images

সারাদেশ

হারিয়ে যাচ্ছে শেরপুরের নৃ-গোষ্ঠীদের নিজস্ব ভাষা

জেলা প্রতিনিধি

২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০১:৪৬ পিএম

‘চিঙনি খুসুক সালনা সালনা জিমাংজক’ (আমাদের ভাষা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে)। আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন বাংলাদেশ গারো ছাত্র সমাজের (বাগাছাস) নেতা জীবন ম্রং।

শেরপুর জেলার শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার বিশাল এলাকাজুড়ে গারো পাহাড় অবস্থিত। এখানেই বাস করেন নৃ গোষ্ঠীর লোকজন। জেলায় গারো, কোচ, হাজং, বানাই, ডালুসহ সাতটি নৃ গোষ্ঠীর বসবাস। এদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা। এসব পরিবারের সুখ-দুঃখের গল্পটা চলে মাতৃভাষাতেই। কিন্তু ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনতে হাঁটতে হয় বাংলা ভাষার হাল ধরে। তাই দিন দিন নিজ মাতৃভাষা হারিয়ে যাচ্ছে, আক্ষেপ তাদের।

এক সময় সমৃদ্ধ ভাষা ও সংস্কৃতি থাকলেও, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে চর্চা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ভুলতে বসেছে নিজস্ব মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি। গারো, হাজং ও কোচ ভাষা কোনোমতে টিকে থাকলেও প্রায় বিলুপ্তির পথে অন্যান্য ভাষাগুলি। প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় নিজস্ব বর্ণপরিচয়, চর্চা ও লেখাপড়ার সুযোগ না থাকায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন নৃ গোষ্ঠী নেতারা।

Shepur-2

নেতারা জানান, সাতটি নৃ গোষ্ঠীর মধ্যে গারোদের নিজস্ব ভাষার বই থাকলেও শিক্ষক না থাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বইগুলো পড়ানো যাচ্ছে না। ফলে শিকড় থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে এসব জাতিগোষ্ঠীর উত্তরসূরিরা। এদের একটি অংশ শিক্ষিত হচ্ছে আধুনিক শিক্ষায়, আর অল্প কিছু স্কুলে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা ধরে রাখার চেষ্টা করা হলেও শিক্ষক সংকট দীর্ঘদিনের। তাই ভাষা ধরে রাখতে প্রতিটি স্কুলে বইয়ের পাশাপাশি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর শিক্ষক নিয়োগ ও একটি সাংস্কৃতিক একাডেমি স্থাপনের দাবি তাদের।

বেসরকারি সংস্থা আইইডির আদিবাসী সক্ষমতা উন্নয়ন প্রকল্পের তথ্য মতে, জেলায় গারো ২৬ হাজার ৫০০, বর্মণ ২২ হাজার, হাজং ৩ হাজার ৭০০, হদি ৩ হাজার ৫০০, কোচ ৪ হাজার, ডালু ১ হাজার ৫০০, বানাই ১৫০ জন রয়েছেন।

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জন্য নিজস্ব ভাষায় বই প্রকাশে ২০১০ সালে আইন প্রণীত হয়। সে মোতাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিকের জন্য ছয়টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ভাষায় বই প্রণয়ন করে। সেগুলো হলো চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, সাঁওতাল ও সাদ্রি ভাষা। আর গারো পাহাড়ে কেবল গারোদের ভাষার বই থাকলেও পড়ানোর জন্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়নি বিদ্যালয়গুলোতে।

Sherpur-3

শিক্ষার্থী শিপা রাণী পাল বলেন, আমাদের বানাই ভাষায় পড়া বা লেখার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই ভাষাটির প্রতি আগ্রহ কমতে কমতে এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পল্লীর কেউ বানাই ভাষাতে কথা বলতে পারে না। আমরা বাঙালি ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে স্কুলে পড়াশোনা ও খেলাধুলা করায় ছোটবেলা থেকেই বাংলা ভাষা আয়ত্ত করে ফেলেছি। নতুন প্রজন্মের জন্য আমাদের নিজস্ব ভাষা বাঁচিয়ে রাখার দাবি জানাচ্ছি।

শিক্ষার্থী প্রলয় হাজং বলেন, আমাদের বয়স্করা লোকজনরা হাজং ভাষায় কথা বলতে পারলেও আমরা এখন পারি না। কারণ স্কুলে তো বাংলা ভাষা শিখে বড় হয়েছি। আমরা চাই সরকার স্কুলগুলোতে আমাদের ভাষায় শিক্ষাদান চালু করুক।

আরও পড়ুন

নিজেদের ভাষা টিকিয়ে রাখতে ‘ম্রো বর্ণমালায়’ প্রাথমিক শিক্ষা

রামেন্দ্র চন্দ্র ডালু বলেন, আমাদের ডালু ভাষা তো এখন হারিয়ে গেছে। আমাদের একজন বয়স্ক লোক ভাষাটি পারলেও আর কেউ শেখেনি। লোকটি করোনাকালিন সময়ে মারা যাওয়ার পর হতে কেউ আর ডালু ভাষা পারে না।

