images

অর্থনীতি

সমাজসেবার প্রকল্পে লুটপাট, ১০ হাজার টাকা পায়নি প্রশিক্ষণার্থীরা

মাহাবুল ইসলাম

০৪ জুলাই ২০২৫, ১১:৪৪ এএম

সরকারি প্রশিক্ষণ প্রকল্পে দুর্নীতির চিত্র আবারও স্পষ্ট। সমাজসেবা অধিদফতরের অধীন “অনগ্রসর ও হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য আত্মকর্মসংস্থানমূলক প্রশিক্ষণ” প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম ও লুটপাটের প্রমাণ মিলেছে। ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে পরিচালিত এই প্রকল্পে প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে শুরু করে যন্ত্রপাতি, প্রশিক্ষণ কার্যক্রম—সব কিছুতেই দুর্নীতির ছাপ স্পষ্ট।

ভোলার লালমোহনের যুবক মো. জুয়েল এই অনিয়মের একজন প্রত্যক্ষ ভুক্তভোগী। তিনি জানান, বন্ধুদের নিয়ে অংশ নিয়েছিলেন সমাজসেবা অধিদফতরের প্রশিক্ষণ প্রকল্পে। তবে বাস্তবে তারা কেউই কোনো অর্থ পাননি, এমনকি কার্যকর প্রশিক্ষণও হয়নি।

“প্রতিদিন মাত্র এক ঘণ্টা ক্লাস হতো, সেটাও আড্ডা দিয়ে পার হতো। মনে হতো একটা নাটক চলছে। আমাদের স্বপ্ন নিয়ে কেউ এভাবে খেলবে, কল্পনাও করিনি,”— হতাশ কণ্ঠে বলছিলেন জুয়েল।

তিনি আরও বলেন, “প্রকল্প শুরুর সময় বলা হয়েছিল, প্রত্যেকে ১০ হাজার টাকা করে পাবে। সেই আশায় একটা উদ্যোগ নেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিন্তু এক টাকাও পাইনি। উল্টো সার্টিফিকেট দেওয়ার কথা বলে ১০০ টাকা করে নিয়েছে। অথচ আজও সেই সার্টিফিকেট চোখে দেখিনি।”

চরফ্যাশনের যুবক এহসান আলীর অভিজ্ঞতাও একই রকম। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, “আমি ১০ হাজার টাকা তো পাইনি, বরং ১ হাজার টাকা দিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছে। শিখতেও পারিনি কিছুই।”

জুয়েল ও এহসানের মতো অভিজ্ঞতা পাওয়া গেছে একাধিক ভুক্তভোগীর কাছ থেকেই। শুধু এই প্রতিবেদকের অনুসন্ধানেই নয়, সরকারি মূল্যায়নেও এসব অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে। বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, এই প্রকল্পে ২০২১-২২ অর্থবছরেই ১৯৬টি অডিট আপত্তি রয়েছে এবং প্রতিটি স্তরেই দুর্নীতির ছাপ স্পষ্ট।

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া ‘অনগ্রসর ও হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য আত্মকর্মসংস্থানমূলক প্রশিক্ষণ’ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয় লালমনিরহাট, জামালপুর, ভোলা ও পটুয়াখালী জেলার ২৫টি উপজেলায়। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও নামসর্বস্ব বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গ্লোবাল রুর‌্যাল এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (জিআরইএস) প্রকল্প বাস্তবায়ন করে।

প্রকল্পের মোট ব্যয় ছিল প্রায় ৪০ কোটি টাকা। প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় ৫ হাজার ১৮৫ জন তরুণ-তরুণীকে। খাতা-কলমে এদের অনেককেই দেখানো হয়েছিল এতিম কিংবা স্কুলড্রপআউট হিসেবে। কিন্তু বাস্তবে প্রশিক্ষণের আওতায় রাখা হয় কম্পিউটার, ড্রাইভিং এবং গ্রাফিক ডিজাইন, যা ছিল অনেকাংশে লোক দেখানো।

অডিটে দুর্নীতির পাহাড়!

আইএমইডির তথ্য অনুযায়ী, প্রকল্পে অতিরিক্ত প্রশিক্ষণার্থী, প্রশিক্ষকের সম্মানী, খাবার, যাতায়াত ভাতা, এমনকি জ্বালানির খরচ দেখিয়ে সরকারি অর্থ লোপাট করা হয়েছে। শুধুমাত্র অতিরিক্ত প্রশিক্ষণার্থী দেখিয়ে তুলে নেওয়া হয় ৮০ লাখ টাকার বেশি। ভুয়া খাবারের ব্যয় দেখিয়ে আরও সাড়ে ৭ লাখ টাকা, আয়কর কর্তনে অনিয়মে ২১ লাখ টাকা, আর প্রকল্প শেষে ১ কোটি ৯৩ লাখ টাকার কম্পিউটার ও আসবাবপত্র উধাও হয়ে যায়। জ্বালানির ব্যয়ের নামে তোলা হয় আরও কয়েক লাখ টাকা। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই প্রশিক্ষক নিয়োগ দেখিয়ে তুলে নেওয়া হয়েছে সম্মানি বাবদ আরও অর্থ।

অর্থ খরচে শতভাগ, সফলতায় শূন্য!

