সাখাওয়াত হোসাইন
১২ জুলাই ২০২৫, ০৯:৪৯ পিএম
এডিস মশাবাহী ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ সাধারণত এতদিন নগরকেন্দ্রিক লক্ষ্য করা গেলেও গত কয়েক বছর ধরে তা গ্রামে-গঞ্জেও ছড়িয়ে পড়ছে। প্রতিবারের মতো এবারও মশাবাহিত রোগটি হানা দিয়েছে। তবে এবার রাজধানী ঢাকার চেয়ে বাইরের জেলাগুলোতে প্রকোপ বেশি রয়েছে। বিশেষ করে বরিশাল বিভাগে ডেঙ্গুর প্রকোপ আশঙ্কাজনক রূপ নিচ্ছে। উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ডেঙ্গু আশঙ্কাজনক রূপ নিচ্ছে। অথচ পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য নেই পর্যাপ্ত প্রস্তুতি। এতে স্বাস্থ্য খাতে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সবশেষ শনিবার (১২ জুলাই) বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরও ৩৯১ জন। আর এই সময়ের মধ্যে মারা গেছেন একজন। বরাবরের মতো বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। এ সময় বিভাগটিতে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) আক্রান্ত হয়েছেন সর্বোচ্চ ১২৮ জন। নতুন আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৮৩ জন।
জুলাইয়ের ১২ দিনে সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এসময় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন চার হাজার ১৬৪ জন রোগী। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১০ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১৪ হাজার ৪৬০ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং ৫৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে রয়েছে শিশু, নারী, কিশোর, বৃদ্ধ সবাই। সব বয়সীদেরই ভোগাচ্ছে ডেঙ্গু।
আরও পড়ুন
পরিসংখ্যান বলছে, গেল জুন মাস থেকেই ডেঙ্গুর প্রকোপ উচ্চ হারে বাড়ছে। এ বছর ঢাকার চেয়ে ডেঙ্গু বেশি ছড়াচ্ছে বাইরে। এখন পর্যন্ত বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এই বিভাগে মারা গেছেন ১৪ জন। গত বছরের তুলনায় এই বিভাগে রোগী বেড়েছে প্রায় ১১ গুণ। আর মৃত্যু বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। গেল বছর এই ধরনের প্রকোপ দেখা গিয়েছিল চট্টগ্রাম বিভাগে।

গত বছর জানুয়ারিতে ১ হাজার ৫৫ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৩৯, মার্চে ৩১১, এপ্রিলে ৫০৪, মেতে ১ হাজার ৭৭৩ এবং জুনে ৭৯৮ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ১৪ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩, মার্চে ৫, এপ্রিলে ২, মেতে ১২ এবং জুনে ৮ জন মারা গেছেন।
অন্যদিকে, এই বছর জানুয়ারিতে ১ হাজার ১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪, মার্চে ৩৩৬, এপ্রিলে ৭০১, মেতে ১ হাজার ৭৭৩ এবং জুনে ৫ হাজার ৯৫১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ১০ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩, এপ্রিলে ৭, মেতে ৩ এবং জুনে ১৯ জন মারা গেছেন।
ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ, বিপর্যয়ের শঙ্কা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ কমাতে হলে মশা নিধনের পাশাপাশি বাড়ির আশেপাশে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। একইসঙ্গে জ্বর হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে ডেঙ্গু নিধন কার্যক্রম আরও জোরালো করতে হবে। বাড়াতে হবে জনসচেতনতা।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ডেঙ্গু শুধু বেড়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা এরমধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। ঢাকায় অল্পসংখ্যক আক্রান্ত হচ্ছে আর বাকিটা ঢাকার বাহিরে আক্রান্ত হচ্ছে। বরগুনাকে ধরে জেলা শহরগুলোকে যদি মূল্যায়ন করি তাহলে আমাদের জন্য বড় একটা আশঙ্কার ব্যাপার। বরগুনার গ্রাম-গঞ্জে সবখানে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। আর এডিস মশা নিধনে কার্যক্রমও চোখে পড়ার মতো নয়।’