বাংলাদেশ গারো ছাত্র সমাজের শ্রীবরদী শাখার নেতা জীবন ম্রং আক্ষেপ করে ঢাকা মেইলকে বলেন, চিঙনি খুসুক সালনা সালনা জিমাংজক’ (আমাদের ভাষা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে)। আমাদের গারো ভাষার লিখিত কোনো রূপ না থাকায় বিভিন্ন সময় ল্যাটিন অক্ষরে লিপিবদ্ধ করা হয়। যা সবাই পড়তে পারে না। তাছাড়া বিদ্যালয়গুলোতে মাতৃভাষার শিক্ষক না থাকায় শিক্ষার্থীরা নিজেদের ভাষা শিক্ষা হতে বঞ্চিত হচ্ছে। তাছাড়া আধুনিকতার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে আমাদের নিজস্ব পোশাক, সাংস্কৃতিও হারাতে বসেছে।

Sherpur-4

শেরপুর জেলা বর্মণ পরিষদের সভাপতি পবিত্র চন্দ্র বর্মণ বলেন, গারো পাহাড়ে বাস করা বর্মণ, বানাই, ডালু ও হদি সম্প্রদায়ের একসময় নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিক আচার-অনুষ্ঠান ছিল। কিন্তু নিজস্ব ভাষার সব জায়গায় ব্যবহার না থাকায় এ সম্প্রদায়ের মানুষজন দিন দিন ভাষা ভুলতে থাকে। একপর্যায়ে সবাই এ ভাষাগুলো ভুলে গেছে। হারিয়ে ফেলেছে নিজস্ব সংস্কৃতি ও আচার অনুষ্ঠান। তারা নিজের ভাষা ভুলে প্রচলিত বাংলা ভাষাতেই কথাবার্তা বলে। এ ছাড়া এ অঞ্চলের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গারো ভাষার বই প্রণয়ন করা হলেও নেই পর্যাপ্ত শিক্ষক। অন্য ধর্মের শিক্ষকরা গারো ভাষা বুঝতে না পারায় বইগুলো পড়ে রয়েছে। তাই নিজস্ব ভাষার শিক্ষক নিয়োগের দাবিও জানাচ্ছি।

নৃ-গোষ্ঠিদের নেতা কাঞ্চন মিস্টার মারাক বলেন, আমাদের ভাষার বই সরকার দিলেও তা পাঠদানের জন্য কোনো শিক্ষক দেয়নি। আমরা চাই আমাদের ভাষা টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হোক। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের চেতনাই হলো, কোনো জনগোষ্ঠীর ভাষা হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। ভাষা আন্দোলনের চেতনা তখনই সার্থক হবে, যখন প্রতিটি জনগোষ্ঠী তার নিজের মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারবে, মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ করতে পারবে, শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারবে।

আরও পড়ুন

আমাদের স্কুলে শহীদ মিনার নেই, আমরা কয়েকজন মিলে এটা বানিয়েছি

নৃ-গোষ্ঠিদের নেত্রী কেয়া নখরেক ক্লোরিডা বলেন, ২০১৭ সালে প্রাক প্রাথমিকে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিশুদের হাতে নিজ নিজ ভাষার বই দেওয়া হয়। সেসময় পাঁচটি ভাষায় বই বিতরণ করা হয়। কিন্তু ওই ভাষার শিক্ষক বা প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকায় ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিশুদের মাতৃভাষার শিক্ষা কার্যক্রম পুরোপুরি কাজে আসেনি। তাই সরকারের কাছে আমাদের পাহাড়ি এলাকাগুলোর স্কুলে মাতৃভাষার শিক্ষক পাশাপাশি একটি কালচারাল একাডেমির দাবি জানাচ্ছি।

বেসরকারি সংস্থা আইইডির আদিবাসী সক্ষমতা উন্নয়ন প্রকল্পের ফেলো সুমন্ত বর্মণ ঢাকা মেইলকে বলেন, নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা ছাড়া শিক্ষা বা কোনো কাজেই তাদের নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করতে পারে না। প্রবীণরা নিজ ভাষায় কথা বলতে পারলেও নতুন প্রজন্ম তাদের ভাষা হারাতে বসেছে। এখন রক্ষা করা দরকার। তা না হলে একেবারে হারিয়ে যাবে আদিবাসীদের ঐতিহ্য।

Sherpur

ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান প্রাঞ্জল এম সাংমা বলেন, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলন সংগ্রামে এই ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ। আর একটি জাতি বা গোষ্ঠীর অস্তিত্ব টিকে থাকে তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর। চর্চার অভাবে আজ তারা ভাষা ও সংস্কৃতি হারাতে বসেছে। তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি ধরে রাখতে মাতৃভাষায় বই ও শিক্ষক এবং গারো পাহাড়ে একটি কালচারাল একাডেমি স্থাপন করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে এ দাবি জানিয়ে আসছি।

আরও পড়ুন

একটি ভাষা টিকিয়ে রাখতে এক তরুণের লড়াই

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. ওবায়দুল্লাহ বলেন, আশা করছি দ্রুত কর্তৃপক্ষের সহায়তায় ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের নিজস্ব ভাষার বই পাব এবং শিক্ষক পেলে আমরা এই ভাষার চর্চা অব্যাহত রাখতে পারব।

জেলা প্রশাসক আব্দুল্লাহ আল খায়রুম বলেন, আমরা ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের সবচেয়ে বেশি আগ্রহ দিয়ে বিভিন্নভাবে তাদের সংযুক্ত করছি। এরই মধ্যে একটি ছোট পরিসরে কালচারাল একাডেমি স্থাপন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গারো পাহাড়ে নৃগোষ্ঠীর লোকজনের জন্য সাংস্কৃতিক কেন্দ্র করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে এ অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজনের ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চা করা সম্ভব হবে।

প্রতিনিধি/এসএস