বোরহান উদ্দিন
১৫ আগস্ট ২০২৫, ০৪:২১ পিএম
ড. দিলারা চৌধুরী। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সরকার ও রাজনীতি’ বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রবীণ এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক গণবিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। শিক্ষকতা করেছেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতেও। দেশের রাজনৈতিক ও আর্থ সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন ঢাকা মেইলের সঙ্গে। একান্ত সাক্ষাৎকারে অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাজের মূল্যায়ন, আগামী সংসদ নির্বাচনের বাস্তবতা, নির্বাচন পদ্ধতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিতে করণীয় সম্পর্কে মত দিয়েছেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সিনিয়র রিপোর্টার বোরহান উদ্দিন।
ঢাকা মেইল: দেশে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য-উপাত্তও উদ্বেগজনক। কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
দিলারা চৌধুরী: রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার যে সহিংসতা এটা তো বলে দেয় দেশে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। দলগুলোর পাশাপাশি যারা সরকারে আছেন তাদের এর দায় নিতে হবে। কারণ বড় দায় আছে। সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। পুলিশ এখনো সক্রিয়ভাবে কাজ করছে না। সেনাবাহিনীও তাদের খুব সহযোগিতা করছে কি না বলতে পারছি না। তারা ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে আছে। সাধারণত বাংলাদেশে সেনাবাহিনী ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে মাঠে থাকলে তো ম্যাজিকের মতো কাজ হয়। এটা কিন্তু সেটা হচ্ছে না।
ঢাকা মেইল: রাজনৈতিক দলগুলো ব্যবস্থা নিলেও নেতাকর্মীদের খুব একটা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে করণীয় কী?
দিলারা চৌধুরী: বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি কেউ তো এখন ক্ষমতায় নেই। তাদের পক্ষে তো তৃণমূল নেতাকর্মীদের... তারেক রহমান তো বলে দিয়েছেন যে, কোনো ধরনের অপরাধে জড়ালে ছাড় নেই। তারা তো প্রশ্রয় দিচ্ছে না। কিন্তু বিএনপি যে ভুলটা করছে তা হলো- ওই কর্মীদের শুধু না ধরে পুরো কমিটিকে ধরতে হবে। কমিটির চেয়ারম্যানকে বহিষ্কার করতে হবে। তাদের বলতে হবে তোমরা কেন এই ধরনের লোককে দলে নিয়েছো। কিন্তু আসল গুরুদায়িত্বটা কিন্তু সরকারের। রাষ্ট্রের আইন-কানুন, নাগরিকদের নিরাপত্তা, সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষার দায়িত্বও সরকারের। সে ব্যাপারে আমরা কোনো ধরনের পদক্ষেপ দেখছি না।
ঢাকা মেইল: সরকার নির্বাচনের পথে হাঁটছে। নির্বাচন কমিশন পুরোদমে প্রস্তুতি শুরু করেছে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে নির্বাচন আয়োজনের অনুকূল পরিবেশ আছে বলে মনে করেন?
দিলারা চৌধুরী: সত্যি বলতে আমি বুঝতে পারছি না সরকার কী করতে চাচ্ছে। আপনি (সরকার) নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করছেন, কিন্তু নির্বাচনের পরিবেশ তো ঠিক করছেন না। আপনি আমলাদের ঠিক করেননি, পুলিশ ঠিক করেননি। আর্মি তাদের সেভাবে সহযোগিতা করছে না। রাজনৈতিক দলগুলো আপনার সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে গেছে। আপনি কী নির্বাচন করবেন? এটা কি শুধু কথার কথা, না সিরিয়াস? পরিবেশ ছাড়া নির্বাচন হয় না। পুলিশ, প্রশাসন, জুডিশিয়ারি ঠিক করতে হবে, মিডিয়া ঠিক করতে হবে। মিডিয়া তো এখনো আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলে। অনেক মিডিয়া আছে। কিছুই ঠিক করতে পারেননি। এরমধ্যে কী নির্বাচন উনি করবেন আমার কোনো আইডিয়া নেই।

ঢাকা মেইল: রাজনৈতিক দলগুলো সরকারকে চাপ দিচ্ছে নির্বাচনের জন্য। সরকার তাহলে কী করবে?
