images

অর্থনীতি

বাজারে ইতিবাচক পরিবর্তনেও কারসাজিতে অস্বস্তি

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন

০৩ মার্চ ২০২৫, ১০:০৭ পিএম

images
  • এক বছরে দাম কমেছে বেশির ভাগ পণ্যের
  • কিছু পণ্যের দাম কমেছে অর্ধেকেরও বেশি
  • পর্যাপ্ত আমদানি সত্ত্বেও ভোজ্যতেলে কৃত্রিম সংকট
  • সরকারের উচিত মূল জায়গায় হাত দেওয়া: বিশেষজ্ঞ

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান স্বৈরসাশক শেখ হাসিনা। অবসান হয় ১৬ বছরের দুঃশাসনের। পটপরিবর্তনের সাথে সাথে অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে। এর মধ্যে নিত্যপণ্যের বাজারেও বেশ পরিবর্তন দেখা গেছে। তবে এত পরিবর্তনের পরও কিছু চরিত্র যেন এখনো অপরিবর্তিই রয়ে গেছে।

প্রতি বছরই রমজানের আগে আগে বাজারে কয়েকটি পণ্য বেশ আলোচনায় থাকে। এর মধ্যে রয়েছে আলু, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল, চিনি, ডিম, কাঁচামরিচ, খেজুর, লেবু, ব্রয়লার মুরগি, বেগুন, টমেটো ইত্যাদি। এ বছর এসব পণ্যের দামে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। তবে দু-একটি পণ্যের বাজারে অস্থিরতা দেখা গেছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি), বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও ঢাকা মেইলের আর্কাইভের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারির শেষে ও মার্চের শুরুর দিকে দিকে আলু ৩০-৪০ টাকা, পেঁয়াজ ৯০-১২০, ভোজ্যতেল ১৫৫-১৬০, চিনি ১৪০-১৪৫, ডিম ১৪০-১৫০, কাঁচামরিচ ৮০-১০০, খেজুর ৩০০ (সর্বনিম্ন), লেবু হালি ৫০-৮০, ব্রয়লার মুরগি ২২০-২৩০ টাকা কেজি, বেগুন ৮০-১০০, টমেটো ৪০-৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ওই বছর ভরা মৌসুমেও অস্থির ছিল আলু ও পেঁয়াজের বাজার। এছাড়াও অন্যান্য পণ্যের দামও ছিল সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাইরে।

bazar1

অপরদিকে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর কিছু পণ্যে অস্থিরতা থাকলেও গত বছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে বেশির ভাগ পণ্যের দাম। চলতি ফেব্রুয়ারির (২০২৫) শেষের দিকে আলু ২০-২৫ টাকা, পেঁয়াজ ৪০-৫০ টাকা, ভোজ্যতেল ১৮৫-১৯০ টাকা, চিনি ১২০-১২৫ টাকা, ডিম ১৩০-১৪০ টাকা, কাঁচামরিচ ৮০-১০০ টাকা, খেজুর ২০০ টাকা (সর্বনিম্ন), লেবু হালি ৫০-৮০ টাকা, ব্রয়লার মুরগি ২০০-২১০ টাকা কেজি, বেগুন ৮০-১০০ টাকা, টমেটো ৩০-৪০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। এই বছর আলু-পেঁয়াজে স্বস্তি থাকলেও ভোগাচ্ছে ভোজ্যতেল।

ভোক্তারা বলছেন, গত বছরের তুলনায় এই বছর বাজারে জিনিসপত্রের দামে অনেক স্বস্তি রয়েছে। বিশেষ করে আলু, পেঁয়াজ, সবজির দামে স্বস্তি ফিরেছে। শুধু সয়াবিন তেল কিনতে গেলেই ঝামেলা হচ্ছে। মনির নামে এক ক্রেতা বলেন, ‘আমার যতদূর মনে পড়ে গত বছর এই পেঁয়াজ কিনেছিলাম ৮০-৯০ টাকা কইরা। আইজকা কিনলাম ৪৫ টাকা দিয়া। আলু কিনছিলাম ৩০-৪০ টাকা কেজি, অহন ১০০ টাকায় ৫ কেজি পাওন যাইতাছে।’

