রোববার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ভয়াবহ আবহাওয়া বিপর্যয়ের মুখে দেশ

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
প্রকাশিত: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৩:৫৭ পিএম

শেয়ার করুন:

ভয়াবহ আবহাওয়া বিপর্যয়ের মুখে দেশ
ভরা বৃষ্টির মৌসুমেও বৃষ্টির অভাবে ব্যাহত হচ্ছে কৃষিকাজ। ছবি: ঢাকা মেইল

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভয়াবহ আবহাওয়া বিপর্যয়ের মুখে সারা বিশ্ব। আশঙ্কাজনক হারে কমছে বৃষ্টিপাত। ভরা মৌসুমেও দেখা মিলছে না বৃষ্টির। বাড়ছে তাপমাত্রা। এর প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশেও। যে সময়গুলোতে রাত দিন অঝরে বৃষ্টি হওয়ার কথা, খালে বিলে মাঠে-ঘাটে পানি থইথই করার কথা, সেই সময় মৌসুমি ফসলও চাষ করতে হচ্ছে সেচের পানি দিয়ে। ভরা বর্ষাকালে ফসলের মাঠে ধুলা উড়ছে।

কৃষিজমিতে সেচে ব্যবহৃত জ্বালানির ব্যয়ও বেড়েছে। খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকের কপালে এখন চিন্তার ভাঁজ। যার পরিপ্রেক্ষিতে কৃষিখাতে বিপর্যয়ের আশঙ্কাও করছেন সংশ্লিষ্টরা।


বিজ্ঞাপন


দেশে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় জুলাই-আগস্ট মাসে। জুলাই মাসে বৃষ্টির প্রবণতা বেশি থাকে। তবে বাংলাদেশে এ বছর গড় বৃষ্টিপাত হয়েছে অর্ধেকেরও কম।

আবহাওয়া অধিদফতরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ বছরে জুলাই মাসের গড় বৃষ্টিপাতের তুলনায় এ বছর জুলাইয়ে ৫৭ দশমিক ৬ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। এ বছর জুলাইয়ে গড় বৃষ্টিপাত ছিল ২১১ মিলিমিটার (মি.মি.), যা ১৯৮১ সালের পর সর্বনিম্ন। অন্যদিকে গত ৩০ বছরের গড় বৃষ্টিপাত ছিল ৪৯৬ মি.মি.। ২০২০ সালে গড় বৃষ্টিপাত হয়েছিল ৫৫৩ মি.মি., যা অন্যান্য বছরের তুলনায় ১১ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি। ২০২১ সালে গড় বৃষ্টিপাত হয়েছিল ৪৭১ মি.মি., যা অন্যান্য বছরের তুলনায় ৫ দশমিক এক শতাংশ কম।

আরও পড়ুন: পুড়ছে মানুষ, জ্বলছে ফসল, এ কেমন বর্ষাকাল!


বিজ্ঞাপন


বৃষ্টিপাত কমেছে আগস্ট মাসেও। আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, আগস্ট মাসে সারাদেশে স্বাভাবিক অপেক্ষা ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। এই মাসে স্বাভাবিকভাবে বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা ছিল ১৫ হাজার ৬৪ মিলিমিটার। সেখানে ৩০ আগস্ট পর্যন্ত রেকর্ড হয়েছে নয় হাজার ৬৫৯ মিলিমিটার। এ মাসে গড় বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে ২৫৬ মিলিমিটার। অথচ স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৪০২ মিলিমিটার। যা গত ৪২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।

weather2

চলতি সেপ্টেম্বর মাসেও দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। আগস্ট মাসে সবচেয়ে কম বৃষ্টি হয়েছে ঢাকায়, যা গড় ১৯৮ মিলিমিটার। আর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে সিলেটে, গড় ৪১০ মিলিমিটার।

আরও পড়ুন: শিশুরা হারাচ্ছে বৃষ্টিভেজা শৈশব, কমছে শারীরিক-মানসিক বিকাশ

দেশের প্রধান খাদ্যশস্য ধানের কিছু জাতের ফলন বৃষ্টিপাতের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। ফলে এ বছর কম বৃষ্টিপাতের কারণে দেশের ধান উৎপাদনে প্রভাব পড়েছে। আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য মতে, অন্যান্য বছরের তুলনায় জুলাইয়ে গড় তাপমাত্রা বেড়েছে। জুলাইয়ে গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৩ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যেখানে গত ৩০ বছরের গড় তাপমাত্রা ৩১ দশমিক এক ডিগ্রি সেলসিয়াস।

কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

গবেষকরা বলছেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে সারা বিশ্বেই। অনেক দেশের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশেও এর প্রভাব ভয়াবহভাবে দেখা দিয়েছে। এটার জন্য এককভাবে কেউ দায়ী নয়। এটার জন্য আন্তর্জাতিক পরিবেশ এবং আন্তর্জাতিক জলবায়ু দায়ী। আর এটা আসছে পাশ্চাত্যের যে দেশগুলো অতিমাত্রায় জ্বালানি ব্যবহার করছে, তাদের কাছ থেকে।

weather3

এ বিষয়ে আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বর্তমান এই আবহাওয়া বিপর্যয়ের একমাত্র কারণ হচ্ছে ক্লাইমেট চেঞ্জ, গ্লোবাল ওয়ার্মিং। এখন বিভিন্ন কারণে গ্লোবাল ওয়ার্মিং হচ্ছে। কিছুটা হচ্ছে প্রাকৃতিক কারণ। আর কিছুটা হচ্ছে মানবসৃষ্ট কারণে। গ্লোবাল ওয়ার্মিংটায়ের কারণে আমাদের গ্রিন হাউজে গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন শিল্পায়ন বা ইন্ডাস্ট্রিয়ালের ফলে গ্রিন হাউজের গ্যাস নিঃসরণ বাড়ছে। গ্রিন হাউজের কাজ হচ্ছে তাপ আটকে রাখা। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ফলে আইস গলে যাচ্ছে। সমুদ্রের পৃষ্টতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমুদ্রের পানি প্রসারিত হয়ে তার আয়তন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাপমাত্রা যদি বাড়ে তবে পানির ভলিয়ম বাড়ে। এটাকে বলে থার্মাল এক্সপানশন। এবং সমুদ্রের বিশাল জলরাশির ওপর পানি বাস্পায়নের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বাড়ছে। বিভিন্ন এলাকায় আবহাওয়া ও জলবায়ু রিলেটেট বিপর্যয়গুলোর পরিমাণও বাড়ছে।

আরও পড়ুন: হুমকিতে আমনের লক্ষ্যমাত্রা, কৃষকের কপালে চিন্তার ভাঁজ

এই আবহাওয়াবিদ বলেন, ২০২২ সালে সারা বিশ্বেই আবহাওয়া বিপর্যয়। বিভিন্ন দেশের তাপমাত্রা এখন ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আমরা জুলাই এবং আগস্ট মাসে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করি। গেল জুলাই মাসে আমাদের ৫৭ ভাগ বৃষ্টি কম হয়েছে। আগস্টে কম হয়েছে ৩৬ ভাগ।

weather4

স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার ঢাকা মেইলকে বলেন, এখনকার যে বৃষ্টিপাতের যে ইনডেনসি, এটার যে নেচার, ধরন বা প্রকৃতির পরিবর্তন হচ্ছে তার দুটি কারণ। একটি হলো বৈশ্বিক কারণ, আরেকটি আঞ্চলিক কারণ। বৈশ্বিক কারণ বলতে জলবায়ু পরিবর্তন মূলত এর জন্য দায়ী। সেই ক্ষেত্রে সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃষ্টিপাতের যে ট্রেইন্ড আছে, সিজন যেভাবে কাউন্ট করা হতো এখন সেভাবে আর হচ্ছে না। আর স্থানীয় কারণ বলতে এখন আমাদের দেশে নগরায়ন ও শিল্পায়ন বাড়ছে। সবুজায়নের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। সবুজের পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে আরেকটি প্রভাব ফেলছে যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঠান্ডা এলাকার সংখ্যা কমে যাচ্ছে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, আমাদের জলাধারের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। জলাধার ভরাট হয়ে হয় বসতি কিংবা নগরায়নের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। নগরের উষ্ণতা বাড়ছে। এগুলোই কিন্তু জলবায়ু পবির্তনের মূল কারণ।

আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, আজকে যদি জলাধার ও সবুজায়ন বেশি থাকত তাহলে নগরায়নের উষ্ণতা প্রভাব ফেলতে পারত না। আজকে সবুজায়ন জলাধার বেশি থাকলে সেটা জলীয় বাষ্প হয়ে বৃষ্টি তৈরি করত। যেহেতু আমাদের জলাধার যতেষ্ট কম, তাই বৃষ্টিপাতের পরিমাণও স্থানীয় পর্যায়ে কমে যাচ্ছে। আজকে সিলেট অঞ্চলে দেখেন, সেখানে সবুজায়ন বেশি, হাওরের জলাধারের পরিমাণ বেশি, তাই সেখানে ভালোই বৃষ্টিপাত হচ্ছে। সেখান থেকেই আমরা বুঝতে পারি আমাদের সবুজায়ন বাড়াতে হবে। জলাধার বাড়াতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করতে হবে।

টিএই/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর