images

আইন-আদালত

এবিএম খায়রুল হকের যত কুকীর্তি ও বিতর্কিত রায়

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক

২৪ জুলাই ২০২৫, ১২:৪৭ পিএম

অবশেষে ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন বিচার বিভাগ নিয়ে সমালোচিত-বিতকির্ত নিন্দীত সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গা ঢাকা দেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ধ্বংসের মূল কারিগর খ্যাত এই বিচারপতি। বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) সকালে ধানমন্ডির একটি বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে দায়ের করা আছে তিনটি মামলা।  

গুঞ্জন ছিল রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অবৈধভাবে ভারতে চলে গেছেন খায়রুল হক। সেখানেই নিরাপদে আছেন দেশের বিচারব্যবস্থা ও গণতন্ত্র ধ্বংসের এই কারিগর। এমনটিও শোনা গেছে যে তিনি ভারত থেকে তিনি ব্রিটিশ পাসপোর্ট ব্যবহার করে ইংল্যান্ডে গেছেন। সেখানে মেয়ের কাছে অবস্থান করছেন। আবার অনেকে বলেছেন, স্বাস্থ্যগত কারণে তিনি কোথাও ট্রাভেল করছেন না। দেশেই অবস্থান করছেন তিনি। অবশেষে দেশেই পাওয়া গেল তাকে, হলেন গ্রেফতার।

খায়রুল হকের যথোপযুক্ত বিচার চান তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বাদি

বিচারক হিসেবে লোভের বশবর্তী হয়ে দুর্নীতিমূলক, বিদ্বেষাত্মক এবং বেআইনিভাবে রায় দেওয়াসহ অসত্য ও জাল-জালিয়াতিমূলক রায়ের অপরাধের অভিযোগে খায়রুল হকের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরকারী আইনজীবী মুজাহিদুল ইসলাম শাহীন ঢাকা মেইলকে বলেন, দেরিতে হলেও গ্রেফতার করা হয়েছে। তার যথোপযুক্ত বিচার করা হোক।

গত ২৭ আগস্ট রাতে রাজধানীর শাহবাগ থাকায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মুজাহিদুল ইসলাম শাহীন এ মামলা দায়ের করেন। আসামি খাইরুল হকের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২১৯ ও ৪৬৬ ধারায় মামলাটি দায়ের করা হয়েছে।

এদিকে, গত ২৬ আগস্ট নারায়ণগঞ্জে সাবেক প্রধান বিচারপতি ও সদ্য পদত্যাগ করা আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এ বি এম খায়রুল হকের বিরুদ্ধে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় পরিবর্তন ও জালিয়াতির অভিযোগে আরেকটি মামলা হয়েছে। ফতুল্লা মডেল থানায় ২০২৪ সালের আগষ্ট মাসে মামলাটি দায়ের করেন অ্যাডভোকেট আব্দুল বারী ভূঁইয়া। 

০২৪ সালের ২৬ আগষ্ট এই বিচারপতির বিরুদ্ধে জালজালিয়াতি করে রায় প্রদান ও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে নারায়ণগঞ্জে আরও একটি মামলা করেন নুরুল ইসলাম মোল্লা। 

মামলায় বিশ্বাসভঙ্গ করে প্রতারণা ও জালজালিয়াতি করে রায় দেওয়ায় রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়। মামলার বাদী নুরুল ইসলাম রারায়য়ণগঞ্জ বন্দর থানার মদনপুর এলাকার বাসিন্দা। তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন।
 
