images

শিক্ষা

ঢাবিতে উদ্বৃত্ত থাকছে গবেষণা বরাদ্দ, তবু কেন নিজস্ব ফান্ড?

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক

২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০১:২০ পিএম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাতে মানোন্নয়নের লক্ষে দীর্ঘদিন ধরেই একটি নিজস্ব তহবিল গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে আসছিল কর্তৃপক্ষ। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৬ সেপ্টেম্বর প্রাথমিক দাতাদের এক কোটি ১১ লাখ টাকা দিয়ে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেছে ‘দ্যা ঢাকা ইউনিভার্সিটি ফান্ড’।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার জন্য সরকারি বরাদ্দ যেখানে ৫০ শতাংশের বেশি উদ্বৃত্ত থাকছে সেখানে নিজস্ব এই ফান্ড গঠন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। যদিও কর্তৃপক্ষ বলছে, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের বরাদ্দ পেতে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে প্রতি বারই তার একটি বড় অংশ ফেরত যায়। এছাড়া উন্নতমানের গবেষণার জন্য সরকারি বরাদ্দের ওপর নির্ভরশীলতা যথেষ্ট নয়। এর জন্য নিজস্ব বরাদ্দের কোনো বিকল্প নেই।

গবেষণায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ফান্ড গঠন প্রসঙ্গে এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান বলেন, ২০১২ সালে আমি সিন্ডিকেট মেম্বার থাকাকালীন প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ফান্ডের বিষয়টি আলোচলায় এনেছিলাম। সরকারের বরাদ্দকৃত যে বাজেট সে বাজেটের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের। তখনই আমি উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলাম যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি স্বতন্ত্র তহবিল থাকা প্রয়োজন। যেই তহবিল বিশ্ববিদ্যালয় তার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত করতে পারবে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট খুবই অপ্রতুল উল্লেখ করে কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ১০৩ বছর পুরনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট মাত্র ১৫ কোটি টাকা। আমাদের পক্ষে গবেষণায় ততটুকুই করা সম্ভব যতটুকু বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) আমাদের বরাদ্দ দিয়ে থাকে। 

ফেরত যাচ্ছে গবেষণা বরাদ্দের বড় অংশ

গবেষণায় ইউজিসির বাজেট বরাদ্দে অপ্রতুলতার কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি নির্ধারকদের মুখে উঠে আসা সর্বোপরি বিশ্ববিদ্যালযের নিজস্ব ফান্ডের প্রয়োজনীয়তা লক্ষ্য করা গেলেও তথ্য উপাত্ত বলছে ভিন্নকথা।  

আরও পড়ুন: উদ্বোধনের দিনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফান্ডের সংগ্রহ ১ কোটি ১১ লাখ

বিশ্ববিদ্যালয়ের নথিপত্র থেকে জানা যায়, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাতে বরাদ্দ হয় নয় কোটি টাকা। কিন্তু পুরো বছরে গবেষণায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয় হয়েছে মাত্র চার কোটি ১২ লাখ ৮৭ হাজার টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৪৬ শতাংশ। ফলে অর্ধেকেরও বেশি অব্যবহৃত অর্থ ফেরত দিতে হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়কে।

চলতি বছরে গবেষণা মঞ্জুরি খাতে বরাদ্দ প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে মোট ১৫ কোটি পাঁচ লখ টাকা করা হয়েছে। যা ব্যবহার করা হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৮টি গবেষণা কেন্দ্র ও ইনস্টিটিউটে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নথিপত্র বলছে, গবেষণায় বরাদ্দকৃত অর্থের পুরোপুরি ব্যবহার দেখা যায়নি গত কয়েক বছরেও। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে নয় কোটি টাকা বরাদ্দের বিপরীতে ব্যয় হয়েছে পাঁচ কোটি টাকা, যা বরাদ্দের ৫৭ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে সমপর্যায়ের বরাদ্দে ৭৩ শতাংশ খরচ করতে পেরেছে কর্তৃপক্ষ। ২০২০-২১ অর্থবছরে নয় কোটি ৫০ লাখ টাকার বিপরীতে খরচ হয়েছে মাত্র ৪০ শতাংশ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ১১ কোটি টাকা বাজেটের বিশ্ববিদ্যালয় খরচ করেছে ১০ কোটি টাকার বেশি, যা খরচের পরিমাণে ৯৯ শতাংশ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাতে বাজেট এবং ব্যয় নিরীক্ষণ করলে দেখা যায়, পুরোপুরি ব্যয় না হওয়া সত্ত্বেও প্রতিবছর গবেষণায় বাজেট বাড়াচ্ছে ইউজিসি। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় বাজেটের অপ্রতুলতার অজুহাত, তার থেকে উত্তরণে শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ফান্ডের ব্যবহার ও এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্ট অনেকে।   

অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব সীমাবদ্ধতা নিয়ে ফান্ড উদ্বোধনের সময় কথা বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ। তিনি বলেছেন, পূর্বের গবেষকরা মানুষের কাছ থেকে, সরকারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে গবেষণা করতেন না। এখন গবেষণার জন্য টাকা চাওয়া হয় এবং এই টাকা ফিরেও যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টাকা ফিরে যাচ্ছে। আমরা টাকা ব্যবহার করতে পারছি না। আসলে সত্য উচ্চারণ না করলে সমস্যার সমাধান হবে না। 

আরও পড়ুন: ডাকসু নির্বাচনে বাধা কোথায়?

