মাহমুদুল হাসান তুহিন
০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৫:৪৯ পিএম
উপর থেকে আমাদের গ্রহ যে চমৎকার দেখায় তা অস্বীকার করার উপায় নেই। পর্বতশৃঙ্গ, জলপ্রপাত, চমৎকার দ্বীপ এবং গভীর গিরিখাতগুলো পাখির দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষণের পর আপনাকে পৃথিবীর বিস্তীর্ণ এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর প্রশংসা করতেই হবে। ১০টি নৈসর্গিক ফ্লাইট আছে, যেখানে ভ্রমণপিপাসুরা জানালার পাশে সিট বুকিং করতে ভুলবেন না।
১. হাওয়াইয়ের কাউয়াই দ্বীপে হেলিকপ্টার ভ্রমণ
হাওয়াইয়ান দ্বীপপুঞ্জগুলোর মধ্যে সমুদ্রের তলদেশ থেকে উঠে আসে প্রধান দ্বীপ কাউয়াই এবং প্রায় ৫ মিলিয়ন বছর আগে এটিই প্রথম বিলুপ্ত হয়েছিল। তিন হাজার ফুট (৯১৪ মিটার) গভীরতা নিয়ে ওয়াইমিয়া গিরিখাত প্রায়ই ‘প্রশান্ত মহাসাগরের গ্রান্ড ক্যানিয়ন’ হিসেবে অ্যাখ্যায়িত হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে আর্দ্র স্থানটি কাউয়াই এর মাউন্ট ‘ওয়াই আলে আলে’। কাউয়াই এর দর্শনীয় স্থানগুলোর সৌন্দর্য্যের বেশিরভাগই মাটি থেকে উপভোগ করা যায় না, যা শুধুমাত্র হেলিকপ্টার থেকেই দেখা যায়।
আরও পড়ুন: হংকংয়ে যেতে লাগবে না বিমান ভাড়া, জানুন কীভাবে
২. মালদ্বীপে সী-প্লেন ফ্লাইট
মালদ্বীপের চমৎকার দৃশ্যটি হলো গভীর নীল সমুদ্র যা ছোট ছোট পাম দ্বীপগুলোকে ঘিরে আছে এবং চিনির মতো সাদা বালুর সৈকত দ্বারা বেষ্টিত। নীলের ৫০ আবরণের নান্দনিক দৃশ্য দেখার একমাত্র উপায় আকাশ থেকে দেখা। যদিও আপনি মালে বিমানবন্দরে নামার সময় কিংবা প্রস্থান করার সময় আপনার প্লেন থেকে দ্বীপগুলোর কয়েকটি ঝলক দেখতে পাবেন। মালদ্বীপে সী-প্লেন ট্রান্স মালদ্বীপ এয়ারওয়েজ বা মান্তা এয়ার দ্বারা পরিচালিত হয়। মালদ্বীপে সী-প্লেনে ভ্রমণ করা এবং পাখির দৃষ্টিকোণ থেকে উপভোগ করা চূড়ান্ত প্রাকৃতিক অভিজ্ঞতাগুলোর একটি।
আরও পড়ুন: ছোট বিমান নিয়ে বিশ্বভ্রমণে পুরো পরিবার
৩. অ্যান্টার্কটিকায় দিনের সফর কান্টাসে
অস্ট্রেলিয়া থেকে কান্টাসে চড়ে অ্যান্টার্কটিকায় একদিনের ভ্রমণে হতে পারে আপনার অভিজ্ঞতা। সেখানে যেতে কোনো পাসপোর্টের প্রয়োজন নেই। চার্টার্ড কোয়ান্টাস বোয়িং-৭৮৭ ড্রিমলাইনার চমৎকার দৃশ্যের সময় অনায়াসে গ্লাইডিং করে। ওই সময় আপনার হাতে একটি গ্লাস দিয়ে আপনাকে উষ্ণ এবং নিরাপদ রাখা হয়। অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রায় তিন ঘণ্টা দক্ষিণে যাত্রীরা সাধারণত প্রথমে বিক্ষিপ্ত বরফ দেখতে পাবেন এবং তারপরে কয়েক ডজন আইসবার্গ এবং বরফের ফ্লোস দেখতে পাবেন। বরফের ওপরে চার ঘণ্টা পর্যন্ত এবং বাকি সময় যাত্রীদের পরিষেবা দিয়ে নিজেদের উপভোগ করার জন্য প্রিমিয়াম পানীয়, সুস্বাদু খাবার এবং অ্যান্টার্কটিকার অভিযাত্রীদের কথা শোনা হয়, যা অন্য কোনো সাধারণ অভিজ্ঞতার মতো নয়।
৪. গ্রীসের সান্তোরিনির উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া