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘ডেঙ্গুর ভালো চিকিৎসাও বরগুনায় নেই, নেই আইসিইউ সুবিধা, এই পরিস্থিতি শুধু রবগুনার নয়, সারাদেশের। একদিকে মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে, অন্যদিকে ভালো চিকিৎসা সুবিধা নেই। ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন জেলার পরিস্থিতিও খারাপ হচ্ছে। এভাবে মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হতে থাকলে সারাদেশে একটা স্বাস্থ্য বিপর্যয় ঘটতে পারে।’
বেনজির আহমেদ বলেন, ‘বরগুনার মতো গাইবান্ধা, নীলফামারী, কুড়িগ্রামসহ অন্যান্য জেলাতেও আক্রান্ত হচ্ছে। এটা উদ্বেগের বিষয়। ঢাকার বাহিরে চিকিৎসা ব্যবস্থা ভালো নেই, আর চিকিৎসার সুযোগও সীমিত। অথচ ঢাকার চেয়ে গ্রাম-গঞ্জে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে এবং ভোগান্তির শিকার হচ্ছে।’
অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ আরও বলেন, ‘ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে যতজন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে, তার অন্তত আট থেকে দশগুণ মানুষ বাহিরে আছে। আর অনেকে ডেঙ্গু পরীক্ষাও করেন না। আর আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগ যে তথ্যটা দেয়, সেটা প্রকৃত নয়। আরও বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। গ্রামের ডেঙ্গু হচ্ছে, সেখানে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে নেই কার্যক্রম। গ্রামের মানুষ চিকিৎসাও পাচ্ছেন না, গ্রামের সেভাবে চিকিৎসক-নার্স নেই। এজন্য ভালো ব্যবস্থাপনা ও অর্থ বরাদ্দ করা প্রয়োজন।’

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. রত্না দাশ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ডেঙ্গু মোকাবিলায় জনসাধারণকে সচেতন হতে হবে। বাসা-বাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। পানি জমিয়ে রাখা যাবে না। ঘুমানোর আগে মশারি টাঙিয়ে নিতে হবে, যাতে মশা থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায়। সবার আগে নিজেকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে।’
বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, ‘এডিস মশার উপদ্রব বেড়ে যাচ্ছে। মশা নিধনের কার্যক্রম আরও বাড়াতে হবে। সেইসঙ্গে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সঠিক সময়ে চিকিৎসা গ্রহণ এবং হাসপাতালে ভর্তি হওয়াই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ডেঙ্গু এখন আর আগের মতো সহজভাবে মোকাবিলা করার অবস্থায় নেই। ডেঙ্গুর ধরন বদলেছে। এখন রোগীদের মধ্যে জটিল উপসর্গ বেশি দেখা যাচ্ছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই রোগীকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হয়।’
এই চিকিৎসক বলেন, ‘বরগুনায় কিছু দিন আগে ডেঙ্গুর একটি আউটব্রেক দেখা দিলেও বর্তমানে তা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে সারাদেশে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। ডেঙ্গু মোকাবিলায় সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। জ্বর হলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। সময় মতো চিকিৎসা নিলে জটিলতা এড়ানো সম্ভব।’
স্বাস্থ্যের মহাপরিচালক বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগী শকে চলে গেলে সেখান থেকে রিভার্স করা যায় না। এজন্য জরুরি হচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব রোগটি শনাক্ত করা।’
আইইডিসিআরের সাবেক মুখ্য কীটতত্ত্ববিদ তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘অপরিকল্পিত নগরায়ন ও অব্যবস্থাপনাকে ডেঙ্গু বিস্তারের কারণ হিসেবে অবশ্যই ধরতে পারি। কিন্তু ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিসের বিস্তারে বৃষ্টি, তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা—এই তিনের মিলিত ভূমিকা আছে। কয়েক দশক ধরে এসবের মধ্যে একধরনের অস্বাভাবিকতা দেখা যাচ্ছে। তাই জলবায়ু পরিবর্তন দেশের ডেঙ্গুর বিস্তারে বড় ভূমিকা রাখছে। দেশজুড়ে ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটছে।’
এসএইচ/জেবি