শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

‘সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ ব্যবস্থা নেওয়া, বিবৃতি নয়’

সাখাওয়াত হোসাইন
প্রকাশিত: ১৫ জুলাই ২০২৫, ০৭:২৪ পিএম

শেয়ার করুন:

tawhid
ড. তৌহিদুল হক। ছবি: সংগৃহীত

দেশে ক্রমেই বেড়ে চলেছে অপরাধপ্রবণতা। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বড় অপরাধের পরিমাণ বাড়েনি বলে দাবি করা হলেও গণমাধ্যমের সংবাদ বলছে ভিন্নকথা। একদিকে একের পর এক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হওয়া এবং অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় জনমনে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। সম্প্রতি রাজধানীর মিডফোর্ডে বীভৎসভাবে জনসম্মুখে এক ব্যবসায়ীকে হত্যার ঘটনা দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। এই অবস্থায় অপরাধপ্রবণতা বেড়ে চলা, তা নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদ্যোগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর করণীয়, রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাসহ নানা বিষয়ে ঢাকা মেইলের মুখোমুখি হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল‍্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাখাওয়াত হোসাইন

ঢাকা মেইল: সাম্প্রতিক সময়ে হত্যা-ধর্ষণসহ নানা ধরনের অপরাধপ্রবণতা বেড়েছে। এর পেছনে কী কারণ বলে আপনি মনে করেন?


বিজ্ঞাপন


ড. তৌহিদুল হক: গত বছর থেকে যে ধরনের অপরাধপ্রবণতা বা সহিংসতা আমরা লক্ষ্য করছি, এটি বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বলব- একেক ধরনের সহিংসতার পেছনে একেক ধরনের কারণ আছে। মোটাদাগে যদি এই ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে নেপথ্যে পরিস্থিতিগুলোকে বোঝার চেষ্টা করি, আমরা কয়েক ধরনের প্রেক্ষাপট খুঁজে পাই। যে কারণে অপরাধ ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাচ্ছে এবং নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। তার মধ্যে অন্যতম আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে এই বাহিনীর যে ভূমিকা কিংবা তৎপরতা দরকার, সেটিতে ঘাটতি আছে। এই ঘাটতির কারণে অনেক অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে। এই ঘাটতি যখন থাকবে, তখন আইনের শাসন পরিপূর্ণভাবে প্রয়োগ হয় না। সেইসঙ্গে অপরাধের নানা ধরনের রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে, যার কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে চিন্তা-ভাবনা করে কাজ করতে হচ্ছে।

ঢাকা মেইল: রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে কি না এবং অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কী করণীয় হতে পারে?

ড. তৌহিদুল হক: আইন প্রয়োগের জায়গাতেও রাজনৈতিক পরিচয় কিংবা ব্যক্তির অর্থনৈতিক প্রভাবসহ অন্যান্য প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। অপরাধীর রাজনৈতিক পরিচয় থাকলে অনেক সময় অপরাধী পার পেয়ে যায় এবং অপরাধীর মধ্যে ভয় থাকে না। আইন প্রয়োগ ব্যতীত অপরাধপ্রবণতা বা সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ করাটা আমাদের দেশের জন্য খুব কঠিন। যেকোনো মূল্যে স্বাধীনভাবে আইনের প্রয়োগ ঘটাতে হবে। আর এ জায়গায়ও ঘাটতি আছে।

Sohag
ব্যবসায়ীকে বীভৎস কায়দায় হত্যার ঘটনাটি দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করে। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা মেইল: গত বছরের ৫ আগস্টের প্রেক্ষাপটে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা নিজেদের এখন নিরাপদ মনে করছে কি না এবং তাদের কোনো ঝুঁকি আছে বলে মনে করেন কি?

ড. তৌহিদুল হক: আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিজেরাও নিরাপত্তা ঝুঁকিতে আছে, যার কারণে অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন জায়গাতে তারা (আইনশৃঙ্খলা বাহিনী) নিজেরাই নিরাপত্তার হুমকি এবং ঝুঁকিতে পড়ছে। বাহিনীর নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সাথে মাঠ পর্যায়ের সমন্বয়হীনতা রয়েছে। আবার কখনো কখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নীরবতা বা কখনো কখনো তারা বলা যেতে পারে নিষ্ক্রিয় থাকছে। সেইসঙ্গে কোথাও কোথাও অপরাধ হলে সেক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রশ্ন বিলম্ব হচ্ছে। এই জায়গাতে ব্যবস্থা গ্রহণেও কিছু প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে যে, অপরাধ হলে মামলা হতে পারে, নাও পারে। আবার মামলা হলে সেই মামলায় গ্রেফতার হতে পারে, নাও পারে। এই ধরনের নানাকেন্দ্রিক দোদুল্যমান মানসিকতা আছে বা ধারণা আছে সমাজে।

আরও পড়ুন

বড় ধরনের অপরাধের পরিমাণ বাড়েনি: প্রধান উপদেষ্টার দফতর

অপরাধীদের কঠোরভাবে দমন করতে হবে: ডিএমপি কমিশনার

ঢাকা মেইল: অপরাধ বেড়ে যাওয়ার পেছনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও রাজনৈতিক অস্থিরতা কতটুকু দায়ী?