সান্তোরিনির গ্রীক দ্বীপটি বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর দ্বীপগুলোর একটি। এজিয়ান সাগরের উপরে উঁচুতে অবস্থিত সান্তোরিনির গ্রামগুলোর নিচে কালো বালির সৈকত রয়েছে। দ্বীপটি প্রায় তিন হাজার ৬০০ বছর আগে ইতিহাসের রেকর্ড বৃহত্তম আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের দ্বারা আকৃতি তৈরি হয়েছিল, যা প্রায় ১২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ৭ কিলোমিটার প্রস্থের একটি বিশাল পানিপূর্ণ গর্ত সৃষ্টি করে এবং চারিদিকে ৩শ মিটার (৯৮০ ফুট) উঁচু ক্লিফস দ্বারা বেষ্টিত ছিল। দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপলব্ধি করার সেরা উপায়গুলোর মধ্যে একটি হলো হেলিকপ্টারে বিশ্ববিখ্যাত ক্যাল্ডেরার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া। বিশেষ করে সূর্যাস্তের সময়। পিক হেলিকপ্টার দুটি হেলিকপ্টার ট্যুর আছে যার সময় ২০ মিনিট বা ৩০ মিনিট।
৫. ভুটানের পারো বিমানবন্দরে অবতরণ এবং প্রস্থান
ভুটানে ভ্রমণকারীদের জন্য ভুটানের চারটি বিমানবন্দরের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পারো’য় যাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দুই দশমিক ৪ কিলোমিটার উপরে অবস্থিত এবং পাঁচ হাজার ৫০০ মিটার (১৮ হাজার ফুট) চূড়ায় বেষ্টিত এই বিমানবন্দর বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক বিমানবন্দরগুলোর মধ্যে একটি। এই কারণে শুধুমাত্র নির্বাচিত পাইলটরাই (ভুটান এয়ারলাইন্স, বুদ্ধ এয়ার এবং ড্রুকাইর থেকে) বিমানবন্দরে অবতরণ করতে পারে। শুধুমাত্র আবহাওয়ার যে বিষয়গুলো চোখে দেখা যায় সেগুলোর অবস্থার ওপর নির্ভর করে পারোতে ফ্লাইট আসা এবং যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় এবং সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দিনের আলোতে এটি সীমাবদ্ধ। তবে আপনি যদি বিপজ্জনক পরিস্থিতি নিয়ে খুব বেশি নার্ভাস না হন তাহলে পারো নদীর ওপরে স্বচ্ছ নীল জল, ভুটানের সবুজ পাতার দৃশ্য এবং হিমালয়ের নৈসর্গিক চূড়াগুলো (মাউন্ট এভারেস্ট সহ) আপনাকে শ্বাসরুদ্ধকর এক অনুভূতি দিবে।
আরও পড়ুন: বিমানবালার সঙ্গে অসভ্যতার অভিযোগে নারী যাত্রী আটক
৬. ভেনেজুয়েলায় বিশ্বের উচ্চতম জলপ্রপাতের উপর দিয়ে ভ্রমণ
ভেনেজুয়েলার কানাইমা ন্যাশনাল পার্কে অ্যাঞ্জেল জলপ্রপাত অবস্থিত যা ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। এটি বিশ্বের সর্বোচ্চ জলপ্রপাত এবং এটি আউয়ান্টেপুই থেকে ৯৭৯ মিটার (তিন হাজার ২১১ ফুট) নিচে শয়তানের গিরিখাত নামে পরিচিত। আদিবাসীরা এটিকে কেরেপাকুপাই-মের বলে। তবে আমেরিকান বুশ পাইলট এবং স্বর্ণ শিকার অভিযাত্রী জিমি অ্যাঞ্জেলের নামানুসারে এটি অ্যাঞ্জেল ফলস নামকরণ করা হয়েছিল, যিনি ১৯৩৭ সালে এটি আবিষ্কার করেছিলেন। জলপ্রপাতের উচ্চতা এত বেশি যে মাটিতে আসার আগে প্রবল বাতাসের কারণে পানি পরমাণু হয়ে যায় এবং কুয়াশায় পরিণত হয়। জলপ্রপাতটি আমেরিকার নায়াগ্রা জলপ্রপাতের চেয়ে ১৫ গুণ উঁচু বলে ধারণা করা হয়। একটি হালকা বিমান থেকে পাখির দৃষ্টিকোণে অ্যাঞ্জেল জলপ্রপাতের পতনের নৈসর্গিক দৃশ্য আপনার ফ্লাইটটিকেও নৈসর্গিক করে তুলবে। তখন আপনার মনে হবে যে আপনি ব্রিটিশ লেখক আর্থার কোনান ডয়েলের (১৯১২) ‘দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড’-এ আছেন।
৭. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের উপর দিয়ে হেলিকপ্টারে উড়ে যাওয়া
গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ন্যাশনাল পার্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন স্থান। গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন তার বিশাল সমতল চূড়া, চূড়া এবং প্রশস্ত সমতল চূড়াসহ প্রকৃতির আসল সৌন্দর্য প্রকাশ করে। গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন দেখার সবচেয়ে দারুণ উপায়গুলোর মধ্যে হল লাস ভেগাস বা গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ন্যাশনাল পার্কের প্রবেশদ্বারের কাছ থেকে হেলিকপ্টার ভ্রমণ। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের বহিঃপ্রান্তের উপর এবং নিচ দিয়ে উড়ে যাওয়ার দৃশ্য আপনি মাটিতে কোনো দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখতে পাবেন না।