এবিএম খায়রুল হকের যত কুকীর্তি

আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে খায়রুল হক ছিলেন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান। মেয়াদ শেষ হওয়ার পর একাধিকবার গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন খায়রুল হক। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন ঘটলে ১৩ আগস্ট তিনি আইন কমিশন থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর তাকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। বিচারাঙ্গণে তুমুলভাবে আলোচিত-সমালোচিত এই বিচারপতির বেশ কয়েকটি রায় চরম বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল।
তিনি নিজে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নানাভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত হয়েছেন। তাকে প্রধান বিচারপতি করা হয়েছিল কয়েকজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে ডিঙিয়ে। প্রধান বিচারপতি থাকাকালে ত্রাণ তহবিলের টাকা গ্রহণ করে নিজের চিকিৎসা করে সমালোচিত হয়েছিলেন। অবসর গ্রহণ করার কয়েকদিন আগে তিনি ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেন। এতে দেশে রাজনৈতিক সংঘাতের পথ উন্মুক্ত হয়। পাশাপাশি শেখ হাসিনার ভোট ডাকাতির চূড়ান্ত সুযোগ তৈরি হয়। রাজনৈতিক একটি বিষয়কে আদালতের আওতাধীন করে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক নন বলে রায় দিয়েছিলেন তিনি।

এছাড়া বিতর্কিত একাধিক বিচারপতিকে শপথ পড়ানো, আগাম জামিনের এখতিয়ার কেড়ে নেওয়া, খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা এবং ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর গত ১৮ আগস্ট ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য ইমরুল হাসান বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা করেন।

মামলায় খায়রুল হকের বিরুদ্ধে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় পরিবর্তন এবং জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয়। ২৮ আগস্ট দুর্নীতি ও রায় জালিয়াতির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা করেন আরেক আইনজীবী। এর আগে ২৫ আগস্ট খায়রুল হকের বিরুদ্ধে একই বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানায় আরেকটি মামলা হয়।

খায়রুল হকের গ্রেফতার নিয়ে যা বলছেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ

নানাভাবে আলোচিত সমালোচিত বিতর্কিত সাবেক এই বিচারপতিকে গ্রেফতারের পর অনেকেই তার অপরাধের সঠিক বিচার চাইছেন। জাতি তার বিচার দেখতে চায় এমন প্রত্যাশা জানিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামির আমির ড. শফিকুর রহমান তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে একটি পোষ্ট দিয়েছেন। এতে তিনি লিখেছেন, ‘অপেক্ষায় রইলাম...এবিএম খাইরুল হক ফ্যাসিস্ট আমলে প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে ছিলেন। নাহ, কোনোমতেই তিনি তার দায়িত্বের মর্যাদা উপলব্ধি করেননি এবং আমানত রক্ষা করেননি। এই মর্যাদাপূর্ণ চেয়ারে বসে ইতিপূর্বে কেউ দেশ ও জাতির এত বড় ক্ষতি করেনি। তার হঠকারী রায়ের মাধ্যমে রাজনৈতিক মাফিয়াদের হাতে গুম, খুন, লুণ্ঠনসহ সকল অপকর্মের লাইসেন্স ও হাতিয়ার তুলে দেওয়া হয়েছিল। তাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেরিতে হলেও পাকড়াও করেছে। জাতি এখন তার সুষ্ঠু বিচার এবং ন্যায্য শাস্তি দেখতে চায়। তার ক্ষেত্রে আমরা শুধু ন্যায়বিচারই প্রত্যাশা করি। ন্যায়বিচারেই তিনি ইতিহাসের শিক্ষণীয় শাস্তি পাওয়ার উপযুক্ত হবেন — এই আশাই রাখি।’

বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীদের সংগঠন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী গাজী কামরুল ইসলাম সজল তার ফেসবুক পোষ্টে খায়রুল হককে ফ্যাসিস্ট উল্লেখ করে বাকি আরও দুই প্রধান বিচারপতির গ্রেফতারের প্রত্যাশা করেন। ফেসবুকের পোস্টে তিনি লেখেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো প্রধান বিচারপতি গ্রেফতার হলেন,আরো সাবেক ২/১জন প্রধান বিচারপতি  গ্রেফতারের অপেক্ষায়। ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে খুশি করাই ছিলো খায়রুল, শাহীনসহ বাকি তিনজনের কাজ।’

দেশের ১৯-তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে এবিএম খায়রুল হক শপথ নেন ২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। পরের বছর (২০১১ সাল) ১৭ মে ৬৭ বছর পূর্ণ হওয়ায় তিনি অবসর গ্রহণ করেন।

এআইএম/ইএ