ইরানের শাসকগোষ্ঠীর কাছে হিজবুল্লাহ কেবল একটি প্রক্সি বাহিনী নয়; বরং এটি একটি শক্তিশালী হাতিয়ার, যা মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা ও ইরানের আঞ্চলিক ক্ষমতাকে সুসংহত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। খোমেনি ও খামেনির নেতৃত্বে ইরান প্রায় চার দশক ধরে হিজবুল্লাহর প্রতি সমর্থন ও বিনিয়োগ করে এসেছে। মৃত্যুর আগে খামেনির প্রকাশনা অফিসের সাথে সংযুক্ত মাসির ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হিজবুল্লাহর প্রয়াত প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ হিজবুল্লাহর গঠন ও বিকাশের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন।
নাসরুল্লাহ তার সাক্ষাৎকারে বলেন, ইরানের বিপ্লবের বিজয়ের পর ও ইসরায়েলের লেবাননে ৪০ শতাংশেরও বেশি ভূখণ্ড দখল করার পর, আব্বাস আল-মুসাভিসহ নয়জন লেবানিজ নেতা ইরানে গিয়ে খোমেনি ও ইরানি কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা খোমেনির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা আপনার নেতৃত্বে আস্থা রাখি, কিন্তু আপনাকে বারবার বিরক্ত করতে পারব না। আমাদের জন্য একজন প্রতিনিধি নিযুক্ত করুন।’ খোমেনি তখনকার প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি আলী খামেনিকে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ করেন এবং বলেন, ‘খামেনি আমার প্রতিনিধি।’
বিজ্ঞাপন
খামেনির নেতৃত্বে হিজবুল্লাহ নিয়মিত তার সাথে পরামর্শ ও বৈঠক করে এসেছে। খোমেনির মৃত্যুর পর, হিজবুল্লাহর নেতারা ইরানে গিয়ে খামেনির সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তাদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়। নাসরুল্লাহ উল্লেখ করেন যে, ফারসি ভাষায় তিনি খামেনির সাথে সরাসরি যোগাযোগ করেছেন ও খামেনি আরবি ভাষায় কথা বলার মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারতেন। ফলে তাদের মধ্যে কোনো যোগাযোগের বাধা ছিল না।
ইরানের বিপ্লবী গার্ডের প্রাক্তন মন্ত্রী মোহসেন রফিকদোস্ত ২০১৭ সালের এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘১৯৮২ সালে খোররামশাহরের স্বাধীনতার পর ইসরায়েল লেবানন আক্রমণ করে, আমরা লেবানন ও সিরিয়াকে সাহায্য করতে গিয়েছিলাম। ইরান থেকে প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করে ২০০ জন সৈন্যকে প্রশিক্ষণের জন্য সেখানে পাঠানো হয়েছিল, যার ফলে লেবাননে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়।’
ইরানের প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী হোসেইন দেহগান বলেন, হিজবুল্লাহর নামকরণ করা হয়েছিল ‘দল কেবল হিজবুল্লাহ, নেতা কেবল রুহুল্লাহ’ স্লোগানটি ভিত্তি করে। হিজবুল্লাহ প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই ইরান বিভিন্ন প্রকার সহায়তা দিয়ে তাদেরকে কার্যকর প্রক্সি বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলে।
বিজ্ঞাপন
১৯৮৩ সালে বৈরুতে ফরাসি ও আমেরিকান বাহিনীর সদর দফতরে দুটি একযোগে বোমা হামলার ঘটনার প্রসঙ্গেও রফিকদোস্ত উল্লেখ করেন যে, এর জন্য প্রয়োজনীয় বিস্ফোরক দ্রব্য তেহরান থেকে আনা হয়েছিল। এই ঘটনার মাধ্যমে হিজবুল্লাহর সক্ষমতা ও ইরানের প্রত্যক্ষ ভূমিকা প্রকাশ পায়। অর্থনৈতিক চাপে থাকা সত্ত্বেও ইরান হিজবুল্লাহর আর্থিক চাহিদা পূরণে অগ্রাধিকার দেয়।
হিজবুল্লাহকে ইরান থেকে বছরে প্রায় ৮০০ মিলিয়ন থেকে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয় বলে অনুমান করা হয়। ইরানের বিপ্লবী গার্ডের অধীনে দক্ষিণ লেবাননের পুনর্গঠন এবং অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পগুলো হিজবুল্লাহর মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। রেভল্যুশনারি গার্ডের সদস্য শাতেরি জানান, ইরান যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ৭৩টি গ্রাম পুনর্গঠন, বৈরুতের শহরতলিতে ৪৫টি স্কুল নির্মাণ এবং ২,২৮০টি নির্মাণ প্রকল্প সম্পন্ন করেছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়, অনেক ইরানি জনগণ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে দিনাতিপাত করছিলেন।
ইরান হিজবুল্লাহকে অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে তাদের সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করে চলেছে এবং লেবাননে ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির সম্ভাবনা প্রতিষ্ঠা করেছে। রেভল্যুশনারি গার্ডের জেনারেলদের মধ্যে কাসেম সোলেইমানি এবং মোহাম্মদ রেজা জাহেদির মতো নেতারা সরাসরি হিজবুল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।
আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের অনেক পরিকল্পনা ইরাক, ইয়েমেন ও ফিলিস্তিনে হিজবুল্লাহর মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এ কারণে হিজবুল্লাহ ইরানের অন্যান্য প্রক্সি বাহিনী থেকে আলাদা ও আরও প্রভাবশালী। সামরিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে ইরানের স্বার্থ রক্ষায় হিজবুল্লাহ বিপ্লবী গার্ডের একটি অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে।
কাসেম সোলেইমানির তুলনায় হাসান নাসরুল্লাহর প্রতি বেশি নির্ভরশীল ছিল ইরান। খামেনির নাসরুল্লাহর প্রতি সমর্থন এতটাই গভীর ছিল যে, মৃত্যুর পর খামেনি বিশেষ শোক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন এবং পাঁচ দিনের শোক ঘোষণা করেন। বলা হয়ে থাকে, ইরানের শাসনব্যবস্থা দুটি স্তম্ভের ওপর নির্ভরশীল: অভ্যন্তরীণ দমন ও বহিরাগত যুদ্ধ। হিজবুল্লাহ এই বাহ্যিক স্তম্ভের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা ইরানের জন্য অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিসরে একটি শক্তিশালী ভূমিকা পালন করছে।
লেখক: কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক