জেলা প্রতিনিধি
০৩ অক্টোবর ২০২৫, ১০:২৯ এএম
যশোরের মণিরামপুরে বসেছে ঐতিহ্যবাহী ‘জামাই মেলা’। দুর্গাপূজার দশমীতে ব্যতিক্রমী এ মেলায় এবারও বিভিন্ন প্রজাতির বড় বড় মাছের বেচা-কেনা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২ অক্টোবর) সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলা এ বাজারে প্রায় কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয়েছে বলে দাবি করেছে স্থানীয় বণিক সমিতি।
স্থানীয়রা জানান, যশোর শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার পূর্বে মণিরামপুর উপজেলার ঢাকুরিয়া ইউনিয়ন। এ ইউনিয়নের প্রতাপকাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে প্রতি বছর বসে জামাই মেলা।
আরও পড়ুন: পদ্মার ২৫ কেজির পাঙাস সাড়ে ৬৭ হাজারে বিক্রি
বৃহস্পতিবার বিকেলে দেখা গেছে, মেলায় বিভিন্ন বয়সের শত শত মানুষের উপচেপড়া ভিড়। বাজারের মূল আকর্ষণ ছিল বড় আকারের কাতলা, রুই, ব্ল্যাক কার্প, গ্লাস কার্প, পাঙাশ, সিলভার কার্পসহ বিভিন্ন প্রকার সুস্বাদু মাছ। একেকটা মাছের ওজন ৫ থেকে ১৩ কেজি পর্যন্ত। সকাল থেকে মেয়ে জামাইরা সবচেয়ে সেরা ও বড় মাছটি কিনতে ভিড় করেন বাজারে। এরপর শুরু হয় জামাইদের প্রতিযোগিতামূলক দরদাম এবং বড় মাছ কেনার হিড়িক। যা বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করে। জামাইরা এ মাছ নিয়ে যান শ্বশুরবাড়িতে। সঙ্গে মুখরোচক খাবারও। এ দিয়ে আনন্দ উদযাপন করেন শ্বশুরবাড়ির লোকজন।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যতিক্রমী এ মেলা উৎসবে পরিণত হয়েছে। এক দিনের মাছের মেলায় বিক্রি হয় কোটি টাকার মাছ! কারণ বাজারমূল্যের চেয়ে মেলায় কয়েকগুণ বেশি দামে বিক্রি হয় মাছ।
স্থানীয়দের অভিমত হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সব ধর্মের মানুষই এখানে আসেন এবং সাধ্যের মধ্যে সবচেয়ে বড় মাছটি কিনে নিয়ে যান। ফলে বিশেষ বাজারটি এ অঞ্চলের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও লোক-সংস্কৃতির প্রতীক হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন: রাবিতে ‘মৎস্য চাষে ভবিষ্যৎ’ বিষয়ক সেমিনার অনুষ্ঠিত
একহাতে সাড়ে ৮ কেজি ওজনের কাতলা মাছ নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন প্রদীপ কুমার বাইন। মেলা মাঠে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি জানান, মেলার সামনে রাস্তায় একটি ভ্যানে বউ আর মেয়ে বসে আছে। চিনেটোলায় শ্বশুরবাড়ি। প্রতি বছর বিজয়া দশমীর দিনে শ্বশুরবাড়ি যান। যাওয়ার সময় এ মেলা থেকে বড় মাছ নিয়ে যান। মাছের সঙ্গে মুড়ি-মুড়কি, জিলাপিও। শ্বশুরবাড়িতে আনন্দ করে সবার একসঙ্গে চলে খাওয়া-দাওয়া।
শ্যামল বিশ্বাস নামে আরেক জামাই জানান, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার বাজারে মাছ কম দেখছি। এলাকার জামাইদের প্রতিযোগিতা করে মাছ কেনার অঘোষিত রীতি রয়েছে। শুধু মণিরামপুর না, অভয়নগর ও সদর উপজেলার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষও এসে এখান থেকে মাছ কিনে যায়। শুধু যে হিন্দু ধর্মের মানুষ মাছ কিনে, এটা কিন্তু না; মুসলিম ধর্মের মানুষ দল বেঁধে এসে মাছ কিনে নিয়ে যান। তিনি জানান, সাড়ে ৮০০ টাকা কেজি দরে সাড়ে চার কেজি ওজনের মাছ নিয়েছি।
এ মেলায় ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে মাছ বিক্রি করেন শংকর বিশ্বাস। তিনি বলেন, আমার নিজস্ব একটা ঘের রয়েছে। সেই ঘের থেকে আজ ভোরে মাছ ধরে ১০টার দিকে মেলায় মাছ এনেছি। মেলায় রুই, কাতলা বেশি চলে। তাই ঘেরের সবচেয়ে বড় বড় ৬৫টি মাছ ধরে মেলায় এনেছি। সবচেয়ে বড় সাড়ে ১২ কেজি ওজনের মাছটি বিক্রি করেছি।
স্থানীয়রা জানান, মেলা ঘিরে আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের বাড়িতে মেয়ে, জামাই ও নাতি-নাতনিরা এসে ভরে গেছেন। তাদের মেলার মাছসহ বিভিন্ন খাবার দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি হরেক রকমের পিঠাপুলিও রয়েছে। অনেক জামাই মেলা থেকে সাধ্যমতো মাছ কিনে শ্বশুরবাড়িতে ফেরেন। তবে এ মেলায় অনেক বিক্রেতা মাছের পসরা বসালেও সম্প্রতি একটি দ্বন্দ্বে মেলার একটি অংশের বিক্রেতারা মেলায় দোকান বসায়নি। তারা বসিয়েছে বাজারের মূল মাছ বাজারে। ফলে মেলায় বিক্রেতাও কম।
এদিকে ঢাকুরিয়া প্রতাপকাটি বাজার বণিক সমিতির সভাপতি আব্দুল হান্নান গাজী বলেন, ১৯৫০ সাল থেকে এ মেলা বসে। মেলাটি এখানকার একটি ঐতিহ্য। এখানকার জামাইরা প্রতিযোগিতা করে মাছ কেনে। মেলাকে ঘিরে বিভিন্ন মিষ্টির দোকানও বসে। এ ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমরা নানান উদ্যোগ নিচ্ছি। সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত দিনব্যাপী এ মেলায় প্রায় কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয়।
প্রতিনিধি/ এমইউ