images

আন্তর্জাতিক

‘শত্রু’ থেকে ‘বন্ধু’ হবে কি চীন-অস্ট্রেলিয়া?

আবুল কাশেম

০৬ নভেম্বর ২০২৩, ১১:৫৩ এএম

চারদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে চীন গেছেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ। সফরের সময়ে চীনের সঙ্গে শীতল সম্পর্ককে স্বাভাবিক করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী। দুই দেশের সম্পর্ক অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ হলেও আন্তর্জাতিকভাবে একে অপরে অনেকটা শত্রুর মতো। তবে দুই দেশ আন্তর্জাতিক বিষয়গুলো বাদ দিয়ে অর্থনৈতিক গুরুত্বকে সামনে নিয়ে এগোতে চাইছে।

চীন সফরের সময়ে রাজধানী বেইজিং ও সাংহাইয়ে থাকবেন আলবানিজ। গত সাত বছরের মধ্যে দেশটিতে এই প্রথম অস্ট্রেলিয়ার কোনো প্রধানমন্ত্রী সফরে গেলেন। দুই দেশই নিজেদের মধ্যে দীর্ঘদিনের শীতল সম্পর্ক উষ্ণ করতে চাইছে।

আরও পড়ুন: বদলে যাচ্ছে মহাসাগরগুলোর পানির রং

চীন অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক অংশীদার। রোববার সাংহাইয়ে চায়না ইন্টারন্যাশনাল ইমপোর্ট এক্সপোর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আলবানিজ বলেন, ‘দুই দেশের মধ্যে গঠনমূলক অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়তা করে। এ কারণেই আমার নেতৃত্বাধীন সরকার চীনের সঙ্গে গঠনমূলকভাবে কাজ চালিয়ে যাবে।’

চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ার চেষ্টার বিপরীতে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দেশটির ক্রমবর্ধমান প্রভাবের বিরুদ্ধেও তৎপর অস্ট্রেলিয়া সরকার। প্রধানমন্ত্রী আলবানিজ বলেন, ‘এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পরিস্থিতির উন্নতির ভিত্তিতেই আমরা ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করব। আর এসবের মূল একটি অংশ হলো চীনের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার সম্পর্ক।’

আরও পড়ুন: চীন পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার বাড়াচ্ছে: যুক্তরাষ্ট্র

এদিকে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশটির নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন আলবানিজ। এ সময় দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময় হবে। এ ছাড়া অভিন্ন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হবে। মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েবিন বলেছেন, ‘চীন ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে একটি সুস্থ ও স্থিতিশীল সম্পর্ক দুই দেশ ও জনগণের মৌলিক স্বার্থের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।’

চীনকে কাউন্টার দিতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গঠিত কোয়াডের সদস্য অস্ট্রেলিয়া। তাদেরকে পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন সাবমেরিন তৈরিতে প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম সরবরাহ দেওয়ার কথা যুক্তরাষ্ট্রের। এ নিয়ে চীন বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায়। কিন্তু বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এসব সম্পর্ক বড় নয়। এটাই প্রমাণ করতে যাচ্ছে চীন ও অস্ট্রেলিয়া।

ওয়াশিংটনের সঙ্গে ক্যানবেরা যখন সামরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করেছে এবং চীনের সঙ্গে যখন নিজেদের সম্পর্কে অবনতি ঘটেছে, তখন চীন সফর করছেন অ্যান্থনি আলবানেজ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একে অন্যের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ করে এসেছে চীন ও অস্ট্রেলিয়া। ধারণা করা হয় একে অন্যের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এসব বিষয়ে সাধারণ মানুষের ধারণা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে নেতিবাচক।

china_australia_1
সাংহাইয়ে চায়না ইন্টারন্যাশনাল ইমপোর্ট এক্সপোর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আলবানিজ। ছবি: এএফপি

