশীদ আলম খান। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক।
>> আরও পড়ুন: ইসলামী ব্যাংকে ‘ভয়ংকর নভেম্বর’: ব্যবস্থা নিতে আইনজীবীদের চিঠি
শুনানির সময় আইনজীবী মো. জোবায়দুর রহমান আদালতকে বলেন, পাঁচ বছর পার হয়ে গেলেও দুদক মামলার চার্জশিট দিচ্ছে না। বিচারও শেষ হচ্ছে না। আমার মক্কেল মাত্র একজন। কেরানি হিসেবে কাজ করেছেন। এখানে তার অপরাধ কি, দুদক সেটিও সুনির্দিষ্ট করতে পারেনি। মামলায় টাকা ও সম্পদের যে বিবরণ এসেছে, সেখানে আমার মক্কেলের নিয়ন্ত্রণে কিছুই ছিল না। এখানে বিশ্বাস ভঙ্গেরও কিছু ছিল না।
জোবায়দুর রহমান বলেন, দুদক দৌড়ায় টাকার পেছনে, দুদক নিজেই দুর্নীতিগ্রস্ত। আমার মক্কেলের বিরুদ্ধে অপরাধ কি সেটিই দুদক শনাক্ত করতে পারেনি। এ মামলায় এখনও ১০৪ জন আসামি ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। অথচ আমার মক্কেল ২০১৯ সাল থেকে কারাগারে আছেন।
এ সময় হাইকোর্ট বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি বলেন, আমরা তো মনে হয় নাটক দেখছি। নাটক দেখে হাততালি ছাড়া আর তো কিছু দেওয়ার সেই। হয় হাততালি দিতে হবে, না হলে বসে থাকতে হবে।
>> আরও পড়ুন: রাঘব বোয়ালদের নয়, চুনোপুঁটিদের নিয়ে ব্যস্ত দুদক: হাইকোর্ট
বিচারপতি বলেন, জজ, আইনজীবী আর যে লাখ লাখ চোখ চেয়ে আছে। কেউ কোনো কাজ করতে পারছেন না। কেন সবাই নীরব। সব ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে, আমরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখব?
এ সময় বিচারকের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী বলেন, দুদক ড্রামা (নাটক) করছে। আমার বলার কিছু ছিল না।
পরে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান আদালতের এসে নিজ বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য সময়ের আবেদন করেন। এরপর আদালত আগামীকাল মঙ্গলবার দুদকের আইনজীবীর বক্তব্য শেষে এ বিষয়ে রায়ের দিন ঠিক করেন।
এর আগে গতকাল সোমবার (২৭ নভেম্বর) বেসিক ব্যাংকের দুই হাজার ৭৭ কোটি আত্মসাতের ঘটনায় আলামত চেয়ে মালয়েশিয়ায় অনুরোধ পাঠানো হয়ে জানিয়ে হাইকোর্টে একটি প্রতিবেদন দাখিল করে দুদক। ওই প্রতিবেদন দুদক জানায়, পারস্পরিক আইনি সহায়তা চুক্তির (এমএলএআর) আওতায় মালয়েশিয়ায় এই অনুরোধ পাঠানো হয়েছে।
>> আরও পড়ুন: এনজিওগুলো দাদন ব্যবসায়ীর মতো আচরণ করছে: হাইকোর্ট
অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনায় দায়ের করা ৫৬ মামলার মধ্যে ১২ মামলার আসামি ছাড়াও ব্যাংকটির সাবেক কর্মকর্তা মোহম্মদ আলীর জামিন শুনানিতে গত ৮ নভেম্বর হালনাগাদ তথ্য চেয়েছিলেন হাইকোর্ট। সেই অনুসারে ওই প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।
