সম্পত্তি ও অফিস সংক্রান্ত মামলায় আদালতের বাইরে গিয়ে উভয়পক্ষ বসে মীমাংসার জন্য যে উদ্যোগ নেওয়া হয় সেটি হচ্ছে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর)। এটি একটি আইনগত প্রক্রিয়া। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি আইন ঠিকভাবে প্রয়োগ হলে আদালতে বিচারাধীন পাহাড়সম মামলাজট কমে আসবে বলে আইনজ্ঞদের ধারণা।
এডিআর হলো এমন একটা পদ্ধতি, যার মাধ্যমে মধ্যস্থতাকারী ব্যক্তির উপস্থিতিতে আদালতের ভেতরে বা বাইরে বসেও বিরোধ নিষ্পত্তি করা যায়। এডিআরের মাধ্যমে একটি মামলা নিষ্পত্তি হতে সময় লাগে ৯০ দিন। উকিলের খরচ লাগে না বললেই চলে। এতে উভয়পক্ষই লাভবান হয়। যদি কোনো মামলা এডিআরের মাধ্যমে নিষ্পত্তি না হয়, তাহলে মামলাটি আদালতে চলে যায়। অন্যদিকে বিচারিক প্রক্রিয়ায় একটি মামলা শেষ হতে দীর্ঘ সময় লাগে। এতে প্রচুর অর্থও অপচয় হয়।
বিজ্ঞাপন
মামলা দ্রুত নিস্পত্তির জন্য বিশ্বব্যাপী এডিআর পদ্ধতির গুরুত্ব বাড়ছে। বাংলাদেশ সরকারও এডিআর পদ্ধতির ওপর গুরুত্বারোপ করেছে।
বর্তমানে দেশে প্রায় ৩৭ লাখ মামলা বিচারাধীন। এসব মামলা নিস্পত্তিতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি সঠিকভাবে মামলে আদালতের ওপর মামলার চাপ কমবে এবং মামলাজটও কমে আসবে বলে মনে করেন সাবেক বিচারপতি ব্যারিস্টার এবিএম আলতাফ হোসেন।
ঢাকা মেইলকে আলতাফ হোসেন বলেন, মামলাজট কমানোর চিন্তা থেকেই সরকার বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি আইন করেছে। সিভিলের ক্ষেত্রে এ আইন সব মামলায় পালনের বিধান আছে। প্রত্যেক জেলা জজ একটি তালিকা করে রেখেছেন তারা বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কাজ করবেন। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি আইন মানলে মামলাজট কমবে, ভোগান্তি কমবে বিচারপ্রার্থীদের।
দেওয়ানী কার্যবিধি-১৯০৮ (সংশোধন) আইন-২০০৩-এর মাধ্যমে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য দেওয়ানী কার্যবিধির (১৯০৮) ৮৯এ, ৮৯বি ও ৮৯সি ধারাগুলোকে অর্থঋণ আদালত আইনের (২০০৩) অধীনের মামলা ছাড়া সব ধরনের দেওয়ানী মামলার ক্ষেত্রে কার্যকর করা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-এ বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি সংক্রান্ত কোনো বিধান নেই। কিন্তু ধারা ৩৪৫-এ বর্ণিত আপসযোগ্য তুচ্ছ অপরাধের একটি তালিকা বর্ণনা করা হয়েছে।
অর্থঋণ আদালত আইন-২০০৩ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ পুনরুদ্ধারের জন্য এবং দেনা-পাওনাদারের মধ্যকার বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বাংলাদেশে অর্থঋণ আদালত আইন ২০০৩-এর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আগে ঋণ পুনরুদ্ধার সংক্রান্ত মামলাগুলো দেওয়ানি আদালতের এখতিয়ারভুক্ত ছিল। সম্প্রতি অর্থঋণ আদালত আইন ২০০৩, ১৬ নং আইন দ্বারা সংশোধন করা হয়েছে, যা অর্থঋণ আদালত (সংশোধন) আইন ২০১০ নামে পরিচিত।
সংশোধনের অন্তর্ভুক্ত বিকল্প পদ্ধতি সম্পর্কিত ধারাগুলো হলো যথাক্রমে-২২, ২৩ ও ২৫, যা বিরোধ স্থাপনের জন্য মধ্যস্থতা, সালিশি বা নিষ্পত্তির সম্মেলনে এবং উচ্চতর দাবির জন্য নিষ্পত্তির প্রতিকার প্রতিবেদন অনুমোদনে কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে। সালিশ আইন-২০০১ সম্প্রতি বাংলাদেশে সালিস আইন ২০০১ (আরবিট্রেশন অ্যাক্ট) প্রণয়ন করা হয়েছে।
