images

আইন-আদালত

মামলা জটে বিপর্যস্ত বিচার বিভাগ, নথি সংরক্ষণে হিমশিম

আমিনুল ইসলাম মল্লিক

০৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:৪৫ পিএম

মামলা জটে দীর্ঘদিন ধরেই ধুঁকছে বিচার বিভাগ। সম্প্রতি সেই সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। দিন দিন মামলার সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। সেই তুলনায় বিচারকসহ অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংকট রয়েছে। রাজনৈতিকসহ নানা কারণে মামলার সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বিচারাঙ্গন। বিশেষ করে মামলার নথির স্তূপ দিন দিন বাড়ছেই। এসব নথি সামাল দিতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।  

মামলার সংখ্যা যেন না বাড়ে এ ব্যাপারে কিছু উদ্যোগও ইতোমধ্যে নেওয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও মামলার সংখ্যা বৃদ্ধির হার কমানো যাচ্ছে না। মামলার সংখ্যা কীভাবে কমানো যায়, মামলা নিষ্পত্তিতে কীভাবে আরও গতি আনা যায় এবং আম-জনতার বিচারপ্রাপ্তি নিশ্চিতে বিকল্প ও কার্যকরী কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় সে ব্যাপারে জরুরি ভিত্তিতে ভাবার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।  

সংশ্লিষ্টরা জানান, যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া না মেনে ঠুনকো অভিযোগেই মামলা হচ্ছে দিনের পর দিন। সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ঘটনায় মামলা তো আছেই। ঘটনার যাচাই-বাছাই না করে মামলার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় মামলা জট শুধু বাড়ছেই।

এদিকে মামলার মেরিট ও আইনি যৌক্তিকতা না থাকার পরেও উচ্চ আদালতের দিকে দৌড়াচ্ছেন অনেকেই। আবার যুক্তি ছাড়া জনস্বার্থের নামেও করা হচ্ছে শত শত মামলা। এসব ঘটনায় বিরক্ত হয়ে সংশ্লিষ্ট অনেককেই জরিমানাও করছেন আদালত। তারপরেও মামলা করা বন্ধ হচ্ছে না। কেউ মিথ্যা মামলা দিয়ে মানুষকে হয়রানি করছে বলেও অভিযোগ আছে।

মামলা জটে ফাইল সংরক্ষণে হিমশিম

সুপ্রিম কোর্ট ও ঢাকা জজ কোর্টে সরেজমিনে গিয়ে মামলা জটের ভয়াবহ চিত্র দেখা গেছে। মামলা জটের কারণে ঢাকার আদালতগুলোতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে মামলার ফাইল। মামলার নথিতে ঠাসা এজলাসের ডায়াসসহ আশপাশের এলাকা। সামনে এগিয়ে বিচারকের আসনে চোখ পড়লে দেখা যায়, বসার জায়গাটি ঢেকে গেছে মামলার নথিতে। আসনের সামনে, ডানে, বামে ও পেছনে বিচারাধীন মামলার নথির স্তূপ।

আরও পড়ুন

৩৫ লাখ মামলা নিষ্পত্তিতে ২ হাজার বিচারক!

একই অবস্থা ঢাকা মহানগর দায়রা আদালতে। ভবনের দোতলার পশ্চিম পাশের বাঁ দিকে একটি শৌচাগার রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, মামলার এতই চাপ, কয়েক বছর ধরে এই শৌচাগারটিকেই রেকর্ডরুম বানাতে হয়েছে। আদালত সংশ্লিষ্ট কর্মচারীরা-আইনজীবী-বিচারপ্রার্থীরা বলছেন, এমন অবস্থা অনেক আদালতে। অনেক সময় দৃষ্টিকটু দেখাবে বলে নথিগুলো কোনো মতে আড়াল করা হয়। এটাই আদালত পাড়ার বাস্তবতা।

কোন আদালতে কত মামলার জট

সুপ্রিম কোর্ট থেকে পাওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, উচ্চ ও অধস্তন আদালতে বিচারাধীন বা অনিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার ৫১০টি। একে তো লাখ লাখ মামলার চাপ, অন্যদিকে আদালতজুড়ে থাকা হাজার হাজার নথি সংরক্ষণে নেই সুরক্ষিত জায়গা। ফলে বাস্তবতা হলো, ব্যাপক হারে মামলা নিষ্পত্তি হলেও বিচারাধীন মামলা শুধুই বাড়ছে।