৮. অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের উপর দিয়ে নৈসর্গিক ফ্লাইট
গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ বিশ্বের অন্যতম প্রাকৃতিক বিস্ময়। এটি বিশ্বের বৃহত্তম প্রবালপ্রাচীর এবং প্রায় তিন হাজারটি পৃথক প্রাচীর, ৮৮০টি দ্বীপ এবং হাজার হাজার বিভিন্ন ধরণের উদ্ভিদ, পাখি এবং সামুদ্রিক জীবন নিয়ে গঠিত। যেকোনো ছুটিতে গ্রেট ব্যারিয়ার রিফে মাছের সাথে সাঁতার কাটা এবং প্রবালের রঙ আপনাকে আভিভূত করবে। কিন্তু গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের প্রকৃত বিশালতা সম্পূর্ণ উপলব্ধি করতে আপনাকে পানি থেকে উঠে এসে আকাশে উড়তে। ফ্লাইট থেকে প্রবালপ্রাচীর এবং হুইটসানডে দ্বীপপুঞ্জ আপনাকে শ্বাসরুদ্ধকর অভিজ্ঞতা দেবে।
৯. বতসোয়ানার ওকাভাঙ্গো ডেল্টার উপর দিয়ে ফ্লাইট
বতসোয়ানার ওকাভাঙ্গো ডেল্টা বিশ্বের সবচেয়ে আদিম মরুভূমি অঞ্চলগুলের একটি। বিশ্বের বৃহত্তম অভ্যন্তরীণ ব-দ্বীপ যা বন্য আফ্রিকার দর্শনীয় দৃশ্যে প্রবেশের সুযোগ দেয়। যেখানে একটি অস্পৃশ্য ব-দ্বীপের নির্মলতা এবং অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। ব-দ্বীপের সুবর্ণ-ঘাসযুক্ত প্লাবনভূমি, সবুজ পামের দ্বীপ, বিস্ময়কর বৈচিত্র্যময় বন্যপ্রাণী উপর থেকে পাখির দৃষ্টিকোণে দেখার সুযোগ আপনাকে একটি নৈসর্গিক ফ্লাইটের অনুভূতি দিবে। জলপথে জলহস্তী এবং গাছের ছায়ায় হাতি এবং মহিষ দেখতে পাবেন। পানির স্রোতের সাথে সাথে কীভাবে তার পথগুলো ব-দ্বীপের মধ্য দিয়ে পরিবর্তিত হয় সেটিও আপনি দেখতে পাবেন। হালকা বিমান, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একক ইঞ্জিনের বিমান দিয়ে ওকাভাঙ্গো ডেল্টার মধ্য দিয়ে আপনি ভ্রমণ করতে পারবেন। যদিও সেখানে হেলিকপ্টারের ব্যবস্থাও রয়েছে।
১০. এয়ার নিউজিল্যান্ডে চড়ে দক্ষিণ আরোরাগামী ফ্লাইট
সাউদার্ন লাইটস দেখার জন্য ২০১৭ সালের এপ্রিলে প্রথম বাণিজ্যিক ফ্লাইট নিউজিল্যান্ডের দক্ষিণ দ্বীপের ডুনেডিন থেকে যাত্রা শুরু করেছিল। এয়ার নিউজিল্যান্ড দ্বারা পরিচালিত বোয়িং-৭৬৭ এর ফ্লাইটটিতে ১৩০ জনেরও বেশি ফটোগ্রাফার এবং আরোরা উৎসাহী ছিলেন। প্রাকৃতিক আলোর ঘটনাটি কাছে থেকে দেখতে অ্যান্টার্কটিক সার্কেলের দক্ষিণে তারা ভ্রমণ করেছিলেন৷ আট ঘণ্টার ফ্লাইটটি দুইবার আন্তর্জাতিক ডেটলাইন অতিক্রম করেছিল এবং প্লেনটি দীর্ঘ সময় উড়েছিল যেন উভয় পাশের যাত্রীরা আলোগুলো ভাল ভাবে দেখতে পারে। বিশেষ আরোরা অস্ট্রালিস মিশন ছিল ওটাগো মিউজিয়ামের পরিচালক ড. ইয়ান গ্রিফিনের ধারণা। কিন্তু এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে ফ্লাইট বিক্রি হয়ে যাওয়ায় অরোরা ফটোগ্রাফারদের কল্পনায় ধরা পড়ে, এমনকি কিছু যাত্রী অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং স্পেন থেকে উড়ে এসেছিলেন। ২০২২ এবং ২০২৩ সালের জন্য বেশ কয়েকটি ফ্লাইট (বোয়িং ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনার দ্বারা পরিচালিত) পরিকল্পনা করা হয়েছে।
এমএইচটি/আইএইচ