images

কৃষি ও পরিবেশ

গ্যাস সংকটে জ্বলছে না চুলা, শিল্প খাতও ‘গতিহারা’

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন

১৬ জানুয়ারি ২০২৪, ০৯:০৩ এএম

আবাসিক ও শিল্পখাতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় তীব্র গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। রাজধানীর আবাসিক এলাকায় প্রতিদিন সকাল সাতটা থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত একেবারেই গ্যাস মিলছে না। অনেক এলাকায় রাত ১২টার দিকে এসে আবার ভোরেই চলে যায় গ্যাস। আগে কিছু এলাকা এলাকাকেন্দ্রীক গ্যাস সংকট থাকলেও এখন পুরো রাজধানীজুড়ে এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। ফলে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে। শুধু আবাসিকেই নয়, গ্যাসের তীব্র গ্যাস সংকট রয়েছে শিল্প কারখানাতেও। গ্যাসের অভাবে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় সময়মত বিদেশি ক্রেতাদের পণ্য সরবরাহ করতে পারবেন কিনা তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন ব্যবসায়ীরা।

রাজধানীর মালিবাগ, বাসাবো, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, মুগদা, মান্ডা, মানিকনগর, জুরাইন, কামরাঙ্গীচর এলাকায় গ্যাস সংকট নিয়মিত সমস্যা ছিল। সম্প্রতি নগরীর মগবাজার, ইস্কাটন, গুলশানসহ অনেক আভিজাত এলাকাতেও গ্যাসের সংকট তীব্র হয়েছে। ফলে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে মানুষকে।

আরও পড়ুন

তীব্র গ্যাস সংকটে ইলেক্ট্রিক চুলায় ঝুঁকছে মানুষ

এসব এলাকার অধিকাংশ ভুক্তভোগীর ভাষ্য, সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৪-৫টা পর্যন্ত গ্যাস থাকছে না। রাতে রান্না করে রাখার পরে সকালে দিনের বেলা যে তা গরম করবেন সেই উপায়ও থাকছে না অনেক এলাকায়। ফলে বাধ্য হয়ে অনেকে সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করছেন। ঝুঁকছেন ইলেকট্রিক চুলায়।

রাজধানীর, মুগদা এলাকার বাসিন্দা শাহানাজ বলেন, ‘কিছুদিন ধরে গ্যাস একেবারেই থাকছে না। আগে তাও সকালের দিকে থাকত, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকত। কিন্তু এখন সকালেও গ্যাস থাকছে না। কয়েকদিন আগে রাত ১১টার পরে আসত। এখন সেটাও বন্ধ হয়েছে।’

gas-৩বাসাবো এলাকার নাজমুল বলেন, ‘অনেকদিন ধরেই গ্যাসের সমস্যা। মাসখানেক আগে সকাল-সন্ধ্যা একটু থাকত। এখন সেটাও থাকে না। তিতাস অফিসে বারবার যোগাযোগ করেও কোনো লাভ হয় না। যেন তাদের কোনো দায়দায়িত্ব নাই।’

শুধু আবাসিকেই নয়, গ্যাসের তীব্র সংকট দেখা দিয়ে শিল্প কারখানাতেও। গ্যাস সংকটে ব্যাহত হচ্ছে শিল্প কারখানার উৎপাদন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাস সংকটের কারণে অনেক অঞ্চলের ৫০-৬০ শতাংশ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এর ফলে রফতানি কমে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

বদলে গেছে রান্নার ‘রুটিন’

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বেশ কিছু জায়গায় তীব্র গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জ, রূপগঞ্জ, আড়াইহাজারসহ অনেক এলাকায় গ্যাসের অবস্থা খুবই খারাপ। এসব এলাকায় বলতে গেলে গ্যাস নাই। এর ফলে প্রোডাকশন ড্রপ পড়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু এরিয়ায় ৫০-৬০ শতাংশ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আবার ম্যাক্সিমাম এলাকায় ২০-৩০ শতাংশ উৎপাদন লস হচ্ছে। সরকার-কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করতেছি। এখন পর্যন্ত সেরকম কোনো ইম্প্রুভমেন্ট হয়নি।’

