মাহাবুল ইসলাম
২২ আগস্ট ২০২৫, ০২:০৬ পিএম
*৩ বছরের প্রকল্প মেয়াদ শেষে বাস্তবায়ন প্রায় শূন্য!
* নতুন প্ল্যানে ব্যয় বাড়ল প্রায় ৮০ শতাংশ
*ভিজিবিলিটি টেস্ট না করেও বাস্তবায়নে হাত দিয়ে ধরা!
*পদে পদে অদক্ষতা ও খোঁড়া অজুহাত
*ইকো সিস্টেমটাই নষ্ট হয়ে গেছে, নেই জবাবদিহিতাও; ভুগছে জনগণ: বিশেষজ্ঞ মতামত
দেশে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটসহ নানান কারণে অগ্নিকাণ্ডে—সব মিলিয়ে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ দগ্ধ হয়। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পর্যবেক্ষণ বলছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৩ লাখ ৬৫ হাজার মানুষ অগ্নিদগ্ধ হন। এর মধ্যে প্রায় ৫ হাজার ৬০০ মানুষ মারা যান। উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে বাংলাদেশে বার্ন রোগীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হলেও চিকিৎসা সুবিধা তুলনামূলকভাবে অপ্রতুল। ঢাকার বাইরে প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী এখনও উন্নত বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারির সেবা থেকে বঞ্চিত। এই বাস্তবতায় সরকার ২০১৭ সালে উদ্যোগ নেয়। যেটি ২০২২ সালে ‘৫টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট স্থাপন প্রকল্প’ নামে একনেকে অনুমোদন হয়। প্রকল্পটি ২০২৫ এর জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মেয়াদ শেষে অগ্রগতি তো নেই, বরং নতুন পরিকল্পনায় ব্যয় বাড়ল ৮০ শতাংশ! একদিকে বহুমুখী সংকটে ধুঁকছে পোড়া রোগীর চিকিৎসা সেবা, অন্যদিকে চলছে উদাসীনতা ও অজুহাত আর ব্যয় বৃদ্ধির খেলা!
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুরু থেকেই প্রকল্পের পথচলায় দেখা দিয়েছে নানা জটিলতা। সময়মতো শেষ না হয়ে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, কোথাও আবার কাজ শুরু করতে গিয়ে পড়তে হয়েছে বিড়ম্বনায়। নতুন পরিকল্পনায় এবার ব্যয় বেড়েছে দ্বিগুণের কাছাকাছি। অগ্নিদগ্ধ রোগীরা যখন সংকটে চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুবরণ করছে, তখন প্রকল্প বাস্তবায়নে এই দেরি ও ব্যয় বৃদ্ধি জনমনে তীব্র সমালোচনা তৈরি করেছে।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালের অক্টোবরে সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্ট (SFD)-এর সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে প্রকল্পটির আর্থিক ভিত্তি গড়ে ওঠে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে একনেকের (ECNEC) অনুমোদন পায় এটি। ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে প্রশাসনিক অনুমোদন দেওয়া হয়।
>> আরও পড়তে পারেন
মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত ৩ বছর ৬ মাস মেয়াদে ৪৫৬ কোটি টাকায় প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা ছিল। এর মধ্যে সরকারের অর্থায়ন ২০২ কোটি ১৬ লাখ টাকা এবং সৌদি ফান্ড ঋণ ২৫৩ কোটি ৯২ লাখ টাকা। লক্ষ্য ছিল- রাজশাহী, রংপুর, বরিশাল, সিলেট ও ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০০ শয্যার বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট স্থাপন। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে দেশের প্রায় ৬০ মিলিয়ন মানুষের বিশেষায়িত বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে। পোড়ার পর ৪-৬ ঘণ্টা গোল্ডেন সময় ধরা হয়। এ সময়ের মধ্যে চিকিৎসা শুরু করা হলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় এ সকল জেলায় পোড়া রোগজনিত অসুস্থতা ও মৃত্যুহার হ্রাস করা সম্ভব হবে। এটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবার কার্যকারিতা উন্নত করবে। এতে মানুষের দুর্ভোগ কমবে, জীবন বাঁচবে। চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা হ্রাস পাবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে ঢাকাসহ পার্শ্ববর্তী জেলাসমূহের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর চাপ কমবে যা খুবই অর্থবহ ও সময়োপযোগী এবং অন্যান্য জেলাসদর হাসপাতালগুলোতে চাপ কমাতে সহায়ক হবে।