সামাদ বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় হলো গ্র্যাজুয়েট তৈরির বিশ্ববিদ্যালয়। তাই আমরা গবেষণায় ততটা অগ্রসর হতে পারিনি। আমাদের গবেষণায় যা অবদার তাও অনেক আগের। আমাদের যন্ত্রপাতি নেই। আমরা যন্ত্রের টাকা দিয়ে অন্য কাজ করি। এ বিষয়গুলো অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে সামনে এনে নাগরিক সমাজ, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, সাংবাদিক এবং দেশের কর্তৃত্বস্থানীয় লোকদের সাথে নিয়ে যদি আমরা অগ্রসর হই, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় দাঁড়াবে।     

বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২২-২৩ অর্থবছরের হিসাব মতে, মোট ৫৮টি গবেষণা কেন্দ্র এবং ইনস্টিটিউটের ২১টি কেন্দ্রে কোনো টাকাই খরচ হয়নি। তাছাড়া অন্য কেন্দ্রগুলোর অবস্থাও বেহাল। এই কেন্দ্রগুলোর মধ্যে কয়েকটি এমনও আছে, যেগুলোতে প্রতিষ্ঠার পর থেকে কোনো পরিচালক নেই, নেই কোনো কার্যক্রমও। আবার কিছু কিছু কেন্দ্র রয়েছে যেগুলো কোনো গবেষণা না করেই দুই একটি সভা–সেমিনার করে টাকা খরচ করছে।

নিজস্ব ফান্ডের প্রয়োজনীয়তা দেখছে কর্তৃপক্ষ

গবেষণার বরাদ্দ খরচ না হওয়ার প্রশ্নে ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মমতাজ উদ্দিন আহমেদ। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, কোনো গবেষণায় ফাইনাল রিপোর্ট না দেওয়া পর্যন্ত টাকা খরচ দেখানো হয় না। তখন ইউজিসি এটাকে বলে উদ্বৃত্ত। গবেষণার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তো কর্তৃপক্ষ তার হিসাব জমা দিতে পারে না। মূলত টাকা দেওয়ার দীর্ঘসূত্রিতা এবং কয়েক ধাপে টাকা আসা এসব কারণে সমস্যা হচ্ছে।

DU2

নতুন ফান্ডের কার্যকারিতার প্রশ্নে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ইউজিসির ফান্ডের ওপর নির্ভর করলে বড় কোনো গবেষণা করাতে পারবে না। বিজ্ঞান অনুষদে যে গবেষণাগুলো করতে হয় এগুলো ল্যাবরেটরি ইকুইপম্যান্টভিত্তিক। এক একটা যন্ত্রপাতির দাম ৩০-৪০ লাখ টাকাও পড়ে। ক্ষেত্রবিশেষ কোনো যন্ত্রের দাম কোটি টাকাও পড়ে যায়। তারা এই টাকা দেয় না। ফলে বড় বড় গবেষণাগুলো আর হয়ে উঠে না। তাই বিষয়গুলো মাথায় নিয়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ফান্ড গঠন করেছি।      

বিশ্ববিদ্যালয়ের নথিপত্র থেকে জানা যায়, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাতে বরাদ্দ হয় নয় কোটি টাকা। কিন্তু পুরো বছরে গবেষণায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয় হয়েছে মাত্র চার কোটি ১২ লাখ ৮৭ হাজার টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৪৬ শতাংশ। ফলে অর্ধেকেরও বেশি অব্যবহৃত অর্থ ফেরত দিতে হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়কে। 

সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান ঢাকা মেইলকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাতে বরাদ্দের টাকা উদ্বৃত্ত থাকার সবচেয়ে বড় কারণ হলো মঞ্জুরি কমিশন বরাদ্দের টাকা দুই-তিন কিস্তিতে দিয়ে থাকে। ফলে বারবার এই বিষয়গুলো সমন্বয় করতে করতে সময় চলে যায়। টাকাটা শুরুতে দিয়ে দিলে গবেষণার জন্য সুবিধা হয়। এই দীর্ঘসূত্রিতার জন্যই উদ্বৃত্ত হয়।

আরও পড়ুন: রাজনীতিই কি ঢাবি শিক্ষার্থীদের বেপরোয়া করে তুলছে?

নিষ্ফল গবেষণা সেন্টার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একাডেমিক ডিসিপ্লিন আনার জন্য আমি কমিটি করেছি। কারণ, সেগুলো অপরিকল্পিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়েছে। কোনো পরিকল্পনা নেই, কোনো বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ নেই। এক একজন এসে বলছে আর এক একটা সেন্টার তৈরি হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ব্যক্তি যখন চলে যায় তখন ওই সেন্টারের কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়। কোনো যৌক্তিকতা নেই, অবকাঠামো নেই, অফিস নেই এবং লোকবল নেই এসব সেন্টারের। শুধু নাম দিয়ে রাখছে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ফান্ডের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ভালোমানের দুইটা ভালো গবেষণায় খরচ করতে লাগে ১৫ কোটি টাকা। যখন কেউ আমাদের প্রস্তাব দেয় তখন হয়ত আমরা তার বাজেট ধরি তিন লাখ টাকা। ফলে না হয় গবেষণা, না হয় প্রকাশনা। তারা না নিতে পারে রিসার্চ অ্যাসিসটেন্ট। যে টাকা দেওয়া হচ্ছে তা দিয়ে হয়ত সামাজিক বিজ্ঞানের বা কলা অনুষদের গবেষণাগুলো করা সম্ভব। এই টাকা দ্বারা মৌলিক কোনো গবেষণা হওয়া সম্ভব না। একটা বায়োলজিক্যাল সাইন্সের রিচার্স করতে অনেক টাকা লাগে।

এমএইচআই/জেবি