মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:১৩ এএম
*নিরাপত্তা পাচ্ছেন ৭০ লাখ আমানতকারী
*একীভূত ব্যাংকের নতুন নাম ‘ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক’
*নতুন লাইসেন্স ইস্যু করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
*সরকারি মূলধনে গড়ে উঠবে নতুন ব্যাংক
*বড় আমানতকারীদের শেয়ার নেওয়ার প্রস্তাব
*শেয়ার বিক্রি করে ফেরত দেওয়া হবে টাকা
অবশেষে চূড়ান্তভাবে একীভূত হতে যাচ্ছে দুর্নীতি লুটপাটে ক্ষতিগ্রস্থ পাঁচ ইসলামী ব্যাংক। ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশের আলোকে প্রতিটি ব্যাংকে একজন করে অস্থায়ী প্রশাসক বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রশাসকের সহযোগিতার জন্য চারজন করে কর্মকর্তা দেওয়া হবে। এর মধ্যে একীভূত হওয়া ব্যাংকের নামও ঠিক করা হয়েছে। সার্বিক বিষয় অবহিত করতে গত মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বিশেষ সভা ডাকা হয়। এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্তের মধ্য দিয়ে নিরাপত্তা পেতে যাচ্ছে পাঁচ ব্যাংকের ৭০ লাখেরও বেশি আমানতকারী। যাদের আমানতের পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা।
সূত্র জানিয়েছে, শরীয়াহভিত্তিক পরিচালিত এক্সিম, সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, ইউনিয়ন ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক মিলে একটি করার ক্ষেত্রে সম্মতি দিয়েছে সরকার। বিগত সরকারের সময় বিভিন্ন লুটেরা গোষ্ঠির জালিয়াতির কারণে এসব ব্যাংকের ৪৮ থেকে ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ এখন খেলাপি। একীভূত করার জন্য প্রয়োজনীয় ৩৫ হাজার ২০০ কোটি টাকার মধ্যে সরকার দিচ্ছে ২০ হাজার ২০০ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আজকের পর্ষদ সভায় এসব অবহিত করা হবে।
জানা গেছে, প্রশাসক দায়িত্ব নেওয়ার পর বিদ্যমান পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ শূন্য হবে। সব শেয়ার শূন্য হবে। তবে আমানতকারী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরাপত্তার বিধান করা হবে। আর একীভূত করার আগে নতুন করে একটি ব্যাংকের লাইসেন্স ইস্যু হবে। যার সম্ভাব্য নাম হতে পারে ‘ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক’। সরকারের মূলধনে এ ব্যাংক গড়ে উঠবে। একীভূত হতে যাওয়া পাঁচ ব্যাংকের সম্পদ ও দায় এ ব্যাংকের অধীনে চলে আসবে। এরপর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হবে। ব্যাংকগুলো একটি পর্যায়ে আনার পর বেসরকারি খাতে শেয়ার বিক্রি করে সরকারের টাকা ফেরত দেওয়া হবে। পাশাপাশি পাঁচ ব্যাংকের বড় আমানতকারীদেরও শেয়ার নেওয়ার প্রস্তাব করা হবে। ছোট আমানতকারীরা টাকা তুলে নিতে চাইলে তাতে বাধা দেওয়া হবে না।
ব্যাংক একীভূতকরণের সর্বশেষ ধাপ হিসেবে চলতি মাসের শুরুতে একীভূত হতে যাওয়া পাঁচ ব্যাংকের বক্তব্য শুনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেখানে শেষবারের মতো জানতে চাওয়া হয়– কেন তাদের একীভূতের আওতায় আনা হবে না। এ সময় ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক একীভূত হতে সরাসরি সম্মত দেয়। আর এক্সিম ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক সময় চাইলেও তাদের তা দেওয়া হয়নি।
