images

কৃষি ও পরিবেশ

পাখির কলতান প্রকৃতির প্রাণ

ঢাকা মেইল ডেস্ক

২৯ মে ২০২৪, ০২:১৫ পিএম

ঋতুবৈচিত্র্যের সোনার বাংলা, সবুজ-শ্যামল ও পাখপাখালির দেশ হিসেবে সমগ্র বিশ্বে পরিচিত এক বঙ্গীয় বদ্বীপ। নানা প্রাকৃতিক উপাদান সুজলা-সুফলা এই বাংলাকে অপরূপ সৌন্দর্যে পরিণত করেছে, তার মধ্যে পাখি অন্যতম। পবিত্র আল কোরআনে বিশ্বের বিভিন্ন ভৌগোলিক অবস্থানের বিভিন্ন ধরনের পাখির বৃত্তান্ত বর্ণিত রয়েছে। তাই তো বাংলাদেশের বর্ণিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পরিবেশগত কারণ যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির আবাসস্থলে রূপান্তর হতে সাহায্য করেছে। যার শত শত প্রমাণ রয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের  বিভিন্ন নিদর্শনে চিত্রায়িত দৃশ্যে।

ঋতু পরিবর্তনের সাথে এখানে বিভিন্ন আকৃতির, রঙের এবং গঠনের পাখির বিচরণ উন্মুক্ত প্রকৃতিতে তাদের উপস্থিতি সুরেলা কণ্ঠে জানান দেয়। তাই তো নিঘুর্ম নিশীথের ঊষালগ্নে মনে পড়ে গেল ছোটবেলার  জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা সবার জনপ্রিয় কবিতা- ‘আমি হব সকাল বেলার পাখি/সবার আগে কুসুম বাগে উঠব আমি ডাকি।’

নগর কিংবা গ্রাম পাখির কলকাকলিতে জেগে উঠা উষা বাংলাদেশের মানুষের জীবনে একটি প্রাত্যহিক বাস্তব ঘটনা। বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে, বনে-জঙ্গলে, বাড়ির আঙিনায়, গাছের ডালে, খালে বিলে, নদীনালায়, হাওর বাওড়ে, ঝোঁপেঝাড়ে, সবখানেই পাখিদের সমান পদচারণা।

বাংলাদেশের মানুষ স্বভাবতই পাখি পর্যবেক্ষক, যা তাদের নিকট স্বর্গীয়। এ দেশে প্রায় ৫৫০ প্রজাতির পাখি রয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে পরিযায়ী পাখি আসে সবুজ-শ্যামল এই সোনার বাংলায়। বাংলাদেশে পরিযায়ী পাখির সবচেয়ে বড় কয়েকটি আবাস হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক লেক, মৌলভীবাজারের বাইক্কা বিল ও হাকালুকি হাওর, সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর, ফেনীর মুহুরি সেচ প্রকল্প ইত্যাদি।

পরিযায়ী পাখির উপস্থিতি আমাদের দেশের পরিবেশ ও পর্যটন শিল্পকে প্রসারিত করবে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় পরিযায়ী পাখির ইতিবাচক ভূমিকা সমন্ধে বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদ, চাকুরিজীবী, রাজনীতিবিদ, শিক্ষার্থী, সুশীল সমাজসহ সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। পরিযায়ী পাখির আবাসস্থল সমুদ্রতট, নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাওর ইত্যাদি জলাভূমিসমূহ জবর দখলের হাত থেকে সুরক্ষা, পরিবেশ ও প্লাস্টিক বর্জ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রয়োজনে সামাজিক আন্দোলন ও সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। অতীতের সৃষ্ট কাব্যিক ছন্দে বর্তমানকে মনে করিয়ে দিতে চাই –‘চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা, কোথায় উজল এমন ধারা...তার পাখির ডাকে ঘুমিয়ে উঠি, পাখির ডাকে জেগে৷’দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কালজয়ী এ গানের মতোই  গ্রাম-বাংলার ও শহরের পরিবেশ আবারও পাখ-পাখালির কলতানে এই দেশ ভরে উঠুক এই প্রতাশা করছি।

