ঢাকা মেইল ডেস্ক
১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:১৭ পিএম
অপারেশন আল-আকসা ফ্লাডের আগে, প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর চরমপন্থী নীতির কারণে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। এই ধরনের আশঙ্কা এই প্রথমবার নয়, বরং ইসরায়েলি সমাজে দীর্ঘদিন ধরেই গৃহযুদ্ধের একটি আশঙ্কার কথা বলছেন বিশ্লেষকেরা।
ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার সময় এর নেতারা সংবিধান প্রণয়ন করা থেকে বিরত ছিলেন। তারা জানতেন যে, একটি সংবিধানের উপস্থিতি ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের মধ্যে তীব্র বিভাজনের দিকে নিয়ে যেতে পারে, যা শুরু থেকেই ইসরায়েল রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। ইসরায়েলের ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ জনগণের মধ্যে বেশ কিছু বিষয়ে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে, যেমন—সাবাথ পালন, হালাল খাদ্য গ্রহণ, নারীদের মর্যাদা, আন্তঃবিবাহ, শিক্ষা, সামরিক পরিষেবা ও বসতি স্থাপন। সময়ের সাথে সাথে এই তালিকায় ময়নাতদন্ত ও অঙ্গ প্রতিস্থাপন আইন, মানবাধিকার, ধার্মিক নারীদের কর্মসংস্থান ও ফিলিস্তিনিদের সাথে সমঝোতা করার মতো বিতর্কিত বিষয়গুলো যুক্ত হয়েছে। এই পার্থক্যগুলো এতটাই তীব্র যে, অনেক ইসরায়েলি মনে করেন, যেকোনো সময় এগুলো গৃহযুদ্ধের কারণ হতে পারে।
মিশরীয় কূটনীতিক রফআত আল-আনসারী তার স্মৃতিচারণে ইসরায়েলে অবস্থানকালীন অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে উল্লেখ করেছেন যে, চরমপন্থী ধর্মীয় গোষ্ঠী মিশরীয় রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদাতের হত্যার পর মিশরীয়-ইসরায়েল শান্তি চুক্তির বিরুদ্ধে একটি বিক্ষোভের আয়োজন করেছিল। এ বিষয়ে মিশরের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ বাসিউনি একবার বলেছিলেন, ‘যদি ইসরায়েলে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, তবে এর কারণ হবেন কাচ আন্দোলনের নেতা মীর কাহানে।’ বাসিউনির এই মন্তব্য ইসরায়েলি সমাজের বাস্তবসম্মত বিশ্লেষণের ভিত্তিতেই করা হয়েছিল। অনেক ধার্মিক ইহুদি ‘বৃহত্তর ইসরায়েল’ ধারণা ত্যাগে অনাগ্রহী। তারা যেকোনো শান্তি চুক্তির বিরোধিতা করেন, যা আরবদের দখলকৃত অঞ্চল তাদের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারে। এই প্রেক্ষাপট ইসরায়েলি সমাজে গভীর মতবিরোধের বাস্তবতা এবং সম্ভাব্য সংঘাতের দিকে ইঙ্গিত করে।
ইসরায়েলে গুশ অ্যামোনিয়াম ও কাচের মতো আন্দোলনের আবির্ভাবই গৃহযুদ্ধের কারণ হতে পারে। কারণ তারা অধিকৃত আরব অঞ্চলগুলো শান্তির বিনিময়ে ছেড়ে দেয়ার ইচ্ছা করলেই গৃহযুদ্ধের হুমকি দেয়। এই আন্দোলনগুলো লিকুদ পার্টির নেতাদের সাথে জোটবদ্ধ হয়। যেমন— বেগিন ও শামির, যারা এসব অঞ্চল থেকে ইসরায়েলের প্রত্যাহারের ঘোর বিরোধী ছিলেন। বিশেষ করে ১৯৯১ সালের মাদ্রিদ সম্মেলনে ‘শান্তির জন্য ভূমি ছেড়ে দেওয়া’ নীতি সামনে আসার পর এই বিরোধ তীব্রতর হয়।
২০০০ সালে ইসরায়েল যখন দক্ষিণ লেবানন থেকে এবং ২০০৪ সালে গাজা উপত্যকা থেকে সরে আসে করে, তখন এই উত্তেজনা নতুন করে মাথাচাড়া দেয়। সে সময় অতি-অর্থোডক্স কর্মকর্তাদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতির কারণে সেনাবাহিনী সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটাতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছিল। কারণ অনেকেই মনে করছিলেন যে সরকার ‘বৃহত্তর ইসরায়েল ধারণা’ থেকে সরে এসেছে।
