images

হেলথ

ডেঙ্গুর নাজুক পরিস্থিতিতে মৌসুমি জ্বরের প্রকোপ

মাহফুজ উল্লাহ হিমু

২৫ আগস্ট ২০২৩, ১২:০১ পিএম

ষড়ঋতুর বাংলাদেশে ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জ্বর-সর্দি অতি সাধারণ ও পরিচিত একটি বিষয়। তবে চলতি বছরে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রেকর্ড প্রদুর্ভাবে তা যেন এক মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। কোনটা সাধারণ জ্বর আর কোনটা ডেঙ্গু তা নিয়ে বিভ্রান্ত হচ্ছেন রোগীরা। অনেকে ডেঙ্গু নয় ভেবে পর্যাপ্ত সাবধানতা অবলম্বন না করায় জটিল অবস্থা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। এতে ডেঙ্গুতে জটিল রোগ ও মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে। আবার ডেঙ্গু পরীক্ষায় নেগেটিভ আসলেও জ্বর ও নানাবিধ জটিলতায় রোগীদের ভুগতে হচ্ছে দীর্ঘদিন। 

তেমনই একজন রাজধানীর মগবাজার ওয়ারলেসের বাসিন্দা আব্দুল্লাহ আল মামুন (ছদ্মনাম)। টানা তিনদিন জ্বর, মাথা ও শরীর ব্যথায় ভোগার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ডেঙ্গু টেস্ট করান তিনি। এ সময়ে তার জ্বর ৯৯ থেকে ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের মধ্যে থাকায় চিকিৎসক এটাকে সিজনাল জ্বর হিসেবে ধারণা করলেও নিশ্চিত হতে ডেঙ্গু পরীক্ষার পরামর্শ দেন। এতে তার ডেঙ্গু নেগেটিভ শনাক্ত হয়। একইসঙ্গে সিবিসিসহ অপরাপর পরীক্ষার ফলও স্বাভাবিক আসে। তবে ডেঙ্গু নেগেটিভ হলেও তিনি এক সপ্তাহের অধিক সময় মাথা ব্যথাসহ শারীরিক নানা জটিলতায় ভুগেছেন। 

জানতে চাইলে ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, আমার হঠাৎ করেই জ্বর এসেছিল। তবে তা ১০০ ডিগ্রির উপরে ওঠেনি। কিন্তু প্রচণ্ড মাথা ও শরীর ব্যথা এবং বমি-বমি ভাব ছিল। এ অবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শে এনএস-১ ও সিবিসি পরীক্ষা করাই। পরীক্ষা ডেঙ্গু নেগেটিভ আসে। তবে এক সপ্তাহের বেশি সময় আমাকে ভোগান্তি সহ্য করতে হয়েছে।

>> আরও পড়ুন: ডেঙ্গুতে নারীদের মৃত্যুর হার বেশি, কী বলছেন চিকিৎসকরা

মামুনের মতো জ্বরে আক্রান্ত এমন রোগী এখন সারাদেশে অসংখ্য রয়েছে। প্রায় প্রতিটি পরিবারের কেউ না কেউ সাম্প্রতিক সময়ে জ্বরে ভুগেছেন আবার সুস্থও হয়েছে। তবে এর মধ্যে অনেকেই রয়েছেন যারা জ্বরে ভুগলেও ডেঙ্গু পরীক্ষা বা চিকিৎসা গ্রহণ করেননি। ফলে তারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন নাকি সাধারণ জ্বর তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। আবার ডেঙ্গু পরীক্ষা করলেও হাসপাতালে ভর্তি না হওয়া রোগীরা গণনায় আসছেন না। আবার কতজন রোগী পরীক্ষা করাচ্ছেন, তাদের মধ্যে শনাক্তের হার কত সেই তথ্যও নেই স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে।

জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের কত শতাংশ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত?

হাসপাতালের অন্তঃবিভাগ ও বহির্বিভাগে রোগীদের চাপ ও জ্বরে ভোগা বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে কথা বলে ধারণা করা যায় যে, দেশে জ্বরের প্রকোপ বেড়েছে। তবে সংখ্যাটা ঠিক কত বা তাদের কত শতাংশ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত তা জানা সম্ভব হয়নি। কেননা, এ বিষয়গুলোর দেখভাল করা স্বাস্থ্য অধিদফতরের এমআইএস ও কন্ট্রোল বিভাগের কাছে এ সংক্রান্ত পর্যাপ্ত তথ্য নেই। এমনকি ঠিক কত সংখ্যক মানুষ ডেঙ্গু পরীক্ষা করেছেন এবং তাদের মধ্যে কতজন আক্রান্ত হয়েছেন, সেই তথ্যও নেই বিভাগটির কাছে।

 