ফারুক হাসান আরও বলেন, ‘এমনিতেই সারা ওয়ার্ল্ডের অবস্থা এখনও সেভাবে ফিরে আসে নাই। অর্ডার কম, কস্ট বেড়ে গেছে, ইন্টারেস্টের রেট বাড়ানো হয়েছে। আজকে রিজার্ভ কমে যাওয়ায় আইএমএফ এর লোন নিতে হচ্ছে। আমরা বলছি আইএমএফ এর লোন নিতে হবে না, যদি গ্যাস সরবরাহ ঠিক রাখা হয়। আমাদের উৎপাদন ঠিকভাবে হলে আমরা এক্সপোর্ট আরও বাড়াতে পারব। আমি মনে করি গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার জন্য সরকারের যেই ধরনের একটিভিটিজ দরকার সেটা করা উচিত।’

gazipur-গ্যাস সংকটের কারণে জামালপুরের তারাকান্দির যমুনা সার কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। সোমবার বিকেল সাড়ে তিনটায় তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি থেকে গ্যাস সংযোগ বন্ধ করার পরই উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। প্রতিদিন ১ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন দানাদার ইউরিয়া সার উৎপাদন হয় এই কারখানায়। এখানকার সার জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইলসহ কমান্ড এরিয়াভুক্ত ১৯ জেলায় সরবরাহ করা হয়।

শিগগিরই এই গ্যাস সংকট কমার সম্ভাবনা দেখছে না সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিসন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হারুনুর রশীদ মোল্লার সঙ্গে কয়েকবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন

বিদ্যুৎ বিলে ‘ভূতের আছর’

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিতাসের এক শীর্ষ কর্মকর্তা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘টোটাল তিতাসের এরিয়াতেই গ্যাসের স্বল্পতা রয়েছে। সাপ্লাই এবং ডিমান্ড দুইটারই হেরফের হয়ে গেছে। শীতের সময় সাধারণত চাহিদা বেশি থাকে। তাই সংকট দেখা দেয়। কবে এই সংকট কাটবে আপাতত বলা যাচ্ছে না।’

অনেক গ্রাহক তিতাসের স্থানীয় অফিসগুলোতে গ্যাস না পাওয়ার অভিযোগ করেও কোনো সুরাহা পাচ্ছে না। উল্টো বকেয়া বিলের কারণে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) বক্তব্য জানতে চাওয়া হলে কমিশনের চেয়ারম্যান নূরুল আমিন ঢাকা মেইলকে বলেন ‘এই বিষয়টা আমার জানা নাই। আপনার কাছেই প্রথম শুনলাম। আমরা এটার খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেব।

gas-20পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে, এলএনজি আমদানি করে দুটি ভাসমান টার্মিনালের মাধ্যমে তা আবার গ্যাসে রূপান্তর করে পাইপলাইনে সরবরাহ করা হয়। এর মধ্যে একটি টার্মিনাল গত ১ নভেম্বর থেকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্ধ আছে। দুটো টার্মিনাল মিলে গ্যাস সরবরাহ করে ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। আর যেটি চলছে, সেটি বর্তমানে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো সরবরাহ করছে। এতে সংকটি দেখা দিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীসহ বেশ অনেক এলাকায় অনেক আগে থেকেই ঠিকমত গ্যাস না দিয়ে ভোক্তাদের ওপর জুলুম করছে তিতাস।

এ বিষয়ে ক্যাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, তিতাস ৬০ ইউনিট গ্যাস বাসা-বাড়িতে সরবরাহ করবে এজন্য একটি বিল নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিতাস কখনই এই পরিমাণে গ্যাস নিরবচ্ছিন্নভাবে সরবরাহ করেছে বলে দুই দশক ধরে সেই প্রমাণ নাই। একসময় ৮৮ ইউনিটের দাম নিত। তারপরে গত গণশুনানিতে দেখা গেল যে গড়ে ৪৫ ইউনিট গ্যাস পাওয়া যায়। সেখানে বিইআরসি তাদেরকে ফেবার করে ৬০ ইউনিট গ্যাস ধরে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। এখন তারা গ্যাস সরবরাহ না করেও পুরো বিল নিচ্ছে। এটা এক ধরনের জুলুম।

আরও পড়ুন

‘সিন্ডিকেটের’ কাছে অসহায় ভোক্তা

শামসুল আলম আরও বলেন, আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দিতে বারবার পরামর্শ দেওয়া হলেও সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে না। তারা এলএনজি আমদানির দিকেই বেশি ঝুঁকছে। এজন্য এই ধরনের সংকট হবে এটাই স্বাভাবিক। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এখন থেকেই নিজস্ব সোর্স বাড়াতে অনুসন্ধানে জোর দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

টিএই/এমআর