মিশরীয় কূটনীতিক তার বই ‘ইসরায়েলে সামরিক অভ্যুত্থান: সম্ভাবনা এবং বাস্তবতা’ গ্রন্থে ইসরায়েলি গবেষক তেজ্ভিক আমিত নামক একজন ডানপন্থী শিক্ষাবিদের উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেন: ‘উভয় পক্ষের চরমপন্থার কারণে ইসরায়েলে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রকৃত ঝুঁকি ছিল।’ তিনি এই পরিস্থিতিকে এমন এক পাউডার কেগের সাথে তুলনা করেছেন, যা যেকোনো মুহূর্তে বিস্ফোরিত হতে পারে।
অন্যদিকে, কেউ কেউ মনে করেন ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ফিলিস্তিনি জনগণের কারণে বা ১৯৪৮ সালের আরব নাগরিকদের কারণে গৃহযুদ্ধ শুরু হতে পারে। মোলেডেট আন্দোলনের প্রধান জেনারেল রেহাভাম জিভি, যিনি ২০০০ সালে নিহত হন, বিশ্বাস করতেন যে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান ইসলামি আন্দোলনের শক্তি শেষ পর্যন্ত গৃহযুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
এই ভয়গুলো ২০২১ সালে অপারেশন ‘জেরুজালেম সোর্ড’ এর সময় আরও বেড়ে যায়, যখন ইসরায়েলের মিশ্র শহরগুলোতে সহিংস উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে লোড শহরে, যেখানে পুলিশ কিছু এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং কিছু ইহুদি পরিবারকে নিরাপত্তার কারণে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়।
বার-ইলান বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক মেনাচেম ক্লেইনের মতে, অপারেশন আল-আকসা ফ্লাডের আগেই ইসরায়েল গৃহযুদ্ধের হুমকির সম্মুখীন হয়েছিল। তিনি মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর বিচার বিভাগীয় সংস্কারের মাধ্যমে তার ক্ষমতা শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা এই গৃহযুদ্ধের সূচনা হিসেবে কাজ করেছে। এই সংস্কারের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ ইসরায়েলি সমাজে গভীর বিভেদ তৈরি করেছে।
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্টও এই বিপদটি নিশ্চিত করেছিলেন। তিনি সতর্ক করেছিলেন যে বিচারিক সংস্কারের অংশ হিসেবে ‘যৌক্তিকতা সীমিতকরণ’ আইন খসড়া ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি তৈরি করছে।
আমেরিকান ওয়েবসাইট কাউন্টারপাঞ্চ এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে, এই বিচারিক সংশোধনীর কারণে যেমন বেনি গ্যান্টজ ও গাদি আইজেনকোটের মতো বিশিষ্ট ইসরায়েলি ব্যক্তিত্বরা পদত্যাগ করেছেন, তেমনি ইসরায়েলে গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনাও বেড়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই বিভাজনগুলো পশ্চিমা গণতন্ত্রর সাধারণ রাজনৈতিক মেরুকরণের চেয়ে অনেক ভিন্ন। নেতানিয়াহু ও তার সহযোগীরা ১৯৪৮ সাল থেকে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক কাঠামো পরিবর্তন করতে চাইছেন।
নেতানিয়াহু সেনাবাহিনীর সাথে রাজনৈতিক ক্ষমতার সম্পর্ক সংস্কারের প্রচেষ্টায় রয়েছেন এবং এই ঐতিহ্যটি ভেঙে দিতে চাইছেন যে, সেনাবাহিনী ইসরায়েলের রাজনৈতিক ব্যবস্থার মূল প্রতিনিধিত্ব করে। তিনি বলেছেন, ‘ইসরায়েল হলো একটি একটি রাষ্ট্র, যার একটি সেনাবাহিনী রয়েছে। ইসরায়েল একটি সেনাবাহিনী নয়, যার একটি রাষ্ট্র রয়েছে।’ তবে ঐতিহাসিক বাস্তবতা দেখায় যে, ইসরায়েলে সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। এর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা প্রায়ই রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করেন।
জেরুজালেম পোস্ট অনুসারে, আল-আকসা ফ্লাডের পর ইসরায়েলি সমাজে তার সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি আস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে ইসরায়েলিদের নিরাপত্তাবোধ কমে গেছে, যা ইসরায়েলের রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।
১৩ আগস্ট, ২০২৪-এ, স্টেট ক্যাম্প পার্টির প্রধান বেনি গ্যান্টজ ইস্রায়েলে সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ সম্পর্কে সতর্কতা পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘যদি আমরা সচেতন না হই, তবে এখানে গৃহযুদ্ধ শুরু হবে।’ গ্যান্টজের মতে, ইসরায়েলে এমন একটি নেতৃত্ব রয়েছে যা জনগণকে বিভক্ত করছে এবং তাদের জীবনের মূল ভিত্তিকে বিষাক্ত করে তুলছে। তিনি আরও বলেন, গৃহযুদ্ধের ঝুঁকি তখনই বাড়ে যখন প্রিয়জনদের হারানো পরিবারের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়, বিক্ষোভকারীদের অধিকার লঙ্ঘিত হয়, অপহৃতদের পরিবারের প্রতি অন্যায় করা হয়, কিংবা অনুগত সরকারি কর্মচারীদের রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়।
গ্যান্টজের এই মন্তব্য আসে নেগেভের ‘এসডি টিমান বেস’ ঘাঁটিতে এক বিক্ষোভের ঘটনার পর, যেখানে চরম ধর্মীয় অধিকারের মুখোশধারী পুরুষেরা ফিলিস্তিনি বন্দীর বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত নয়জন সৈন্যকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে হামলা চালায়। এদের নেতৃত্বে ছিলেন নেগেভের কিছু নেসেট প্রতিনিধিরা।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইসরায়েলের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক আবার সামনে আসে। বিশেষ করে সেনাবাহিনীর মধ্যকার নেতৃত্বের অবস্থানে ধর্মীয় প্রভাব বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে। নেতানিয়াহু সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক প্রভাব কমানোর পরিকল্পনা করেছেন। যদিও সেনাবাহিনী সবসময়ই ইসরায়েলি সমাজের একটি কেন্দ্রীয় শক্তি হিসেবে বিবেচিত। এই পরিবর্তনের চেষ্টা ইসরায়েলি সমাজে তীব্র সংঘর্ষের সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। কিছু ইসরায়েলি প্রস্তাব করছেন যে, সেনাবাহিনীর মধ্যে ধর্মীয় কর্মকর্তাদের উত্তেজনা এড়ানোর জন্য তাদের আলাদা ইউনিটে দলবদ্ধ করা উচিত।
বেন-গুরিয়নের সময়ও সেনাবাহিনী ও সশস্ত্র গ্যাংগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ দেখা গিয়েছিল। তখন হাগানাহ দল ইরগুনের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে এবং ইরগুনের জন্য অস্ত্র বহনকারী একটি জাহাজে বোমাবর্ষণ করে। যার ফলে একজন নিহত হন এবং ইরগুনের অনেক সদস্য গ্রেফতার হন। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে এ ধরনের সংঘর্ষ পুনরায় ঘটলে তা একটি নতুন গৃহযুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে যেহেতু সেনাবাহিনী ইসরায়েলি সমাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। [আল জাজিরা এরাবিক অবলম্বনে]
লেখক: কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক