images

অর্থনীতি

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় ব্যাহত বিদেশি বিনিয়োগ

মহিউদ্দিন রাব্বানি

১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:৫৭ এএম

# মার্চ প্রান্তিকে এফডিআই এসেছে মাত্র এক লাখ ডলার
# গত বছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে ৯৩.৪৬ শতাংশ
# বিনিয়োগ কমার পাশাপাশি বিনিয়োগ তুলে নেওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে
# রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে
# বিনিয়োগকারীরা চায় রাজনৈতিক স্থিতিশীল পরিবেশ, নির্বাচিত সরকার ব্যবস্থা
# দেশে বর্তমানে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নেই, দ্রুত নির্বাচন না হলে বিনিয়োগ বাড়ানো যাবে না: অর্থনীতিবিদরা 

দেশের বর্তমানে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে ব্যাহত হচ্ছে অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এডিআই)। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিনিয়োগকারীরা নতুন প্রকল্পে অর্থ ঢালার বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক টানাপড়েন, নীতিমালার অনিশ্চয়তা এবং স্থিতিশীল ব্যবসায়িক পরিবেশের ঘাটতি বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

বিনিয়োগকারীরা চায়, স্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থা। নির্বাচিত সরকার ব্যবস্থা- যেখানে একটা স্থায়ী নীতিমালার নিশ্চয়তা থাকবে।

ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং রাজস্ব আদায়ের ধীরগতি-সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি এখন এক বহুমুখী সংকটে পড়েছে।

আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে রাজনৈতিক অস্থিরতা ততোই বাড়ছে। বাড়ছে ব্যবসায়িক পরিবেশ আর অবকাঠামো দুর্বল হওয়ার আশঙ্কা। এমতাবস্থায় থমকে দাঁড়িয়েছে অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের স্বপ্ন। শিল্পায়নের মহাপরিকল্পনা অনেকটাই ফিকে হয়ে আসছে।

5

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে উঠে এসেছে, সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গেল মার্চ প্রান্তিকে অর্থনৈতিক অঞ্চলে এফডিআই এসেছে মাত্র এক লাখ ডলার, যা আগের বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বরের তুলনায় ৯৩.৪৬ শতাংশ কম। শুধু তাই নয়, গত বছরের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় দ্বিতীয় প্রান্তিকে এই বিনিয়োগ কমেছে ৮৩.১১ শতাংশ।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আস্থাহীনতা আর অনিশ্চয়তার এই দীর্ঘ ছায়া দেশের প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। সম্ভাবনাময় অনেক শিল্প-কারখানা যেমন অর্থাভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না, তেমনি বহু প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান নতুন করে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছে না। এমন সময় এই রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশের অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে।

বিনিয়োগ বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা বিনিয়োগকারীদের জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি। সুষ্ঠু নির্বাচন, সুশাসন ও নীতির ধারাবাহিকতা নিশ্চিত না হলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশকে নিরাপদ বিনিয়োগ গন্তব্য হিসেবে বিবেচনা করতে অনাগ্রহী হয়ে উঠছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও শ্রমশক্তির প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেশের ইতিবাচক সম্ভাবনাকে ম্লান করছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশি বিনিয়োগে ধীরগতি হলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে। রফতনি নির্ভর খাতগুলোতেও প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা কমে যেতে পারে।

4

তারা মনে করছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা, নীতির ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা এবং প্রশাসনিক জটিলতা দূর করাই এ পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রধান উপায়। এছাড়া করনীতিতে স্বচ্ছতা ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

গত বছর জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার সম্মিলিত গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে। ফ্যাসিবাদ বিরোধী সব রাজনৈতিক দল ও মতের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে অভ্যুত্থান পরবর্তীতে জুলাই মিত্রদের মধ্যে ফাটল ধরতে থাকে। মূলত জাতীয় সংসদ নির্বচন ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা করলেও নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে বিরোধ লেগেছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। ইতোমধ্যে সাতটি রাজনৈতিক দল পিআর (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ পাঁচ দফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে। এতে ফের উত্তপ্ত হয়ে পড়েছে রাজনীতির মাঠ। ফলে ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তারা বলছেন, নতুন বিনিয়োগে খরা এবং অর্থনৈতিক সূচকের নিম্নমুখী প্রবণতায় থাকা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এই রাজনৈতিক অস্থিরতা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অতীতের অভিজ্ঞতা বলছে, রাজনৈতিক মতপার্থক্য বা অনিশ্চয়তা সহজেই আন্দোলন, অবরোধ কিংবা সংঘাতের দিকে গড়াতে পারে। বিশেষ করে যদি অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনৈতিক দলগুলো এবং অন্য স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে আস্থা ও সমঝোতা গড়ে না ওঠে, তবে উত্তেজনা বাড়তে পাড়ে। এ ছাড়া তরুণ প্রজন্মের প্রত্যাশা, অর্থনৈতিক চাপ ও সামাজিক গণমাধ্যমের দ্রুত প্রভাব অনেক সময় হঠাৎ করেই অস্থির পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। রাজনৈতিক অস্থিরতা সবচেয়ে আগে প্রভাব ফেলে আস্থার ওপর। বিনিয়োগকারী, উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে ভয় পান। এর ফলে স্থানীয় বিনিয়োগ ও বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাবে।

শঙ্কা প্রকাশ করে ব্যবসায়ী বলছেন, প্রতিটি নির্বাচন ও ক্ষমতা হস্তান্তরকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতা চরম আকার ধারণ করে। এতে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির ওপর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আগের নির্বাচনকালীন জ্বালাও-পোড়াও এবং রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেশের অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল।

6

নির্বাচিত রাজনৈতিক কোনো দল ক্ষমতা গ্রহণ না করা পর্যন্ত দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি হবে না বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরি। তিনি বলেন, যত দিন একটি রাজনৈতিক তথা নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব না নেবে, তত দিন বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হওয়ার কথা, তখন একটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার এলে বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করি।

দেশে বর্তমান পরিস্থিতি বিনিয়োগবান্ধব নয় মনে করেন তিনি। এই  অর্থনীতিবিদ বলেন, দেশে সামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। ফলে বিনিয়োগ নেতিবাচক অবস্থানেই রয়েছে। এই অবস্থায় বিনিয়োগকারীরা উৎসাহিত হওয়ার কথা নয় এবং হচ্ছেনও না।

এদিকে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ ঢাকা মেইলকে বলেন, টেকসই কর্মসংস্থান বাড়ে মূলত বিনিয়োগের মাধ্যমে। সেই বিনিয়োগ আমাদের ভালো অবস্থানে নেই। দেশি-বিদেশি দুই রকমের বিনিয়োগই এখন কম। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখে। তারা স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ চায়। তারা চায় নির্বাচিত সরকার ব্যবস্থা। যেন তাদের বিনিয়োগে নীতিগত পরিবর্তন ও ঝুঁকি কম থাকে। দ্রুত নির্বাচন না হলে বিনিয়োগ বাড়ানো যাবে না। আর বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থানও বাড়বে না।

এমআর/এএস