ড. তৌহিদুল হক: আমাদের বাস্তবতা হলো, আমরা কঠোর এবং দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছি না। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা আছে। দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে নানা ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এটা অতীতেও ঘটেছে। এবারের প্রেক্ষাপটটা অন্যরকম। এবারে পটপরিবর্তনটাতো নির্বাচনের মধ্য দিয়ে হয়নি, অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে হয়েছে। আবার যারা এই পরিবর্তনটাকে মেনে নিতে পারছেন না, তারা চাইছেন অস্থিরতা বাড়াতে। সেই অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য অর্থ বিনিয়োগ থেকে শুরু করে তারা তাদের যে মানসিকতার যারা আছে কর্মী বা সমর্থক, তাদের উদ্বুদ্ধ করছে বা প্ররোচিত করছে।

সেইসঙ্গে অপরাধীদের রাজনৈতিক পরিচয় থাকলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনেক সময় ‘ধীরে চলো’ নীতি অবলম্বন করছে। কারণ হলো, রাজনৈতিক পরিচয় থাকলে ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে পুলিশ কর্মকর্তা বা ওই থানায় আবার কোনো ধরনের ঝুঁকিতে পড়ে কি না। উত্তরবঙ্গে এক-দুটি থানায় আমরা দেখেছি, পুলিশকেই সেখান থেকে ট্রান্সফার করেছে, প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে ওসিকে। কাজেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিপূর্ণভাবে সোচ্চার হয়ে উঠতে পারছে না।

ঢাকা মেইল: দেশে আইনের শাসন পুরোপুরি নেই বলে অনেকে অভিযোগ করেন। আপনি কী মনে করেন?

ড. তৌহিদুল হক: দেশের এখন পুরোপুরি আইনের শাসন নেই। আইনের শাসনের ভিত্তিতে আমাদের সমাজব্যবস্থা চলে না। সমাজে যখন এই ঘাটতিগুলো তৈরি হয় বা দেখা দেয়, তখন অপরাধীরা নানাভাবে সক্রিয় হয়।

ঢাকা মেইল: পুরান ঢাকায় সম্প্রতি বীভৎসভাবে এক ব্যবসায়ীকে প্রকাশ্যে হত্যার ঘটনা নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে। আপনি বিষয়টাকে কীভাবে দেখছেন?

ড. তৌহিদুল হক: সম্প্রতি ‍পুরান ঢাকায় ব্যবসায়ীকে হত্যায় ঘটনায় চরম পর্যায়ের বর্বরতা আমরা লক্ষ্য করলাম। তার মানে পরস্পর যে হিংসা-বিদ্বেষ, ব্যবসা-বাণিজ্য বা স্বার্থকেন্দ্রিক বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে যে অন্যের অবস্থানকে দেখতে না পারা, সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে এর প্রতিশোধ নেওয়া- এই বিষয়গুলো আমরা দেখতে পেলাম। মানুষ অপরাধমূলক যে তৎপরতা ধারণ করেছে, যেটি আসলে এক ধরনের অপরাধের মহামারি হিসেবেই দেখছি। সেইসঙ্গে আইন না মানার প্রবণতা রয়েছে। এতেই বিপত্তি। সবাইকে আইন মেনে চলতে হবে। তাহলে সমাজে পরিবর্তন আসবে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর হতে হবে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তোলনের জন্য এখানে কোনো ম্যাজিক নেই। আবার ম্যাজিক আছেও। ম্যাজিকটা কী? ম্যাজিকটা হচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোরভাবে এই ধরনের অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ করা, আইনের মুখোমুখি করা।

সেইসঙ্গে দ্রুত সময়ের মধ্যে আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এই ধরনের অপরাধগুলোর বিচার সম্পন্ন করা। এই ক্রান্তিকালে যে অপরাধগুলো হয়েছে বা হচ্ছে, দ্রুত সময়ের মধ্যে এই বিচার সম্পন্ন করতে হবে। যখনই দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যাবে যে, কেউ অপরাধ করলে তাকে ১০ দিন বা ১৫ দিন বা এক মাসের মধ্যে এই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে, তাহলে পরিস্থিতি বদল হবে, এটাই ম্যাজিকের মতো কাজ করবে। এছাড়া অন্য কোনো ম্যাজিক এই মুহূর্তে বাংলাদেশে নেই।

Police
৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে ব্যাপক রোষানলে পড়ে পুলিশ। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা মেইল: অপরাধীদের শাস্তি কী হতে পারে?

