মামলার ভারে জর্জরিত আদালতে প্রতিদিনই জমা হচ্ছে নতুন নতুন মামলা। বর্তমানে দেশে প্রায় ৩৫ লাখ মামলা বিচারাধীন। পাহাড়সহ এসব মামলার তুলনায় বিচারক সংখ্যা খুবই কম। সবমিলিয়ে বিচারক আছেন মাত্র দুই হাজারের মতো। রাতদিন পরিশ্রম করেও মামলার স্তুপ সরাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বিচারকদের। সরকারের পক্ষ থেকে মামলার জট কমাতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও খুব একটা সুফল মিলছে না।
মামলার পাহাড়সম এই জট কমাতে বিচারক ও লজিস্টিক সাপোর্ট বাড়ানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন আইনজ্ঞরা। এছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও বর্তমানের চেয়ে তিনগুণ বিচারক নিয়োগ দেওয়া, পুরোনো মামলা নিষ্পত্তিতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিচারিক কাজে ডিজিটালাইজেশনের দিকেও গুরুত্বারোপ করেছেন তারা।
বিজ্ঞাপন
আদালত সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে সারাদেশের বিচারিক আদালতগুলোতে বিচারাধীন মামলা আছে ৩৫ লাখের মতো। এতো মামলার বিপরীতে বিচারক আছেন মাত্র ২ হাজার। প্রতিদিন আরও নতুন নতুন মামলা যোগ হচ্ছে। কথায় কথায় মানুষের মামলা করার প্রবণতায় জট বেড়েই চলছে। ফলে মাত্র দুই হাজার বিচারকের পক্ষে ৩৫ লাখ মামলা নিষ্পত্তি করা কতটা সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেছেন, সারাদেশে ৩৫ লাখ মামলা পেন্ডিং (বিচারাধীন) রয়েছে। এবছরই ১০২ বিচারক নিয়োগ দেওয়া হবে। নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে দেশের আদালতগুলোতে মামলার জট কমে আসবে। ফলে বিচারপ্রার্থীদের আর আদালতের বারান্দায় ঘুরতে হবে না। কমবে তাদের ভোগান্তি।
আইন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা ড. রেজাউল করিম ঢাকা মেইলকে বলেন, এই মূহুর্তে সারাদেশে আনুমানিক প্রায় ২ হাজারের মতো বিচারক আছেন।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইডস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মনজিল মোরসেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, মামলাজট কমাতে আদালতে বিচারকের সংখ্যা বাড়াতে হবে। লজিস্টিক সাপোর্ট বাড়াতে হবে। সুশাসন যতদিন না আসবে ততদিন মামলা জট কমবে না। এখনকার চেয়ে তিনগুণ বিচারক নিয়োগ দেওয়া দরকার। তাহলে মামলাজট কমবে।
বিজ্ঞাপন
ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মাদ শিশির মনির ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘মামলাজট কমাতে অবশ্যই বিচারক সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। বিচারিক প্রশাসন যেমন নোটিশ জারি, সমন জারি ইত্যাদি ক্ষেত্রে ডিজিটাল ব্যবস্থা চালু করতে হবে। পুরোনো মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে কেস স্ট্রাটেজি ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। অর্থাৎ একটি মামলা শুরু ও শেষ করার ক্ষেত্রে তারিখ অনুযায়ী সিডিউল করে শেষ করে দিতে হবে। তদন্ত প্রক্রিয়া নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করতে হবে।
মামলার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারপতি নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের দেশে মামলার বিচারিক ধাপ বেশি। পৃথিবীর কোনো দেশে এরকম প্রক্রিয়া নেই। সহকারী জজ, সিনিয়র সহকারী জজ, যুগ্ম জেলা জজ, জেলা জজ, হাইকোর্ট বিভাগ, আপিল বিভাগ, মামলার রায়ের রিভিউ। এতগুলো ধাপ পার করতে যুগ যুগ সময় লেগে যায় মামলা নিষ্পত্তি করতে। পৃথিবীর কোথাও নেই এত ট্রায়াল (বিচার)। বিকল্পবিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) পদ্ধতি আমাদের দেশে খুব একটা কাজ দেয় না। এডিআর বা বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির সিস্টেমের কারণে মামলা জট কমছে না। কারণ এডিআরের সিদ্ধান্ত ম্যান্ডাটোরি (বাধ্যতামূলক) না। এডিআরের পরেও বিচারপ্রার্থীরা কোর্টে ফিরে আসতে পারেন।’
এদিকে যশোরের আদালতগুলোতে দ্রুত মামলা নিষ্পতির তাগিদ দিয়েছেন হাইকোর্টের মনিটরিং কমিটির খুলনা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি বলেন, বিশেষ করে ১০ বছরের আগের মামলারগুলোর ওপর দৃষ্টি দিতে হবে।
জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, পুরাতন মামলাগুলো যদি দ্রুত নিষ্পত্তি করা হয় তাহলে আইনের প্রতি বিচারপ্রার্থীদের আস্থা আরও দৃঢ় হবে। বিচারের জন্য তাদের আর বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হবে না। আরও বেশি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অর্জন করা যাবে। এজন্য এই কাজে বিচারক, জেলা প্রশাসক, পুলিশ প্রশাসন, আইনজীবী ও সাংবাদিকদের একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।
তবে জেলা ও দায়রা জজ বলেন, যশোরের আদালতে আমুল পরিবর্তন হয়েছে। বিচারকরা সর্বোচ্চ দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। যার ফলশ্রুতিতে এখন বিচারপ্রার্থীরা দ্রুত সেবা পাচ্ছেন।
যশোরের আদালতে মামলার পরিসংখ্যান অনুযায়ী যশোর জেলা ও দায়রা জজ আদালতে গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মামলা ছিল ৫৪ হাজার ৪শ ৩৭টি। চলতি বছরে মামলা দায়ের হয়েছে ১১ হাজার ১৩০টি।
যশোর আদালতে চলতি বছরে ২৬ হাজার ৪শ’৬টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। আদালতে চলতি বছরে মামলা দাখিল হয়েছে ২৭ হাজার ৭৩৯টি। বর্তমানে এসব আদালতে বিচারাধীন রয়েছে ৮২ হাজার ৩৪৩টি মামলা।
এআইএম/এমআর