দিলারা চৌধুরী: সরকার জনগণের এতবড় সাপোর্ট নিয়ে এসেছে। তাহলে তারা কেন শক্তভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছে না? কেন তারা অসহায় হবে? সরকার রাজনৈতিক দলগুলোকে বলবে আপনারা স্বাক্ষর করেন, সংস্কার করবেন। না হলে আমি যা করার করে আইনি ভিত্তি দিয়ে নির্বাচন করে চলে যাবো। সেটা কেন সরকার করছে না। অনেক রকম উপায় আছে। একজন আরেকজনকে দোষ দিলে লাভ হবে না।
রাজনৈতিক দল তো নির্বাচন চাইবেই। রাজনৈতিক দলগুলো যদি জুলাই সনদ, সংস্কার না করে তাহলে আপনি (প্রধান উপদেষ্টা) নিজে বলেন আমি তোমাদের একটেবিলে আনতে পারলাম না, ঠিক আছে সনদ যতটুকু আছে আমি পারি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে সেই কাজটুকু করে দিচ্ছি। আইনি ভিত্তি তৈরি করে গণভোটে দিয়ে দেব। সেটার ভিত্তিতে নির্বাচন হবে। পৃথিবীতে যেখানেই সরকার থাকে তখন তাদের হাতে অনেক প্রিভিলেজ থাকে, তেমনি সুযোগ থাকে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সরকারের থাকে। আমি একটা পদ্ধতি দিলাম। সরকার কি সে পথে হাঁটছে?
ঢাকা মেইল: জুলাই সনদ নিয়ে এখনো কোনো সুরাহা হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানা মত দেখা দিয়েছে। এক্ষেত্রে সরকার কী করতে পারে?
দিলারা চৌধুরী: জুলাই সনদের বিষয়ে রাজনৈতিক দল কিছু করছে না বলে আপনি (প্রধান উপদেষ্টা) কি নির্বাচন দেবেন না? অথবা এমন একটা নির্বাচন দেবেন যেটার কোনো মানে হবে না। আপনি স্ট্রং (শক্ত) হন। আপনি জোর দিয়ে বলেন, ছাত্র-জনতা আপনাকে ক্ষমতায় এনেছে। আমি সেই ম্যান্ডেটের জোরে আপনারা যা করছেন এখন আমি আমার মতো করে জুলাই সনদ করবো। সেটা গণভোটে দিয়ে তার ভিত্তিতে নির্বাচন দেন।
ঢাকা মেইল: জুলাই ঘোষণাপত্র, নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে ছাত্র নেতাদের গড়া দলসহ অনেকে আপত্তি করছেন। পরিস্থিতি কি তাহলে দিন দিন খারাপ হচ্ছে বলে মনে করেন?
দিলারা চৌধুরী: তারা তো আপত্তি করবেই। প্রফেসর ইউনূস ক্ষমতায় বসেছে কার জন্য। তার উপদেষ্টাদের মোস্ট অব দেম আর গুড ফর নাথিং। তারা ক্ষমতায় বসেছে কার জন্য। ওনার একাউন্টিবিলিটি কোথায়? রাজনৈতিক, ছাত্র-জনতা না আমাদের কাছে? আমরা তাকে বসিয়েছি। অবস্থা তো খারাপের দিকেই যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ তো সরকারকেই করতে হবে।
ঢাকা মেইল: এমন পরিস্থিতির দায় কি সরকারের...?
দিলারা চৌধুরী: এনজিওদের দিয়ে রাষ্ট্র চালানো যায় না। উনি চারিদিকে এনজিও বসিয়ে রেখেছেন। এনজিওরা এনজিও চালাতে পারে। রাষ্ট্র পরিচালনা এটা অন্যরকম একটি আর্ট। ওনারা খুব ভালো। তাদের ব্যক্তিগত কোনো বিষয় নিয়ে কিছু বলছি না। তারা আমার ভালো বন্ধুও। কিন্তু এনজিও আর রাষ্ট্র চালানো এক নয়। আপনি আমাকে দেন না রাষ্ট্র চালাতে, আমি পারবো? আমি তো পলিটিক্যাল সায়েন্সের লোক। আমি বুঝি, কিন্তু রাষ্ট্র চালাতে তো পারবো না।
ঢাকা মেইল: উপদেষ্টাদের কারও কারও বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠছে। কী বলবেন?
দিলারা চৌধুরী: যেসব উপদেষ্টার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে রাষ্ট্র কেন তাদের বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছে না? সুষ্ঠু তদন্ত করে জানিয়ে দিতে পারে অভিযোগ সত্য নাকি মিথ্যা। এটাই তো করা উচিত। তাহলেই তো সব মিটে যায়। বিশ্বাসে বস্তু মেলায়, তর্কে বহুদূর। এটা নিয়ে তর্ক-বিতর্কের কী দরকার? সরকার তো কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। আমরাও তো সরকারের পক্ষ থেকে শক্ত কোনো পদক্ষেপ কিংবা কথাবার্তা দেখছি না। আমি প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ১০০ ভাগ নয়, ২০০ ভাগ সমর্থন দিয়েছি। এখনো দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু তিনি কিছু এনজিওর লোক এনে দেশ চালাতে চাচ্ছেন, এভাবে তো চালানো যায় না।
ঢাকা মেইল: উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন অনেকে। তাতে কি কোনো লাভ হতে পারে?