Case2

তথ্য অনুযায়ী, সুপ্রিম কোর্ট ও অধস্তন আদালতে বিচারাধীন বা অনিষ্পন্ন ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার ৫১০ মামলার মধ্যে দেওয়ানি মামলা ১৭ লাখ ২১ হাজার ২৬৬। ফৌজদারি মামলা ২৫ লাখ ৮৯ হাজার ৬৪৩ এবং অন্যান্য এক লাখ ৩২ হাজার ৬০১টি।

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন মামলা ছয় লাখ ছয় হাজার ১৮১। এর মধ্যে আপিল বিভাগে দেওয়ানি মামলা বিচারাধীন ১৭ হাজার ৯৮৯টি। ফৌজদারি ১০ হাজার ৭১৫টি এবং কনটেম্পট (আদালত অবমাননা) ১৯৭ মামলাসহ বিচারাধীন ২৮ হাজার ৯০১টি। হাইকোর্টে দেওয়ানি ৯৭ হাজার ৪৭৫, ফৌজদারি তিন লাখ ৪৭ হাজার ৪০১ ও রিট মামলা এক লাখ ৩২ হাজার ৪০৪-সহ বিচারাধীন পাঁচ লাখ ৭৭ হাজার ২৮০। অন্যদিকে অধস্তন আদালতে বিচারাধীন ৩৮ লাখ ৩৭ হাজার ৩২৯টি মামলা। এর মধ্যে দেওয়ানি ১৬ লাখ পাঁচ হাজার ৮০২ এবং ২২ লাখ ৩১ হাজার ৫২৭ ফৌজদারি মামলা বিচারাধীন।

আরও পড়ুন

বছরের অর্ধেক সময়ই বন্ধ, মামলা জট কমবে কীভাবে?

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার আদালত এলাকায় দেওয়ানি, ফৌজদারি ও অন্যান্য মামলার প্রায় দেড়শ আদালত রয়েছে। ঢাকা মহানগর দায়রা আদালতের কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, মহানগর দায়রা আদালতের অধীন ২৪টি ফৌজদারি আদালতে এখন বিচারাধীন মামলা এক লাখ ৬০ হাজার ৭২৪। তবে এত মামলার নথি রাখার মতো রেকর্ডরুম নেই।

হাইকোর্টেও মামলার স্তূপ

হাইকোর্টের অ্যানেক্স ভবন, মূল ভবনসহ অন্তত ১৫-২০টি আদালত (বেঞ্চ) ঘুরে দেখা গেছে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অনেক আদালতের এজলাস ও তার আশপাশে মামলার নথিতে ভরে গেছে। বিশেষ করে রিট শাখায় গিয়ে এর বাস্তবতা বোঝা যায়। একেকটি বেঞ্চে দুই থেকে পাঁচটি বা তার বেশি স্টিলের আলমারি বা র‌্যাক রয়েছে নথি সংরক্ষণের জন্য। কিন্তু মামলার চাপে নথি রাখতে হয় বেঞ্চ কর্মকর্তাদের টেবিলের ওপর ও নিচে। কখনো কখনো বিচারপতিরা যেখানে বসেন, তার আশপাশেও।

আদালত-সংশ্লিষ্ট কর্মচারীরা বলেন, বেঞ্চগুলোর নিজস্ব কোনো রেকর্ডরুম নেই। আইনজীবীদের মেনশন স্লিপের পর সংশ্লিষ্ট শাখা বা রেকর্ডরুম থেকে মামলার নথি আনতে হয়। মামলার চাপে রেকর্ডরুমেও এখন জায়গার সংকুলান হচ্ছে না।

মামলা জট কমাতে ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানিয়েছেন আইন মন্ত্রণালয়েল সিনিয়র জনসংযোগ কর্মকর্তা ড. রেজাউল করিম। তিনি জানান, ম্যানেজমেন্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিচারকদের দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) চালু করা হয়েছে।

আইনজ্ঞরা যা বলছেন

মামলার জট প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ব্যারিস্টার এবিএম আলতাফ হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, মামলাজট নিরসনে মূল সমস্যা হলো বিচারক সংকট। সিস্টেমের দুর্বলতা। কথায় কথায় মানুষের মামলা করার প্রবণতা। যেকোনো ছোট-খাটো বিষয়ে ঝামেলা হলেই এখন মানুষ হাইকোর্টে আসে। মামলা চলবে কি না সেটি বাছাই না করে হাইকোর্টে চলে আসে মানুষ। গ্রাউন্ড দেখে মামলা করা উচিত। এত এত মামলা থাকার পরেও বিচারকরা কাজ করে যাচ্ছেন নিয়মিতভাবে।