আত্মসাৎ করা অর্থের বিষয়ে মামলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেসিক ব্যাংক লিমিটেডের বিভিন্ন শাখা থেকে প্রায় দুই হাজার ৭৭ কোটি ৩৪ লাখ দুই হাজার নয়শত ৯১ টাকা (সুদসহ ২ হাজার পাঁচশত ৯০ কোটি ৪৯ লাখ ৯১ হাজার ৪৫৩ টাকা) আত্মসাতের ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশন প্রাথমিক অনুসন্ধান করে মোট ৫৬টি মামলা দায়ের করেছে।
দুদকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মামলাগুলো দীর্ঘদিন ধরে তদন্তাধীন আছে। মামলার তদন্ত দীর্ঘায়িত হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হলো- আত্মসাৎকৃত অর্থ সম্পূর্ণরূপে নগদে উত্তোলনের মাধ্যমে টাকার অবস্থান গোপন করা হয়েছে। এতে মামলায় গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের শনাক্তকরণ ও তাদের জবানবন্দি গ্রহণও (১৬১ ধারায়) কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এছাড়া সব সাক্ষীদের কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।
>> আরও পড়ুন: কারাগারেই থাকতে হচ্ছে সেই স্মৃতিকে
ফলে বর্ণিত মামলায় আলামত প্রচুর এবং ব্যাংকের বিশাল পরিমাণ কাগজপত্র থেকে প্রকৃত সব আলামত শনাক্ত করাও সময়সাধ্য। এছাড়া প্রকৃত আসামিদের শনাক্ত করার প্রক্রিয়াটিও এই মামলায় বেশ জটিল। পাশাপাশি মামলার প্রয়োজনীয় আলামত সংগ্রহের জন্য মালয়েশিয়ায় এমএলএআর করা হয়েছে। সে সংক্রান্ত প্রতিবেদন ও আলামতও এখনো পাওয়া যায়নি।
প্রতিবেদনে দুদক দাবি করে, মামলাগুলোর আগের তদন্তকারী কর্মকর্তারা বদলীসূত্রে অন্যত্র চলে যাওয়ায় একাধিকবার তদন্তকারী কর্মকর্তাও পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে মামলাগুলোর তদন্তকাজ এগিয়ে চলছে। আসামি ও আলামত শনাক্ত করা, সাক্ষীদের জবানবন্দি গ্রহণ করা ও এমএলএআর এর প্রেক্ষিতে বিদেশ থেকে মামলার প্রয়োজনীয় আলামত পাওয়া সাপেক্ষে এবং প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে যথাসম্ভব দ্রুততম সময়ের মধ্যে সব মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হবে।
আলোচিত এসব মামলায় ৮২ জন ঋণগ্রহীতা ছাড়াও বেসিক ব্যাংকের তৎকালীন এমডি কাজী ফকরুল ইসলাম, ডিএমডি ফজলুস সোবহান, সাবেক ডিএমডি শেখ মঞ্জুর মোরশেদ, জিএম এ. মোনায়েম খান, জিএম মোহাম্মদ আলী ওরফে মোহাম্মদ আলী চৌধুরীসহ ব্যাংকের ২৭ জন কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে। এরমধ্যে বেসিক ব্যাংকের গুলশান শাখা, প্রিন্সিপাল/প্রধান শাখা, দিলকুশা শাখা এবং শান্তিনগর শাখাসহ মোট চারটি শাখার ঋণ কেলেঙ্কারির বিষয়ে গুলশান থানায় ২৩টি, মতিঝিল থানায় ১২টি এবং পল্টন থানায় ২১টিসহ মোট ৫৬টি মামলা করা হয়। এছাড়া মামলার আসামিদের মধ্যে বেসিক ব্যাংক কর্মকর্তা ২৭ জন, ব্যবসায়ী ৮২ জন এবং বেসরকারি সার্ভেয়ার ১১ জনসহ মোট ১২০ জনকে আসামি করা হয়। এরমধ্যে ১৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং আত্মসমর্পণ করেছেন একজন। আর সবমিলিয়ে ৫৬ মামলায় এখন পর্যন্ত আত্মসাৎকৃত অর্থের মধ্যে ১১৫ দশমিক ৭৮ কোটি টাকা উদ্ধার করে ব্যাংকে জমা করা হয়েছে।
এআইএম/আইএইচ