(প্রটোকল এবং কনভেনশন) আইন ১৯৩৭ এবং সালিস আইন ১৯৪০ রদের মধ্য দিয়ে এই সালিশ আইন ২০০১, ১০ এপ্রিল ২০০১ থেকে কার্যকর করা হয়েছে। এ আইনটির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক সালিশ, বিদেশি সালিশি রোয়েদাদ এবং অন্যান্য সালিশ সম্পর্কিত আইনগুলোকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে।
নতুন আইনটি আবার ২০০৪ সালে নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক ক্ষেত্রবিশেষে সংশোধন করা হয়েছে। যদিও এই নতুন আইনটি প্রধানত ইউনিসিট্রাল মডেল আইনের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে, তথাপিও এ আইনটির কিছুসংখ্যক নীতিমালা সংযুক্ত করা হয়েছে ভারতীয় সালিশ ও সমঝোতা আইন ১৯৯৬ এবং ইংলিশ সালিশ আইন ১৯৯৬ থেকে।
২০০৬ সাল থেকে গ্রাম আদালত আইন ২০০৬ প্রণয়ন করা হয়েছে। এ আইনটি মূলত বাংলাদেশের গ্রাম এলাকার বিরোধ এবং বেআইনি কার্যক্রম সমাধানের জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে।
২০০৬ সাল থেকেই এই আইন উপযুক্তভাবে কার্যরত রয়েছে এবং বাংলাদেশের বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থার উন্নয়ন বিকাশের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। যদি যেকোনো প্রকার দ্বন্দ্ব, দেওয়ানি বা অপরাধমূলক এই আইনের আওতার মধ্যে আসে, তবে তা অবশ্যই গ্রাম আদালতের মাধ্যমে মোকাবিলা করতে হবে।
গ্রাম আদালতটি পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট হতে হবে, যাদের মধ্যে একজন চেয়ারম্যান হবেন, যিনি গ্রাম আদালতের সভাপতিত্ব করবেন। প্রতিটি দল দুজন সদস্য নির্বাচন করবে, যাদের মধ্য থেকে একজন অবশ্যই ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হবেন।
বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ শ্রম আইনটি পদ কর্মসংস্থানের এবং অবস্থার সিদ্ধান্ত। যা শ্রমিক ও ব্যবস্থাপনা দ্বারা ক্রমাগত প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ এবং শাসন করার জন্য বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এ মধ্যস্থতা, মীমাংসা এবং সালিশি পদ্ধতির বর্ণনা করা হয়েছে।
বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি সম্পর্কিত অন্য বিধিবদ্ধ বিধানগুলো বর্ণনা করা হয়েছে- চুক্তি আইন ১৮৭২-এর ধারা ২৮ এবং নির্দিষ্ট ত্রাণ আইন ১৮৭৭-এর ধারা ২১ (সালিশি সংক্রান্ত বিধান রয়েছে) আইনগুলোতে। উল্লিখিত বিভিন্ন আইনের বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিসংক্রান্ত বিধানগুলোর মাধ্যমে আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষের ন্যায়বিচারের দ্বার উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এসব আইনের বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিসংক্রান্ত বিধানগুলোর মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তিকরণ প্রক্রিয়াকে স্বল্প সময়ে এবং কম খরচে মানুষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। তাই বলা যায়, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিসংক্রান্ত বিধানগুলোর মাধ্যমে ন্যায়বিচার, দরিদ্র কিংবা ধনী সবার জন্য নিশ্চিত করা হয়েছে।
এআইএম/এমআর