Case3

বিচারকদের কাজে অলসতা নেই উল্লেখ করে এই আইনজ্ঞ বলেন, বাংলাদেশের বিচারকরা যথেষ্ট পরিশ্রম করেন। সকাল সাড়ে দশটা থেকে শুরু করে বিকেল ৫টা পর্যন্ত বিচারিক কাজ করেন। দুপুরে এক ঘণ্টার বিরতির পর আবারও তারা কাজে মনোযোগ দেন। কাজের দিক থেকে তারা কম করেন না। আসলে আমাদের দেশে মামলার ফাইল হয় বেশি। মামলা জট থেকে বেরিয়ে আসতে হলে বিচারক নিয়োগ দিতে হবে বেশি করে। বিচারক সংখ্যা বাড়াতে হবে। তাহলে সমস্যার সমাধান হবে।

মামলার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারপতি নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মেইল বলেন, আমাদের দেশে মামলার বিচারিক ধাপ বেশি। পৃথিবীর কোনো দেশে এরকম প্রক্রিয়া নেই। সহকারী জজ, সিনিয়র সহকারী জজ, যুগ্ম জেলা জজ, জেলা জজ, হাইকোর্ট বিভাগ, আপিল বিভাগ, মামলার রায়ের রিভিউ। এতগুলো ধাপ পার করতে যুগ যুগ সময় লেগে যায় মামলা নিষ্পত্তি করতে। পৃথিবীর কোথাও নেই এত ট্রায়াল (বিচার)।

আরও পড়ুন

বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি মানলে কমবে মামলা জট

এই বিচারপতি বলেন, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) পদ্ধতি আমাদের দেশে খুব একটা কাজ দেয় না। এতে মামলার জট কমছে না। কারণ এডিআরের সিদ্ধান্ত ম্যান্ডাটোরি (বাধ্যতামূলক) না। এডিআরের পরেও বিচারপ্রার্থীরা কোর্টে ফিরে আসতে পারেন।

হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘জনস্বার্থের মামলার দরজাটা যখন ওপেন হয়েছে তখন থেকেই আমি বলে আসছি এর মধ্যে দিয়ে জনস্বার্থবিরোধী কাজকর্ম হতে পারে। এ ব্যাপারে আদালতকে সচেতন হতে হবে। আমরা গত কয়েক বছর ধরে বিষয়টি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। অনেক জনস্বার্থের মামলায় এখানে ব্যক্তিস্বার্থ ঢুকছে। আবার অনেকেই জনস্বার্থের মামলা পাবলিসিটি মামলা হিসেবে নিচ্ছেন। অনেক আইনজীবী জনস্বার্থের মামলা নামে লিগ্যাল নোটিশ দিচ্ছেন। কিন্তু পত্র-পত্রিকায় নিউজ আসার পর আর কোনো মামলা করছেন না। অনেকে রিট পিটিশন ফাইল করছেন, কিন্তু শুনানি করছেন না। যেহেতু এগুলো গ্রহণযোগ্যতা নাই তাই এগুলো আদালত তো খারিজ করবেই। এজন্য মামলাকারীরা শুনানির উদ্যোগ নেন না।’

এই আইনজীবী বলেন, ‘ইতোমধ্যে এ বিষয়ে আদালত দুই একজনকে ফাইনও করেছে। তারপরেও এটি কমছে না। কারণ এই মামলাগুলো করলে পাবলিসিটি পাওয়া যায়। এটা নিয়ে মিডিয়ারও দায়িত্ব আছে। সব মামলা কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকে না। সবাই যদি সচেতন হয় তাহলে এর প্রভাব পড়বে। কারণ এসব মামলা করাই হচ্ছে প্রচারের জন্য। জনস্বার্থের নামে এসব মামলা করা হচ্ছে প্রচারের জন্য আদালতের ভাবমূর্তি নষ্টের জন্য। জনস্বার্থের মামলা যেন কোনোভাবেই ব্যক্তি স্বার্থে বা প্রচারের জন্য না করা হয়।’

বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সারাদেশে আমাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রায় এক লাখ ৮৫ লাখ মামলা করেছিল। এসব মামলার অধিকাংশই মিথ্যা ও যড়যন্ত্রমূলক। আর এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে প্রায় ৪০ লাখ নেতাকর্মীকে। দেশের আদালতপাড়ায় মামলা জট হওয়ার পেছনে এটিও একটি কারণ।’

এআইএম/জেবি