তথ্য বলছে, এই পাঁচ ব্যাংকে আমানতকারীর সংখ্যা ৭০ লাখেরও বেশি। যাদের আমানতের পরিমাণ গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছিল প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। বিপরীতে বিনিয়োগ তথা ঋণ বিতরণ ছিল প্রায় ১ লাখ ৯৩ হাজার কোটি টাকা। যার ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকাই খেলাপি হয়ে গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, শরিয়াভিত্তিক ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের মোট আমানতকারী সংখ্যা ২৬ লাখ ৭৭ হাজার ৩৩৩ জন। আমানত রয়েছে ২৩ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। এক লাখ টাকা পর্যন্ত আমানতকারীর সংখ্যা ২২ লাখ ২ হাজার ১৯ জন, যা মোট আমানতকারী ৮২ দশমিক ২৫ শতাংশ। আমানতের পরিমাণ দুই হাজার ৫০২ কোটি টাকা। এক লাখ এক টাকা থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত আমানতকারী সংখ্যা এক লাখ ৪৯ হাজার ৪৫৬ জন, যা মোট আমানতকারীর ৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ। এসব হিসাবে আমানত আছে দুই হাজার ২০১ কোটি টাকা।
>> আরও পড়তে পারেন
এক্সিম ব্যাংকের মোট আমানতকারী ১৬ লাখ ৯ হাজার ৭৩৭ জন। তাদের আমানত রয়েছে ৩১ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক লাখ টাকা পর্যন্ত আমানতকারীর সংখ্যা ১২ লাখ ৮১ হাজার ৮৫৮ জন, যা মোট আমানতকারীর ৭৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এসব হিসাবে আমানত রয়েছে এক হাজার ২০২ কোটি টাকা। এক লাখ এক টাকা থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত আমানতকারীর সংখ্যা ৮৬ হাজার ১৫৮ জন, যা মোট আমানতকারীর ৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ। আমানতের পরিমাণ এক হাজার ২৫৩ কোটি টাকা।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের এক লাখ টাকা পর্যন্ত আমানতকারীর সংখ্যা ২৪ লাখ ৩২ হাজার ৪০৮ জন, যা মোট আমানতকারীর ৮৮ দশমিক ৮২ শতাংশ। এসব হিসাবে আমানত রয়েছে এক হাজার ৫১১ কোটি টাকা। আর এক লাখ এক টাকা থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত আমাতনকারীর সংখ্যা ৮৬ হাজার ৪০৬ জন, যা মোট আমানতকারীর ৩ দশমিক ১৬ শতাংশ। তাদের আমানতের পরিমাণ দুই হাজার ২৫৫ কোটি টাকা।
এ ছাড়াও ইউনিয়ন ব্যাংকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত আমানতকারীর সংখ্যা চার লাখ ৫১ হাজার ৪৬০ জন, যা মোট আমানতকারীর ৭৯ শতাংশ। আমানতের পরিমাণ ৭০৭ কোটি টাকা। এক লাখ এক টাকা থেকে দুই লাখ পর্যন্ত আমানতকারীর সংখ্যা ৩৬ হাজার ৯১২ জন, মোট আমানতকারীর ৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এসব হিসাবে আমানত রয়েছে ৫৫৭ কোটি টাকা। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত আমানতকারী রয়েছে চার লাখ ৫৫ হাজার ৪২১ জন, যা মোট আমানতকারীর ৮১ দশমিক ৮২ শতাংশ। আমানত জমা ৬৩১ কোটি টাকা। এক লাখ এক টাকা থেকে দুই টাকা পর্যন্ত আমানতকারীর সংখ্যা ২৮ হাজার ৬৪৪ জন, যা মোট আমানতকারীর ৫ দশমিক ১৪ শতাংশ। আমানতের পরিমাণ ৪২৮ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, এই পাঁচটি ব্যাংক একীভূত হলে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে একটি বড় ব্যাংক তৈরি হবে। শাখা, কর্মকর্তা, গ্রাহক ও সম্পদের পরিমাণ একত্রে বিশাল হবে। দুর্বল অ্যাসেটগুলো এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির মাধ্যমে ব্যবস্থাপনায় আনা হবে। প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতি পূরণেও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান ঢাকা মেইলকে বলেন, এই প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। এখন প্রশাসকেরা এই ব্যাংকগুলোর দায়িত্ব নেবেন। আগের পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা দল বহাল থাকলেও পর্ষদ অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে। একীভূত করার প্রক্রিয়া শেষ হলে ব্যাংকগুলোর বর্তমান পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কমিটি বাতিল হয়ে যাবে। আমানতকারীদের আমানতের সুরক্ষা দিতেই এই একীভূত করা হচ্ছে। কারো ভয় বা আতঙ্কের কিছু নেই। পর্যায়ক্রমে ডিপোজিটররা তাদের আমানত ফেরৎ পাবেন।
টিএই/এএস