আরিফুল নামে আরেক ক্রেতা বলেন, ‘এইবার রমজানে লেবু বেগুনের দাম বেশি মনে মনে হচ্ছে। সয়াবিন তেল তো টিকমতো পাওয়াই যায় না। তা বাদে সব জিনিসেরই দাম কিছুটা কম মনে হচ্ছে।’

bazar2

এদিকে পর্যাপ্ত আমদানির পরও বাজারে মিলছে না বোতলজাত সয়াবিন তেল। প্রতি বছরই কোনো না কোনো সময় সয়াবিন তেলের বাজারে এক ধরনের অস্থিরতা দেখা দেয়। অধিক মুনাফার লোভে তেলের দাম বাড়লে পুরনো দামের বোতলজাত তেল খোলা হিসেবে বিক্রি করে থাকে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। এ বছরও একই চিত্র দেখা গেছে। অর্থাৎ অনেক কিছু পরিবর্তন হলেও এই ধরনের কিছু চরিত্র এখনো অপরিবর্তিত রয়েই গেছে।

সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সংকট ঠেকাতে নড়েচড়ে বসেছে সরকার। নিয়মিত অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। সম্প্রতি ভোক্তা অধিকারের অভিজান টিম বিভিন্ন দোকানে হানা দিলে ভেতর থেকে অসংখ্য বোতল সয়াবিন তেলের সন্ধান মিলে। অথচ এই তেলের কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে অসাধু চক্র। গত সপ্তাহে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের কয়েকটি দোকানে অভিযান চালিয়ে ২০০ কার্টনের বেশি বোতলজাত সয়াবিন তেল উদ্ধার করেছে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। বিক্রেতারা এসব তেল গোপনীয় স্থানে লুকিয়ে রেখেছিলেন। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট দোকানগুলোকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

bazar3

প্রায় এক মাস ধরে বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের এই তীব্র সংকট চলছে। দোকানে দোকানে ঘুরেও ক্রেতারা বোতলের তেল কিনতে পারছেন না। খুচরা বিক্রেতাদের দাবি, কোম্পানিগুলো ও ডিলাররা পর্যাপ্ত তেল সরবরাহ করছে না। অন্যদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, চাহিদার তুলনায় দেশে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের পর্যাপ্ত আমদানি রয়েছে। আর ভোজ্যতেল উৎপাদন ও পরিশোধন কোম্পানিগুলোর দাবি, তারা নিয়মিত বাজারে তেল সরবরাহ করছে; কিন্তু কৃত্রিমভাবে দাম বাড়াতে ডিলার ও খুচরা পর্যায়ে তেল মজুদ করে রাখা হচ্ছে।

পাল্টাপাল্টি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েক দিন ধরে বাজারে অভিযান চালাচ্ছে ভোক্তা অধিদফতর। সে ধরাবাহিকতায় গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ানবাজার ও শান্তিনগর বাজারে অভিযান চালায় সংস্থাটি। কারওয়ান বাজারে অভিযানকালে সাতটি দোকানে বোতলজাত সয়াবিন তেল মজুদ করে রাখার প্রমাণ পায় ভোক্তা অধিদফতর। সংস্থাটির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অভিযানের আগে দোকানগুলোতে সাদা পোশাকে তেল কিনতে যান অধিদফতরের কর্মকর্তারা। তখন দোকানিরা জানান, তাদের কাছে বোতলজাত সয়াবিন তেল নেই। পরে অভিযান চালিয়ে দোকানগুলো থেকে ২০০ কার্টনের বেশি বোতলজাত সয়াবিন উদ্ধার করেন কর্মকর্তারা।

এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ভোক্তা অধিদফতর জানায়, অভিযানে তারা দেখেছে যে, বেশ কিছু দোকানের সহজে দৃশ্যমান স্থানে ভোজ্যতেল প্রদর্শন করা হচ্ছে না এবং ক্রেতাদের তেল নেই বলে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পরে তল্লাশিতে দোকানের গোপনীয় স্থানে বিপুল পরিমাণ ভোজ্যতেলের (৫ লিটারের ২০০ কার্টনের বেশি) মজুদ পাওয়া যায়।

কারওয়ানবাজারে অভিযানের সময় ২০২৩ সালের মে থেকে অক্টোবর সময়ে উৎপাদিত পাঁচ লিটারের ছয় কার্টন সয়াবিন তেলও জব্দ করা হয়। এসব তেলের মেয়াদ ২০২৪ সালের মে থেকে অক্টোবরে শেষ হয়েছে। আবার ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে উৎপাদিত পাঁচ লিটারের কিছু বোতলজাত সয়াবিন তেলও পাওয়া গেছে। এসব বোতলের গায়ে ৮১৮ টাকা মূল্য লেখা থাকলেও দোকানিরা ৮৫০–৮৫২ টাকা দামে বিক্রি করা হচ্ছে।

bb

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলেছে, রমজানসহ অন্যান্য সময়ও নিত্যপণ্যের সরবারহ স্বাভাবিক রাখতে গত বছরের চেয়ে বেশি পরিমাণ এলসি (ঋণপত্র) খোলা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত  এলসি খোলার হার বেড়েছে প্রায় তিন শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ভোগ্যপণ্য আমদানি করতে ৩২৬ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে এলসি খোলা হয়েছিল ৩১৬ কোটি ডলারের। সে হিসেবে গত বছরের তুলনায় এই বছরে ১০ কোটি ডলারের বেশি এলসি খোলা হয়েছে।

এ বিষয়ে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন ঢাকা মেইলকে বলেন, গত বছররের তুলনায় এই বছর অনেক পণ্যেরই দাম কমেছে। দু-একটা পণ্যে অস্থিরতা দেখা গেছে। এর মধ্যে সয়াবিন তেল। এখানে এখনো আগের মতো অবস্থা দেখা যাচ্ছে। প্রতি বছরেই রমজানকে সামনে রেখে কিছু ব্যবসায়ী অধিক মুনাফার লোভে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরির চেষ্টা করেন। এবারও ভোজ্যতেলের বাজারে এটা চলছে।

নাজের হোসাইন বলেন, এবার পর্যাপ্ত আমদানি হচ্ছে। সংকটের কোনো কারণ নেই। আমরা বিগত দিনে দেখেছি দেশে ৫-৬টি কোম্পানি সয়াবিনের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়ার পর সাপ্লাই বন্ধ করে দেওয়াটা তাদের কৌশল। সাপ্লাই বন্ধ করে দিয়ে সরকারের কাছে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়। এবারও সেটিই করা হচ্ছে। রমজানকে ঘিরে তারা এমন কারসাজি করছে। যা প্রতি বছরই করা হয়ে থাকে। খুচরা বাজারে কিছু অভিযান হচ্ছে, সরকারের উচিত মূল জায়গায় হাত দেওয়া।

এ বিষয়ে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, গত বছরের তুলনায় এই বছরে নিত্যপণ্যের দাম কিছুটা কমেছে। আবার কিছু কিছু পণ্যের সংকটও রয়েছে। যেমন সয়াবিন তেলের পর্যাপ্ত আমদানি রয়েছে, আমি দেখেছি ভলিয়মেও পর্যাপ্ত আসছে, তারপরও সংকট। এখন আমদানি স্তর থেকে ভোক্তা পর্যন্ত একটা বড় পার্থক্য থেকেই যাচ্ছে। সরকারের বাজার ব্যবস্থাপনা আরও সুসংহত করার দরকার।

টিএই/জেবি