তবে বাণিজ্য দেশ দুটি একে অন্যকে এড়িয়ে চলার সামর্থ রাখে না। ২০২০ সালে তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল সর্বোচ্চ বা পিকে। অস্ট্রেলিয়ার রপ্তানির প্রায় অর্ধেকই গেছে চীনে। তুলনামূলকভাবে একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানির শতকরা প্রায় ৯ ভাগ এবং বৃটেনের শতকরা প্রায় ৫ ভাগ বিক্রি হয়েছে চীনে।

২০২০ সালে করোনা ভাইরাসের উৎস সম্পর্কে নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু সেসব বিষয় এখন গুরুত্বপূর্ণ নয়। বাণিজ্যিক সুবিধাকে দৃশ্যত সবচেয়ে শক্তিধর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবে সরকার। ক্যানবেরায় অবস্থিত অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ জ্যান গোলি বলেন, অস্ট্রেলিয়ার ওই দাবি চীন সরকারকে গভীরভাবে হতাশ করেছিল। তার পরপরই চীনের রাষ্ট্রদূত একটি বক্তব্য দিয়েছিলেন। তিনি বুঝাতে চেয়েছিলেন যে, এর ফলে অস্ট্রেলিয়ার কিছু শিল্পখাত দুর্ভোগে পড়তে পারে।

আরও পড়ুন: কুশতেপা খাল: তালেবানের মেগা প্রজেক্টে বদলে যাচ্ছে আফগানিস্তান

ঠিকই অস্ট্রেলিয়ার প্রায় ২০০০ কোটি ডলারের বাণিজ্যিক পণ্যের ওপর চীন শুল্ক আরোপ করে এবং বিধিনিষেধ দেয়। গরুর মাংস, ওয়াইন, কয়লা, কাঠ এবং চিংড়ি ছাড়া বেশির ভাগ পণ্য এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

প্রফেসর গোলি বলেন, চীনকে ছাড়া আমরা টিকে থাকতে পারবো না। আমি মনে করি আলবানিজ সরকার পরিষ্কার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক এতই গুরুত্বপূর্ণ যে তাতে কিছু ত্যাগ করতে হবে। আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ককে উন্নত করতে হবে। 

অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ন্যাশনাল সিকিউরিটি কলেজের রিসার্স ফেলো বেনজামিন হার্শকোভিচ বলেন, গভীরভাবে অর্থনৈতিকভাবে একে অপরের ওপর নির্ভরশীল চীন ও অস্ট্রেলিয়া। বিস্তৃত ও বর্ধনশীল অর্থনীতির চাকাকে সঠিক পথে রাখতে হলে কাঁচামালের ওপর উচ্চ মাত্রায় অস্ট্রেলিয়ার ওপর নির্ভরশীল চীন।

আরও পড়ুন: কীভাবে ‘আলাদিনের চেরাগ’ পেল শ্রীলঙ্কা

গত বছরের মে মাসে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে আলবানিজের সরকার দ্বিমুখী চীন কৌশল অনুসরণ করেছে। প্রশান্ত মহাসাগরে বেইজিংয়ের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবেলা করার পাশাপাশি বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদারের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা চালিয়ে আসছে তারা। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, অস্ট্রেলিয়া ও চীন উভয়েই সম্পর্ক নতুন করে ঝালাইয়ের ব্যাপারে আশাবাদী।

চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী গফ হুইটলাম ১৯৭৩ সালে বেইজিং সফর করেছিলেন। ওই সফরের ৫০ বছর পর সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য চীনে পা রাখছেন আলবানিজি। চীন-অস্ট্রেলিয়া সম্পর্ক শুরু থেকেই ‘পারস্পরিক সুবিধার’ ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। চীন অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে রূপান্তরিত হওয়ায় দেশটির শিল্প-কারখানার জন্য অস্ট্রেলিয়ার লোহা, কয়লা ও গ্যাসের মতো পণ্যের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে। এ বাবদ রপ্তানি আয় অস্ট্রেলিয়াকে বৈশ্বিক মন্দা মোকাবেলায় সহায়তা করেছে।

একে