প্রকল্প শেষে সমাজসেবা অধিদফতরের ফাইলে এই প্রকল্পকে শতভাগ সফল বলে দেখানো হয়েছে। খরচ দেখানো হয়েছে বাজেটের ৯৯.৯৯ শতাংশ। কিন্তু মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা ভয়াবহ। কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ২,৬৪০ জন, চাকরি পেয়েছেন মাত্র ১২১ জন। ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ২,৫৪৫ জন, কর্মসংস্থানে যুক্ত হয়েছেন মাত্র ৭২ জন। অর্থাৎ প্রকল্পের ব্যয় প্রশিক্ষণার্থীদের জীবনে কার্যত কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি।

প্রকল্পের আর্থিক বিশ্লেষণ আরও করুণ। শুরুতে বিনিয়োগ-লাভ অনুপাত ধরা হয়েছিল ১ টাকায় আয় হবে ৯ টাকা ৬২ পয়সা। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, ১ টাকায় আয় হয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ৩৬ পয়সা। সম্ভাব্য উপকারিতা ধরা হয়েছিল প্রায় ৩৮৫ কোটি টাকা। অর্জিত হয়েছে মাত্র ১০ কোটি টাকার সামান্য কিছু। সেটিও টেকসই নয়।

আইএমইডি সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটি সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী নূরুজ্জামান আহমেদের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে গ্রহণ ও বাস্তবায়িত হয়। তার নির্বাচনি এলাকায় এই প্রকল্প চালু করা হয় এবং ঘনিষ্ঠদের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ পরিচালনার দায়িত্ব বণ্টন করা হয়। এ কারণেই প্রকল্পের মান ও কার্যকারিতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক প্রতিষ্ঠান ছিল অযোগ্য, যাদের মাধ্যমে কার্যকর প্রশিক্ষণ সম্ভব হয়নি।

আরও পড়ুন-

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু অর্থ খরচ করে প্রকল্প সফল হয় না। প্রকৃত দক্ষতা অর্জন না হলে কর্মসংস্থানের স্বপ্ন বাস্তবায়ন অসম্ভব। সরকারি প্রশিক্ষণ প্রকল্পগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে, এবং বাস্তবভিত্তিক, মানসম্পন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। প্রতিটি প্রকল্পে সুশাসন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা না গেলে এই হরিলুটের সংস্কৃতি বন্ধ হবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল‍্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, বিগত সময়ে প্রান্তিক মানুষের কর্মসংস্থানের নামে যে প্রকল্পগুলো গ্রহণ করা হয়েছে, তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। প্রমাণিত দুর্নীতির চিত্র নানাভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। ভাগ্য পরিবর্তনের নামে যারা লুটপাট করে, তারা কৌশল করেই বিচারের বাইরে থেকে যায়। এটাই আমাদের দেশের নিয়মতান্ত্রিক দুর্নীতির সমাধান বা প্রতিরোধ করতে না পারার বড় কারণ। কাগজে কলমে সবই ঠিক থাকে। কিন্তু বাস্তবতা বিপরীত। বিচারের ফাঁক ফোঁকর দুর্নীতিকে উৎসাহিত করছে।

গ্লোবাল রুর্ ্যাল এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (জিআরইএস)'র অফিসিয়াল নাম্বারে যোগাযোগ করা হলে একজন গৃহবধূ কল রিসিভ করেন। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, এই নামে কোনো এনজিও'র নাম তিনি কখনো শুনেননি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইএমইডি এক কর্মকর্তা ঢাকা মেইলকে বলেন, প্রকল্পটিতে দুর্নীতি হয়েছে এটা স্পষ্ট। প্রকল্পটি ছোট হলেও দুর্নীতির পরিমাণ ছোট নয়। আমরা আমাদের সুপারিশ তুলে ধরে প্রতিবেদন দিয়েছি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পরবর্তী ব্যবস্থা নেবেন।

এদিকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের ওয়েব সাইটেও প্রকল্পের দুই পরিচালক স্বপন কুমার হালদার ও হেলাল উদ্দিন ভুঁইয়ার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ফল তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

জানতে চাইলে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, আমি খোঁজ নিয়ে পারে জানাব।

এমআই/ইএ