বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মে অসামান্য অবদান রয়েছে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। শুধু তাই নয়, দেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা। কিন্তু সম্প্রতি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অছাত্রসুলভ আচরণ ম্লান করে দিয়েছে সোনালি সেই অতীত। গত এক মাসে এই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের অপকর্মের জন্য নিউজের শিরোনামে এসেছে সাতবারেরও বেশি। ফলে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে- বেপরোয়া এই ছাত্র রাজনীতির ইন্ধনদাতা কারা? ছাত্ররাজনীতিই কি ছাত্রদের বেপরোয়া করে তুলছে?
সম্প্রতি আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে রয়েছে- চাঁদাবাজি, ছিনতাই, বিরোধী ছাত্র সংগঠনের ওপর হামলা, হলের কক্ষ দখলকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের সংঘর্ষসহ ক্যানসার রোগী থেকে জোর করে টাকা আদায়ের মতো অপ্রীতিকর ঘটনাও। এসবের মধ্যে রয়েছে গত ২ ফেব্রুয়ারি কাওয়ালি ব্যান্ড ‘সিলসিলা’র উদ্যোগে টিএসসিতে আয়োজিত কাওয়ালি গানের আসরে হামলা। একই দিন রাতে ছাত্র অধিকার পরিষদ কর্মী তারেক রেজাকে ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ হলে আটকে রেখে মারধর। ৩ ফেব্রুয়ারি ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ হলে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘটিত সংঘর্ষে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক। ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে এক দম্পতিকে মেরে ২২ হাজার টাকা ছিনতাইসহ এটিএম কার্ড ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ। ৫ ফেব্রুয়ারি রাত তিনটায় বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে কাভার্ডভ্যান আটক করে ১৫ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেওয়া। ৬ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুর হক মুসলিম হলে কক্ষ দখলকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ। ৭ ফেব্রুয়ারি ক্যানসারে আক্রান্ত ছেলে, বাবা ও মাকে মারধর করে ক্ষতিপূরণের নামে টাকা ছিনিয়ে নেওয়া।
উপরে উল্লেখ করা সবগুলো ঘটনায় ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ কর্মীদের প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। কোনো কোনোটির সত্যতাও মিলেছে। এমনকি কোনো ঘটনার সঙ্গে সংগঠনটির শীর্ষ নেতৃত্বের ইন্ধন রয়েছে বলেও জানা গেছে। দেশের সবচেয়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের এমন আচরণে হতবাক সুশীল সমাজ। ভাষার মাসে এমন বিরূপ আচরণকে অপ্রত্যাশিত বলে মনে করছেন তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তানজিম উদ্দিন খান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার কারণেই এমনটা হচ্ছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তিকে অস্বাভাবিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রশাসন ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি করার ফল হচ্ছে বর্তমান অবস্থা। যারা নিয়মিত ক্লাসে অনুপস্থিত ও ছাত্রত্ব নেই তারা এবং তাদের ছত্রছায়ায় এমনটা হচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বেশির ভাগ ঘটনাতেই সাক্ষী গোপালের ভূমিকায় ছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ বিষয়ে জানতে প্রক্টরকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
গত ২০ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের নতুন কমিটিতে আসেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক নেতা সাদ্দাম হোসেন ও শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান। একই সাথে ঘোষণা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটিও। সভাপতির দায়িত্ব পেয়েছেন মাজহারুল কবির শয়ন এবং সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন তানভীর হাসান সৈকত। নতুন কমিটিতে এসেই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন এই চার নেতা।
বিজ্ঞাপন
তবে কমিটি ঘোষণা পরবর্তী দুই মাস পর্যালোচনা করলেই চোখে পড়ে তার উল্টো চিত্র। নানা অপরাধের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাস্তির মুখোমুখি হলেও বরাবরের মতোই নীরব ভূমিকায় দল। নিচ্ছে না কোনো সাংগঠনিক পদক্ষেপও।
এ বিষয়ে জানতে সাদ্দাম হোসেনকে বারবার কল করেও ফোনে পাওয়া যায়নি।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন ঢাকা মেইলকে বলেন, যারা এসব নিয়মবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে জড়িত তাদের ভবিষ্যতে ছাত্রলীগের কোনো পদে পদায়িত করবো না।
সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সুখ্যাতি নষ্ট হয় এমন কিছুতেই ছাত্রলীগকে পাশে পাবে না কেউ। যারা অপরাধ করেছে সে বিষয়ে আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবহিত করেছি এবং যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছি। পুলিশ তাদের গ্রেফতার করেছে, বিশ্ববিদ্যালয় তার একাডেমিক ব্যবস্থা নিয়েছে।
তাদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অতি শিগগিরই আমরা এই নিয়ে আমরা প্রজ্ঞাপন জারি করতে যাচ্ছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে উপাচার্য ড. আখতারুজ্জামান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসন ব্যবস্থা নিচ্ছে, আমরা একাডেমিক ব্যবস্থা নিয়েছি এবং পরবর্তী সময়ে যারাই এমন কাজ করবে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জেবি