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের পক্ষ থেকে ঢাকা মেইলকে বলা হয়, কতজন ডেঙ্গু পরীক্ষা করছেন এই তথ্যটি আমাদের কাছে আসে না। ফলে পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার কত সেই তথ্য আমাদের কাছে নেই। যারা আক্রান্ত হচ্ছেন বা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে আমাদের কাছে বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে সেই তথ্যটুকুই শুধু রয়েছে। এছাড়া মৃত্যুর তথ্য আমাদের কাছে আসে। আমরা সেই তথ্যের আলোকে নারী-পুরুষসহ বয়সভিত্তিক বিভাগজনসহ এলকাভিত্তিক বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরি। যা স্বাস্থ্য অধিদফতরের ওয়েবসাইটে সকলের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে।

>> আরও পড়ুন: ডেঙ্গু: মশা নিধনে ব্যর্থতাকে দায়ী করলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী

সিজনাল জ্বরের রোগী বেড়েছে কিনা জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের এখানে তো সাধারণ জ্বর নিয়ে কেউ ভর্তি হয় না। কারো যাদি সিজনাল জ্বরের সাথে অন্য কোনো জটিলতা থাকে সেক্ষেত্রে তারা ভর্তি হয়। এ ধরনের অল্প কিছু রোগী বর্তমানে ভর্তি রয়েছে। এছাড়া বহির্বিভাগে জ্বর বা এই ধরনের সমস্যা নিয়ে নিয়মিত রোগীরা চিকিৎসকের পরামর্শ নেন। এর মধ্যে সিজনাল বা সাধারণ জ্বর নিয়ে কতজন আসছে সেটি তথ্য নিয়ে বলতে হবে।

 

সতর্ক থাকার পরামর্শ 

দেশে সিজনাল জ্বরের প্রদুর্ভাব খুবই স্বাভাবিক বিষয়। তবে এ বছরে যেহেতু একই সময়ে ডেঙ্গুর প্রদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে তাই অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শ বিষেশজ্ঞদের। তাদের মতে সাধারণ জ্বর খুব একটা মারাত্মক না হলেও ডেঙ্গু প্রাণঘাতী হতে পারে। তাই সবার আগে ডেঙ্গু কিনা তা নিশ্চিত হওয়া জরুরি। একইসঙ্গে ডেঙ্গু শনাক্তে করা এনএস-১ পরীক্ষায় নেগেটিভ আসা মানেই ডেঙ্গু হয়নি ভেবে চিকিৎসা না গ্রহণের বিষয়ে সাবধান করেন তারা।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এমিরেটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ঢাকা মেইলকে বলেন, এই সময়টায় জ্বরের প্রকোপ সাধরণত কিছুটা বাড়ে। চলতি বছরেও আমরা তা দেখতে পাচ্ছি। তবে এ বছর ডেঙ্গুর সংক্রমণ ভয়াবহ অবস্থায় থাকায় তা আগে ভাবতে হচ্ছে। অনেকে পরীক্ষার করার পর নেগেটিভ আসলেও জ্বরে ভুগছেন। এতে আক্রান্ত বেশিরভাগ মানুষ সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা বা সিজনাল জ্বরে আক্রন্ত হতে পারেন। তবে নেগেটিভ আসলেই তার ডেঙ্গু নেই, এটি বলা যাবে না।

>> আরও পড়ুন: আরও ৮ মৃত্যু, একদিনে হাসপাতালে ২২০১ ডেঙ্গু রোগী

এই এমিরেটাস অধ্যাপক বলেন, ডেঙ্গু পরীক্ষায় ব্যবহৃত এনএস-১ এর নির্ভুলতার হার ৮০ ভাগ, অর্থাৎ ২০ ভাগ ফলস নেগেটিভ আসার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই শুধুমাত্র টেস্টের ফলাফল দেখে ডেঙ্গু আছে বা নেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত না। সাধারণ জ্বর ও ডেঙ্গুর লক্ষণে তেমন বড় পার্থক্য না থাকলেও অল্প বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। বিশেষ করে রক্তের প্লাটিলেট কাউন্টে। টেস্ট নেগেটিভ আসলে ডেঙ্গু নেই বলে যেন সেই রোগী ও চিকিৎসক জ্বরকে অবহেলা না করে সে দিকে লক্ষ্য রাখেতে হবে। ওই ব্যক্তি সাধারণ জ্বরেও আক্রান্ত হতে পারে কিন্তু ডেঙ্গুটা তো অত্যন্ত বিপদজনক।

সাবধানতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, যদি কারো ১০৩ থেকে ১০৪ ডিগ্রি জ্বরসহ ডেঙ্গুর লক্ষণ থাকে, সিবিসি পরীক্ষায় যদি প্লাটিলেট কমছে দেখা যায়, বিশেষ করে এক লাখের থেকে কম থাকে। তাহলে নেগেটিভ আসলেও তার ডেঙ্গুর চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া দরকার। তাই এ বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। রোগীকে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। বাসায় থেকে যদি সাধারণ জ্বর ভেবে চিকিৎসা না নেন তাহলে তা জটিল আকার ধারণ করতে পারে। এমনকি মৃত্যুর কারণ পর্যন্ত হতে পারে। 

এমএইচ/এএস