প্রচণ্ড তাপদাহের পর গত জুলাইয়ের শেষদিকে স্বস্তির বৃষ্টির দেখা মিলেছিল। তবে পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় বাধ্য হয়েই দেশের অনেক অঞ্চলেই আমনের চারা রোপণের সময় পেছানো হয়েছে। যদিও আমন রোপণের বাকি সময়েও পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। এরমধ্যে আবার কৃষকদের সারের প্রাপ্তি নিয়েও মাঝখানে গুঞ্জন উঠেছিল। সঙ্গে বেড়েছে দামও। পাশাপাশি কৃষিজমিতে সেচে ব্যবহৃত জ্বালানির ব্যয়ও বেড়েছে।
সবমিলিয়ে ধান লাগানোর পর কৃষি উৎপাদনের সবচেয়ে মৌলিক এই দুটি উপকরণের খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের অনেক অঞ্চলের কৃষকেরই কপালে এখন চিন্তার ভাঁজ। যার পরিপ্রেক্ষিতে কৃষিখাতে বিপর্যয়ের আশঙ্কাও করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিজ্ঞাপন
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, ৫৯ দশমিক ০৫ লাখ হেক্টর জমিতে আমন রোপণের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও, এখন পর্যন্ত রোপণ হয়েছে ১৫ দশমিক ৭৪ লাখ হেক্টর জমিতে। এতে আমনের ফলন কমার শঙ্কা করছেন কৃষকরা। যেখানে গত আমন মৌসুমে সারাদেশে প্রায় ১ দশমিক ৫ কোটি টন চাল উৎপাদন হয়েছিল। যার হেক্টরপ্রতি ফলন ছিল ২ দশমিক ৬ টন।
এরমধ্যে গত ৩০ বছরে বাংলাদেশে জুলাই মাসে গড় বৃষ্টিপাত হয়েছে ৪৯৬ মিলিমিটার। কিন্তু চলতি বছরের জুলাইয়ে মোট বৃষ্টিপাত হয়েছে মাত্র ২১১ মিলিমিটার যা ১৯৮১ সালের পর সর্বনিম্ন।
এদিকে, বর্তমানে দেশে ইউরিয়া সার ব্যবহার হচ্ছে ২৬ লাখ ৫০ হাজার টন। এর বেশিরভাগই ব্যবহার হচ্ছে কৃষি খাতে। ইতোমধ্যেই সরকার এই সারের দাম কৃষক পর্যায়ে কেজি প্রতি চার টাকা বৃদ্ধি করেছে। সেই হিসাবে চলতি আমন এবং আগামী বোরো মৌসুমে শুধু সারের জন্য কৃষকের বাড়তি খরচ হবে ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
বিজ্ঞাপন
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সারের দাম বৃদ্ধির রেশ কাটতে না কাটতেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার। এ ক্ষেত্রে এক লাফেই ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে প্রায় ৪৩ শতাংশ। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে মূল্য সমন্বয়ের কথাও জানানো হয়েছে। তবে কৃষি উৎপাদনের সবচেয়ে মৌলিক দুটি উপকরণ সার ও সেচের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধিতে এই খাতে বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।
কৃষকদের মতে, এবার বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাত অনেক কম। এতে স্বাভাবিকের চেয়ে সেচ বেশি লাগছে। কিন্তু ডিজেলের দাম বাড়ানোয় খরচ কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। আর সারের জন্য বাড়তি খরচ হবে। এতে চলতি আমন এবং আগামী বোরো মৌসুমে প্রতি কৃষিপণ্যের উৎপাদন ব্যয়ও বাড়বে। এমতাবস্থায় অনেক কৃষক জমির আবাদ কমিয়ে দিতে পারেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এর প্রভাবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে উৎপাদন অনেক কমে যাবে। সেই সঙ্গে খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা তৈরি হবে।
এদিকে, চলমান বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় দেশের মোট চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত খাদ্যশস্য মজুদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে আমদানির উৎস বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন সরকারপ্রধান। বর্তমান দেশে ১৯ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে। ফলে আমনের ফসল কিছুটা কম হলেও যাতে কোনো ধরনের প্রভাব না পড়ে সে কারণে প্রয়োজনে আমদানি করে খাদ্যশস্যের ঘাটতি মেটানো নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সরকারপ্রধান বলেন, বর্তমানে পাঁচটি দেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানির প্রক্রিয়া চলছে। আরও উৎস খোজা হচ্ছে। এছাড়াও আমনের সেচ সুবিধার জন্য রাত ১২টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের ঘোষণায় সংশ্লিষ্টদের ওপরও সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
অন্যদিকে, কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, বেশকিছু কারণে চলতি আমন মৌসুমে চাষাবাদে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটছে। তবে এতে খাদ্য ঘাটতির কোনো আশঙ্কা নেই। সারাদেশে লোডশেডিং চললেও আমন চাষাবাদ এলাকায় রাত ১২টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকায় সেচ নিয়ে কোনো সমস্যায় পড়তে হচ্ছে না কৃষকদের। ফলে উৎপাদনে তেমন সমস্যা হবে না। এছাড়াও সরকার অতিরিক্ত সাবধানতার কারণে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি খাদ্য মজুদের জন্য চাল আমদানির প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় চাল রফতানিকারক ভারতের কিছু অংশে বৃষ্টির ঘাটতির কারণে চালের উৎপাদন কমে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। যা বিশ্বব্যাপী খাদ্য সরবরাহের জন্য পরবর্তীতে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়াবে বলে মত সংশ্লিষ্টদের। এরই মধ্যে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তরপ্রদেশসহ কিছু রাজ্যে বৃষ্টিপাতের অভাবে এই মৌসুমে ধান রোপণের জমি ১৩ শতাংশ কমেছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশেও কম বৃষ্টিপাতের প্রভাবে এমন আশঙ্কা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
টিএ/আইএইচ