ড. তৌহিদুল হক: শাস্তি প্রচলিত আইনেই। কাউকে খুন করলে প্রচলিত আইনে যা শাস্তি আছে, সেই শাস্তি হবে অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী। আমার কথা হচ্ছে, প্রচলিত আইন অনুযায়ী আইনের যে শাস্তি আছে সেই শাস্তিটাই আপনি দ্রুত সময়ের মধ্যে দেন। যারা সম্পৃক্ত তাদের সবাইকে গ্রেফতার করেন। রাজনৈতিক পরিচয় বা কোনো পরিচয়কে বিবেচনা না করে অপরাধ যে করেছে সেই বিবেচনা করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এর বিকল্প কোনো সমাধান নেই। অর্থাৎ দ্রুত সময়ের মধ্যে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। অন্যথায়, এই পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ করাটা খুব কঠিন হবে।

আরও পড়ুন

কোনো অপরাধীকে প্রশ্রয় দেবে না বিএনপি: সালাহউদ্দিন

হঠাৎ বেকায়দায় বিএনপি!

ঢাকা মেইল: অপরাধীদের দমন করতে অন্তর্বর্তী সরকার যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে সেগুলো কতটুকু কার্যকরী বলে আপনি মনে করেন?

ড. তৌহিদুল হক: আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ঘটনায় বিবৃতি প্রদান করার যে ঘটনা, সেটি আমাদের হতাশ করেছে। কারণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সরকার তো ব্যবস্থা নেবে। মানে এখন যারা ব্যবস্থা নেবে তারা যদি বিবৃতি দেয়, তাহলে যারা বিবৃতি দেবে তারা কী করবে? এই অস্থিরতা বা অপরাধ প্রবণতা বা সহিংসতা নিরসনের প্রশ্নে আরও কঠোর অবস্থানটা খুব জরুরি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া যে, অতীতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার প্রশ্নে তারা যা করেছে এখনো তাই করবে। অপরাধীদের গ্রেফতার করে আইনের মুখোমুখি করবে এবং সেক্ষেত্রে কার কী অন্য পরিচয় আছে সেই পরিচয়ের জায়গাটি সরকার দেখবে না। সরকারের কাছ এই কঠোরতা আমরা প্রত্যাশা করি।

ঢাকা মেইল: বিশৃঙ্খলারোধে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা বা সদিচ্ছা দেখছেন কতটুকু?

ড. তৌহিদুল হক: সবাইকে দলীয় শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসা এটা খুব কঠিন। এটা কোনো একটা নির্দিষ্ট দলকে সামনে রেখে বলার সুযোগ নাই। দেশের বড় দলগুলোর একই বাস্তবতা। এখন সেই বাস্তবতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আইনের কঠোর প্রয়োগের মধ্য দিয়েই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নিয়মতান্ত্রিকভাবে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বরং অপরাধ সৃষ্টি হলে আমরা যে রাজনীতি খোঁজার চেষ্টা করি, এটা আমাদের আমাদের দেশে এই অপরাধ অপরাধের বিচার এবং অপরাধ নিয়ন্ত্রণ না হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ। এখন যে অপরাধগুলো হচ্ছে, এখানে যদি আমরা রাজনীতি খোঁজার চেষ্টা করি, আমরা খুঁজতেই পারি, অসুবিধা নেই। কারণগুলো তো আমাদের বের করতে হবে, তখন যে অবস্থাটা তৈরি হবে, বিগত সময়ের সাথে তার একটা তুলনামূলক চিত্র উপস্থাপনের কেউ কেউ চেষ্টা করবেন। যখনই তুলনা হওয়ার চেষ্টা শুরু হবে, তখনই অপরাধটা ছোট হয়ে যায়। অপরাধটা দুর্বল হয়ে যায়। যে অতীতেও তো ঘটেছে। এখনো এই প্রেক্ষাপটে সমাজের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা তো নানা কারণে সৃষ্টি হতেই পারে। এখানে তখন রাজনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে বা অন্য কোনো শক্তি ব্যবহার করে কেউ অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠতে পারে। কেউ সহিংসতা সৃষ্টি করতে পারে। এজন্য রাজনীতি না খুঁজে শক্ত হাতে দমন করতে হবে।

এসএইচ/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর