নিজস্ব প্রতিবেদক
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৫:৪৪ পিএম
যানবাহনের কালো ধোয়াসহ নানা কারণে সৃষ্ট বায়ুদূষণের ফলে বাংলাদেশিদের গড় আয়ু কমছে ৬ বছর ৮ মাস। যেখানে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষের গড় আয়ু কমছে ২ বছর ৪ মাস। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত বায়ুদূষণ বিষয়ক বৈশ্বিক প্রতিবেদন ‘এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স-২০২৩’ এ এমন তথ্যই উঠে এসেছে।
মঙ্গলবার (২৬ সেপ্টেম্বর) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর-রুনী মিলনায়তনে আয়োজিত ‘বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে করণীয়’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)।
সংবাদ সম্মেলনে দেশের বায়ুদূষণের চিত্র তুলে ধরেন সংগঠনটির যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার। তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত বায়ুদূষণবিষয়ক ‘এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স-২০২৩’ বৈশ্বিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। এরমধ্যে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর গাজীপুর। এরপর ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলার অবস্থান। আর সবচেয়ে কম বায়ুদূষণের শহর সিলেট।
বায়ুদূষণের নেতিবাচক ফল তুলে ধরে তিনি বলেন, এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স-২০২৩ প্রতিবেদন অনুযায়ী- বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বের সব মানুষের গড় আয়ু ২ বছর ৪ মাস কমেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের একজন নাগরিকের গড় আয়ু কমেছে ৬ বছর ৮ মাস। আয়ুষ্কালের পরিপ্রেক্ষিতে বাতাসে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা বাংলাদেশে মানব স্বাস্থ্যের জন্য দ্বিতীয় বৃহত্তম হুমকি বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডিজিজেস অব দ্য চেস্ট অ্যান্ড হসপিটালে ২০২১ সালে আউটডোর এবং জরুরি বিভাগ মিলিয়ে ২ লাখ ১০ হাজার রোগী চিকিৎসাধীন ছিল। সাত বছর আগেও এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৮৫ হাজার। অন্যদিকে, রাজধানীর জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুলাই মাসে হাসপাতালে ভর্তি, আউটডোর ও জরুরি বিভাগ মিলিয়ে রোগীর সংখ্যা ছিল ১২ হাজারের কিছু বেশি। যা চলতি বছরের জুলাইয়ে ১৪ হাজার অতিক্রম করেছে।
এছাড়াও বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, সীসা দূষণের ফলে বাংলাদেশে প্রতিবছর হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে ১ লাখ ৩৮ হাজারের বেশি মানুষ। এ কারণে শিশুদের আইকিউ কমে যাচ্ছে এবং বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।
দেশের বিভিন্ন জেলার বায়ুদূষণের চিত্র তুলে ধরে বাপা’র যুগ্ম সম্পাদক বলেন, গাজীপুরের বাতাসে অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা, যার ব্যাস সাধারণত ২ দশমিক ৫ মাইক্রোমিটার বা এর চেয়ে ছোট কণা, যা প্রতি ঘনমিটারে ৮৯ দশমিক ৮ মাইক্রোগ্রাম পাওয়া যায়। এই মান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্ধারিত মাত্রার (৫ মাইক্রোগ্রাম) চেয়ে ১৮ গুণ বেশি এবং নির্ধারিত বার্ষিক মাত্রার চেয়ে ৬ গুণ বেশি।
এছাড়াও নোয়াখালীতে প্রতি ঘনমিটারে ৮৮ দশমিক ৭ মাইক্রোগ্রাম, কুমিল্লাতে প্রতি ঘনমিটারে ৮৮ দশমিক ২ মাইক্রোগ্রাম, চাঁদপুরে প্রতি ঘনমিটারে ৮৭ দশমিক ৮ মাইক্রোগ্রাম, ঢাকায় প্রতি ঘনমিটারে ৮৭ দশমিক ২ মাইক্রোগ্রাম, নারায়ণগঞ্জে প্রতি ঘনমিটারে ৮৬ দশমিক ৯ মাইক্রোগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রতি ঘনমিটারে ৮৩ দশমিক ১ মাইক্রোগ্রাম, কিশোরগঞ্জে প্রতি ঘনমিটারে ৮২ মাইক্রোগ্রাম এবং টাঙ্গাইলে প্রতি ঘনমিটারে ৮১ মাইক্রোগ্রাম অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণার (২ দশমিক ৫ ব্যাসের ছোট কোণা) উপস্থিতি পাওয়া যায়।
অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার জানান, সবচেয়ে কম দূষিত জেলা হিসেবে পাওয়া গেছে সিলেট জেলাকে। যার প্রতি ঘনমিটারে ৪৮ দশমিক ৫ মাইক্রোগ্রাম বস্তুকণা পাওয়া গেছে এবং এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে ৯ দশমিক ৭ গুণ বেশি ও বাংলাদেশের নির্ধারিত জাতীয় আদর্শ (বার্ষিক) মাত্রার চেয়ে ৩ দশমিক ২৩ গুণ বেশি।
বায়ুদূষণের কারণগুলো উল্লেখ করে তিনি বলেন, বায়ুদূষণের কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রাকৃতিক ও আবহাওয়াজনিত কারণ, নগর পরিকল্পনায় ঘাটতি, আইনের দুর্বলতা, আইন প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা, ভৌগোলিক কারণ এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব। ক্যাপসের গবেষণা থেকে পাওয়া যায়, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণকাজ থেকে ৩০ শতাংশ, ইটভাটা ও শিল্প কারখানা থেকে ২৯ শতাংশ, যানবাহন থেকে ১৫ শতাংশ, অন্তর্দেশীয় বায়ুদূষণ থেকে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ, গৃহস্থালি বা রান্নার চুলার কাজ থেকে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ এবং বর্জ্য পোড়ানো থেকে ৮ শতাংশ বায়ুদূষণ ঘটে।
দূষণ কমাতে করণীয় নিয়ে বাপা’র এই যুগ্ম সম্পাদক বলেন, বায়ুর মান উন্নয়নে স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। স্বল্পমেয়াদী পদক্ষেপ হিসেবে নির্মাণ সামগ্রী ঢেকে রাখা, দূষিত শহরগুলোতে প্রতি ২ থেকে ৩ ঘণ্টা পরপর পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করা, ধুলা সংগ্রহের জন্য সাকশন ট্রাকের ব্যবহার, অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করা, ব্যক্তিগত গাড়ি এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
এছাড়া দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ হিসেবে নির্মল বায়ু আইন-২০১৯ দ্রুত প্রণয়ন করা ছাড়াও পরিবেশ সংরক্ষণ ও সচেতনতা তৈরির জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো, পরিবেশ ক্যাডার সার্ভিস এবং পরিবেশ আদালত চালু ও কার্যকর করার কথা জানানো হয় সম্মেলনে।
সংবাদ সম্মেলন অন্যদের মধ্যে বাপা’র সভাপতি নুর মোহাম্মদ তালুকদার, সহ-সভাপতি অধ্যাপক এম শহীদুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক আলমগীর, পরিবেশবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
এমএইচ/আইএইচ