খোঁড়া অজুহাতে স্থবির প্রকল্পের গতি
ভিজিবিলিটি টেস্ট না করায় প্রকল্প বাস্তবায়নে পদে পদে বাঁধা তৈরি হয়। পরে বাধ্য হয়ে সংযোজন-বিয়োজন করতে হয়। প্রকল্প সংশোধনের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কোভিড-১৯ মহামারিকে দায়ী করেছে। এছাড়া স্থান নির্বাচনে জটিলতা। যেমন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিদ্যমান ভবনের ওপর নতুন তলা নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছিলো। যেটি এখন পরিবর্তন করা হয়েছে। এছাড়া গণপূর্তের নতুন রেট-শিডিউল ও নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধিকে দায়ী করা হয়েছে।
নতুন ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত
প্রকল্পটির শুরুতেই ভুল সিদ্ধান্তের কারণে কাজে স্থবিরতা নামে। পুরোনো ভবনে দেখা দেয় ফাটল। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের পাশের ভবনে ফাটলও দেখা দেয়। এ কারণে বাধ্য হয়েই কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছে। প্রকল্প সংশোধনে উর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ বাদ দিয়ে ১১তলা নতুন ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
ব্যয় বৃদ্ধি
প্রকল্পের সংশোধিত ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৮১৬ কোটি ১৯ লাখ ৮ হাজার টাকা। প্রাথমিক ব্যয়ের তুলনায় প্রায় ৩৬০ কোটি টাকা বেড়েছে। এতে সরকারি অর্থায়ন বেড়েছে ২০২ কোটি থেকে ৪৬৪ কোটি টাকায়। যা ১২৯.৮৯ শতাংশ বৃদ্ধি। বিদেশি ঋণ বেড়েছে ২৫৩ কোটি থেকে ৩৫১ কোটি টাকায়। যা ৩৮.৪০ শতাংশ বৃদ্ধি। গড়ে ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৮০ শতাংশ।
এই ব্যয় বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে- নতুন ভবন নির্মাণ, চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানি, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি স্থাপন, মানবসম্পদ, প্রশিক্ষণ ও প্রশাসনিক ব্যয় বৃদ্ধি।
তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এখানে ‘অজুহাতের খেলা’ চলছে। এটি এক ধরনের ‘প্রকল্প ফাঁদ’—যেখানে সময় ও ব্যয় দুটোই ক্রমাগত বাড়ানো হয়। অথচ বাস্তব সুবিধা পেতে সাধারণ মানুষকে অপেক্ষা করতে হয় বছর পর বছর। অনেক প্রকল্পেই প্রথমে কম খরচ দেখিয়ে অনুমোদন নেওয়া হয়, পরে ধাপে ধাপে সংশোধনের মাধ্যমে ব্যয় বাড়ানো হয়। এই প্রকল্পও তার ব্যতিক্রম নয়। জনগুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পের সুবিধা আরও তিন বছর পর আদৌ কতটা পাওয়া যাবে? তা নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করছেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ ঢাকা মেইলকে বলেন, এসব প্রকল্প সাধারণ পলিটিক্যাল আপিল থাকে। লোক দেখানোর জন্য প্রকল্প নেওয়া হয়। এই প্রকল্প নিলে তাদেরও রুজি-রুটির ব্যবস্থা হয়। আমরা যদি জনগণের স্বার্থে কাজ করতাম তাহলে যে সময়ে কাজ শেষ হয়ে সুবিধা দৃশ্যমান হওয়ার কথা, সে সময়ে প্রকল্প সংশোধন করতে হতো না। এছাড়া এই প্রকল্পের মেয়াদ যে আরও তিন বছর বাড়ানো হলো, এই তিন বছর শেষেও দেখা যাবে, নতুন কোনো অজুহাতের জাল!
>> আরও পড়তে পারেন
‘একসঙ্গে এত বাচ্চার চিকিৎসা আগে হয়নি, চিকিৎসকরাও সেদিন কেঁদেছেন’
তিনি আরও বলেন, ফিজিবিলিটি টেস্টের সময় এর সুবিধা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এভাবে সময় বাড়ল সেই সুবিধা তো আর থাকে না। আসলে আমাদের এখানে অনিয়মটাই নিয়মে পরিণত হয়েছে। আর আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, তিন বছরের প্রকল্প কখনো তিন বছরে শেষ হয় না। আমাদের সময় নির্ধারণ বা কাজের ক্ষেত্রে এক ধরনের পিঠ বাঁচানোর কালচার আছে। এখানে জনগণের সেন্টিমেন্ট বুঝে কাজ করা হয় না। এই প্রকল্প সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে মধ্যের এই সময়ে যে অনেকগুলো বঞ্চিত হবে, মারা যাবে-সেজন্য যে জবাবদিহিতা সেটি নেই। আবার পরকালেও যে জবাবদিহি করতে হবে, এই হিসাবটাও কারও মধ্যে নেই।
অগ্নিদগ্ধ হওয়ার পর প্রথম যে ৪-৫ ঘণ্টা। যেটিকে গোল্ডেন টাইম বলা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই সময়টাকে কার্যকরভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এছাড়া পোড়ার হার বেশি হলে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পথেই ঝরে যাচ্ছে অনেকের প্রাণ। সক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত রোগী থাকায় জেলা ও বিভাগীয় হাসপাতালে এসেও রোগীদের সংক্রমণ বাড়ছে। এতে রোগী মৃত্যুর হার বাড়ছে। বাড়ছে দুর্ভোগ।
প্রকল্পে যা বদলালো
রাজশাহী, রংপুর, বরিশাল, সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিদ্যমান ICU ভবনের ওপর ৪তলা সম্প্রসারণ বাদ দিয়ে নতুন করে ১১তলা ভবন নির্মাণ যুক্ত হলো।
ফরিদপুরে OP ভবনের ৬ষ্ঠ ও ৭ম তলা সংস্কার বাদ দিয়ে নতুন ৬ তলা ভবন নির্মাণ যুক্ত হলো। এছাড়া প্রকল্পে নতুন পাঁচটি ব্যয়ের খাত যুক্ত করা হয়েছে। এগুলো হলো-বিশেষ ভাতা, মোবাইল/সেলফোন, স্ট্যাম্প ও সিল, অনুষ্ঠান ও উৎসব খরচ।
অগ্নিদগ্ধ রোগীর সংকট
একই সময়ে মাঠপর্যায়ে বাস্তবতা ভয়াবহ। সুব্যবস্থাপনার অভাব, চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ও নানা সংকটে ভুগছে পোড়া রোগীরা। ঢাকার জাতীয় বার্ন ইন্সটিটিউট ছাড়া দেশের কোথাও নেই বিশেষায়িত কোনো কেন্দ্র। এতে কেউ ধুঁকে ধুঁকে মরছে। কেউ হারাচ্ছে অঙ্গ।
চিকিৎসকরা বলছেন, অগ্নিদগ্ধ হওয়ার পর প্রথম যে ৪-৫ ঘণ্টা। যেটিকে গোল্ডেন টাইম বলা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই সময়টাকে কার্যকরভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এছাড়া পোড়ার হার বেশি হলে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পথেই ঝরে যাচ্ছে অনেকের প্রাণ। সক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত রোগী থাকায় জেলা ও বিভাগীয় হাসপাতালে এসেও রোগীদের সংক্রমণ বাড়ছে। এতে রোগী মৃত্যুর হার বাড়ছে। বাড়ছে দুর্ভোগ।
>> আরও পড়তে পারেন
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের প্রধান আফরোজা নাজনীন আশা ঢাকা মেইলকে বলেন, ১০০ শয্যার ইউনিটটি হলে সেবার পরিসর ও সুযোগ সুবিধা বাড়বে। স্বাভাবিকভাবেই রোগীরা উন্নত চিকিৎসা পাবেন। যেটি এখন নিশ্চিত করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। পর্যাপ্ত স্পেস না থাকায় সংক্রমণ ঝুঁকিটা বেড়ে যাচ্ছে। জরুরি মুহূর্তে আইসিইউ সুবিধা দিতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। নতুন ইউনিটটি হলে এই সংকটগুলো আর থাকবে না।
এ বিষয়ে জানতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফরের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এমআই/এএস