আরও পড়ুন

লাল ব্রিজ থেকে হলুদিয়া: স্বাগত জানাচ্ছে নানা রংয়ের ফুল

নিষিদ্ধ জালে বিলুপ্ত মাছ, হুমকিতে জীববৈচিত্র্য

তবে গ্লোবাল ওয়ার্মিং ও নানা মানবসৃষ্ট কারণে সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশের জন্যও অশনি সংকেত রয়েছে। সায়েন্স জার্নালে একটি বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে যে, আমরা প্রতি দশকে বিশ্বের পোকামাকড়ের জনসংখ্যার প্রায় ৯% হারাচ্ছি। আর ইকোসিস্টেমে পোকামাকড়ের সাথে পাখির আন্তঃসম্পর্ক রয়েছে যার কারণে কিছু প্রজাতির পাখি বিলুপ্তির পথে এবং যার ফলে কিছু ক্ষতিকর পোকামাকড়ের আক্রমণ ঘটে অসময়ে যা কৃষি উৎপাদনের জন্য হুমকিস্বরূপ।

রয়টার্স সূত্র এ তথ্য উল্লেখ করছে যে, বন উজাড়, শিল্প কৃষি, অপরিকল্পিত নগরায়ন, কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার, আলো দূষণ, শব্দ দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন এই প্রবণতাকে চালিত করার প্রধান কারণ।

পাখি সংরক্ষণ ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিতে হবে সরকার থেকে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে। যার মধ্যে রয়েছে কীটনাশক ও সারের ব্যবহার কমানো এবং যেখানে সম্ভব জৈব চাষের মাধ্যমে আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি যান্ত্রিকীকরণ করা পরিবেশবান্ধব পন্থায়। অন্যান্য ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে প্রাকৃতিক গাছপালা রক্ষণাবেক্ষণ, পরিকল্পিত পন্থায় বিভিন্ন জীবজন্তুর কথা চিন্তা করে বৃক্ষরোপণ এবং সংযোগ স্থাপন করা যা পাখি এবং অন্যান্য প্রজাতির জন্য খাদ্য এবং আশ্রয় প্রদান করে সেই সাথে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে বন বিভাগ অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের কাজে বিশেষভাবে নিবেদিত। পাখিসহ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য সরকার বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ জাতীয় সংসদে পাস করেছেন। সেই সাথে প্রধানমন্ত্রী পাখিসমৃদ্ধ এলাকা ও পাখিপ্রেমী ব্যক্তিদের উৎসাহিত করার জন্য "Bangabandhu Award for Wildlife Conservation" প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছেন। পাখি পরিবেশের বন্ধু তা বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশ ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১১ সালে EAAFP (East Asia Australasian Flayway Partnership) এর সদস্য হয়েছে এবং ৫টি এলাকাকে 'Flyway Site' ঘোষণা করেছে এর মধ্যে টাংগুয়ার হাওর, হাকালুকি হাওর, হাইল হাওর, সোনাদিয়া ও নিঝুম দ্বীপ।

আসুন পরিবেশ ও জলবায়ুগত চিন্তায় সোচ্চার হই পরিকল্পিত স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিভিন্ন ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ বিষয় মাথায় রেখে। পাখিদের কলতানের উপস্থিতি আমাদের আনন্দ দেয়, প্রাণে আবেদন সৃষ্টি করে সৃজনশীলতার ভাবনায় সুরেলা কণ্ঠের মোহ মায়ায়। বৈচিত্র্যময় পাখির বিচরণ, যা আমাদের চারপাশের মনোমুগ্ধকর পরিবেশে বৈচিত্র্য আনে। মূলত বাংলাদেশ বন্যপ্রাণীর কারণেই এত শৈল্পিক, কাব্যিক, সতেজ ও প্রাণবন্ত।

লেখক: জাবি শিক্ষার্থী