মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
৩১ আগস্ট ২০২৫, ১০:১১ এএম
*একিউআর প্রতিবেদন অনুযায়ী খেলাপি বিনিয়োগ ৬২%
*ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা
*প্রভিশন ঘাটতি ছাড়িয়েছে ১০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা
*নব্বই দশকে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকটি দখল হয় ২০১৭ সালে
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যেই কয়েকটি ব্যাংকে সরাসরি লুটপাট চালানো হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল)। লুটেরা গোষ্ঠীর নজিরবিহীন লুটপাটে অনেকটা নিঃস্ব অবস্থা দেখা দিয়েছে ব্যাংকটির। বাংলাদেশ ব্যাংক একাধিকবার তারল্য সহায়তা দেওয়ার পরও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না ব্যাংকটি। ফলে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকসহ ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচ ব্যাংককে একীভূত করা সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু একীভূত হতে আপত্তি জানিয়েছে দুর্বল হয়ে যাওয়া এই ব্যাংকটি। ইতোমধ্যে একীভূত করার প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন ব্যাংকটির কিছু শীর্ষ শেয়ার। নাজুক অবস্থা হওয়ার পরও একীভূত না হতে চাওয়াকে ‘মামার বাড়ির আবদার’ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাই আমানতকারীদের আমানতের সুরক্ষা দিতে দ্রুত একীভূত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার দাবি জানিয়েছেন তারা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০২৫ সালের মার্চ ভিত্তিক তথ্য বলছে, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের মার্চ পর্যন্ত মোট বিতরণকৃত বিনিয়োগ বা ঋণের স্থিতি ছিল ৩৮ হাজার ২০৮ কোটি টাকা। যার মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ১৪ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিতরণকৃত ঋণের ৩৮ শতাংশই খেলাপি হয়ে গেছে। আর একই সময়ে প্রভিশন ঘাটতি ১০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ১ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। যদিও সূত্র জানিয়েছে জুন প্রান্তিকে এই সূচকগুলোর নেতিবাচক চিত্র আরও অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণত এসব তথ্য তফসিলি ব্যাংগুলো তিন মাস পরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠিয়ে থাকে।
>> আরও পড়তে পারেন
তবে সম্প্রতি একীভূত করতে যাওয়া পাঁচ ব্যাংকের অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ (একিউআর) করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানে দেখা যাচ্ছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এসআইবিএলের খেলাপি ঋণ ছাড়িয়েছিল ৬২ শতাংশ। একিউআর প্রতিবেদন বলছে, ওই সময় ব্যাংকটির মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৩৭ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ২৩ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা।

সম্প্রতি সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডকে একীভূত করার প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন ব্যাংকটির ৯ জন শেয়ারহোল্ডার। গত ১৯ আগস্ট ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান পরিচালক রেজাউল হকসহ ৯ জন শেয়ার হোল্ডার ১৯ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও অর্থবিভাগের সচিবের কাছে এ বিষয়ে একটি চিঠি দিয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা বিবেচনা করছে না। ১৯ আগস্ট সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকও একীভূত করতে আবেদন করেছে। ব্যাংক দুটি সংকট কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বলে তারা দাবি করেছে।
>> আরও পড়তে পারেন
১৯৯৫ সালের ২২ নভেম্বর প্রথমে ‘সোস্যাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড’ নামে যাত্রা শুরু করে ব্যাংকটি। পরে এটির নাম পরিবর্তন করে বর্তমান নাম ‘সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটড’ (এসআইবিএল) নামে নামে নামকরণ করা হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভালোই চলছিল ব্যাংকটি। তবে দুর্যোগ নেমে আসে ২০১৬ সালের পর। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর রাজধানীর ওয়েস্টিন হোটেলে অনুষ্ঠিত বিশেষ সভায় চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয়। আগের দিন রাতে ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও কোম্পানি সচিবকে তুলে নিয়ে যায় একটি গোয়েন্দা সংস্থা। ব্যাংকটি দখলের পর চেয়ারম্যান করা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আনোয়ারুল আজিম আরিফকে। ব্যাংকটির বর্তমান চেয়ারম্যান বেলাল আহমেদ হচ্ছেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের জামাতা।
এসআইবিএলের মালিকানা পরিবর্তনের সময়ই এস আলম গ্রুপ কয়েকজন উদ্যোক্তা ও পরিচালককে বাদ দেয়। এরপর তারা ব্যাংকটি থেকে নামে-বেনামে বিপুল টাকা বের করে নেয়। যে কারণে ব্যাংকটি ইতোমধ্যে আর্থিক সংকটে পড়ে। মালিকানা পরিবর্তনের সময় ব্যাংকটির বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা, যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৮ হাজার কোটিতে। তবে নতুন যুক্ত হওয়া আমানতের বড় অংশই এস আলম গ্রুপ ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে নেওয়া হয়। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে স্বৈরশাসকের পতনের পর ২৫ আগস্ট ব্যাংকটির পর্ষদের পুনর্গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নিয়ম অনুযায়ী, কোনো ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৩০ শতাংশ অতিক্রম করলে সেটিকে মৃত হিসেবে বিবেচনা করা হয়—যাকে হয় দ্রুত বিলুপ্ত করতে হবে, নয়তো পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এই সীমা অতিক্রম করেছে। তাই আইএমএফের চাপেই হোক বা আর্থিক স্থিতিশীলতার স্বার্থেই হোক, বাংলাদেশ ব্যাংকের একীভূতকরণ সিদ্ধান্তকে অনেকেই সময়োপযোগী মনে করছেন।
এ বিষয়ে গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি ঢাকা মেইলকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এই একীভূতকরণ উদ্যোগটি সময়োপযোগী এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। দীর্ঘদিন ধরে লোকসানে থাকা ও খেলাপি ঋণে জর্জরিত ইসলামী ব্যাংকগুলোর পৃথকভাবে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছিল। এখন তাদের একত্রিত করে একটি সুসংগঠিত কাঠামোর অধীনে আনলে ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং দক্ষতা বাড়বে। আমানতকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে।
>> আরও পড়তে পারেন
এদিকে ব্যাংকিং খাত সংস্কারের অংশ হিসেবে দুর্বল পাঁচ ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগে চূড়ান্ত ধাপে পৌঁছেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রোববার থেকে শুরু হচ্ছে আনুষ্ঠানিক শুনানি। তবে শেষ মুহূর্তে একীভূতকরণ ঠেকাতে তৎপর রয়েছে দুটি ব্যাংক। একীভূত হওয়ার তালিকায় সব থাকবে, নাকি কোনো ব্যাংক নিজেকে রক্ষা করতে পারবে, সেই আলোচনা রয়েছে ব্যাংকপাড়ায়। ব্যাংকগুলোকে কেন একীভূত করা হবে না, সে বিষয়ে ব্যাখ্যাও তলব করা হয়েছে।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান ঢাকা মেইলকে বলেন, যেসব ব্যাংক বলছে তাদের অবস্থা ভালো, তারা মার্জারে আসবে না। আমরা তাদেরকে বলছি তাদের অবস্থা খারাপ, অবশ্যই মার্জারে আসতে হবে। কার কার্পেটের নিচে কত আবর্জনা ছিল তা আমরা জানি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সঠিক পথেই এগোচ্ছে।
টিএই/এএস