দিলারা চৌধুরী: নিশ্চয়ই পুনর্গঠন করলে ভালো ফল হবে। শিক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে যাকে নিয়েছেন তিনি তো ভালো মানুষ, ভালো কাজ করছেন। বাণিজ্য উপদেষ্টা যাকে করা হয়েছে, প্রথমে দ্বিধার মধ্যে ছিলাম তাকে নিয়ে। কিন্তু তিনি তো অসাধারণ কাজ করছেন। অর্থ উপদেষ্টাও ভালো করছেন। ব্যাংকিং সেক্টরকে একটা শৃঙ্খলা আনার চেষ্টা করছেন। এনবিআরকে নিয়ে শক্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ফাওজুল কবির উনিও তো ভালো কাজ করছেন। তাহলে আপনি কেন কিছু এনজিওর লোকদের নিয়ে নিলেন? অন্য কি ভালো, দক্ষ মানুষ নেই। সবাই কি মরে গেছেন?

ঢাকা মেইল: তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ কী?
দিলারা চৌধুরী: আমার কাছে দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর কিন্তু আমরা ফসল ঘরে ওঠাতে পারিনি। ৫০ বছর ধরে একটার পর একটা হোচট খেতে হয়েছে। আমরা জুলাই আন্দোলনে পর আশা করেছিলাম। কারণ যারা লুটপাট করে তাদের কিন্তু সবারই একটা শিক্ষা হয়েছে। আমরাও যদি ঠিকমতো না চলি তাহলে এমন অবস্থা হবে। আমরা জুলাই অভ্যুত্থানের সফল ঘরে তুলব তেমন আশা করছিলাম। আমরা সেটা যদি করতে পারতাম তাহলে বাংলাদেশ এগিয়ে যেত।
ঢাকা মেইল: নির্বাচনকে সামনে রেখে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র হতে পারে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করছেন কেউ কেউ। আপনিও কি তেমন আশঙ্কা করছেন?
দিলারা চৌধুরী: আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ (মিয়ানমার) যেখানে রোহিঙ্গারা আছে। ওইখানে কী জাতীয় পরিবর্তন হচ্ছে, আমরা কারও মুখে শুনছি না। যে পরিবর্তন হচ্ছে তাতে আমরা আর রোহিঙ্গাদের ওই দেশে ফেরত পাঠাতে পারবো না। ধীরে ধীরে রোহিঙ্গাদের জন্য বরাদ্দ কমে আসছে। রোহিঙ্গারা কী তাহলে আমাদের জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকি না? আমাদের পাশে আরেকটা দেশ আছে। তারা আমাদের চারিদিক দিয়ে বিষাক্ত নিশ্বাস ছাড়ছে। আমাদের তো কোনো কিছুর জ্ঞান নেই। আসলে এই জনপদের কী হবে আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
তবে দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশের হাজার হাজার বেকার তরুণ ঘুরে বেড়াচ্ছে। উনি কি এদের পুলিশে নিয়োগ দিয়ে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে সাজিয়ে ফেলতে পারত না? দুই বছরের ট্রেনিংটা আপনি ছয় মাসে ক্রাশ প্রশিক্ষণ দেন। আপনি কিছুই করবেন না আর নির্বাচন দেবেন? এই নির্বাচনে এমন মারামারি হবে পুরো বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে যাবে।
ঢাকা মেইল: নির্বাচনী ট্রেন চলতে শুরু করেছে। সরকার দেড় লাখ পুলিশকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা জানিয়েছে। এটা কতটা কাজে লাগতে পারে?
দিলারা চৌধুরী: আপনি ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দিলে কেমনে হবে? আপনি ট্রেনিং দেবেন ভালো কথা। তাহলে এতদিন কেন দিলেন না? এখন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করলেই তো সব কিছু ওলোটপালোট হয়ে যাবে। তখন কে কাকে ট্রেনিং দেবে? সময়ের কাজ সময়ে করতে হয়।
ঢাকা মেইল: আপনাকে ধন্যবাদ
দিলারা চৌধুরী: ঢাকা মেইলকেও ধন্যবাদ।
বিইউ/জেবি