বৃহস্পতিবার, ২ মে, ২০২৪, ঢাকা

শিশুরা হারাচ্ছে বৃষ্টিভেজা শৈশব, কমছে শারীরিক-মানসিক বিকাশ

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
প্রকাশিত: ৩০ আগস্ট ২০২২, ১১:২৪ পিএম

শেয়ার করুন:

শিশুরা হারাচ্ছে বৃষ্টিভেজা শৈশব, কমছে শারীরিক-মানসিক বিকাশ
ছবি: সংগৃহীত
 

‘সেই দিনের কথা আর কি বলব ভাই। এখনকার ছেলেপুলে তো খেলাধুলা কি জিনিস- জানেই না। তারা খেলাধুলা বলতে বুঝে শুধু মোবাইল গেম। আমরা কত খেলাধুলা করেছি। বৃষ্টি হলে তো কোনো কথাই নাই! ভিজে ভিজে ফুটবল খেলা, ছুটোছুটি করা। এই পাড়া থেকে ওই পাড়া ছুটে বেড়ানো। বৃষ্টিতে ভিজে সাইকেলের টায়ার চালিয়েছি। আবার পুকুরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গোসল করেছি। চোর-পুলিশ খেলেছি। আমাদের শৈশবটাই ছিল অন্যরকম। কি দিন ছিল আর কি দিন আসলো! এসব কথা মনে হলে চোখে পানি চলে আসে।’


বিজ্ঞাপন


জল টলমল চোখ এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন দিনাজপুর জেলার প্রত্যন্ত একটি গ্রামে বড় হওয়া রুবেল। বর্তমানে চাকরি করছেন রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। নব্বই দশকের শৈশবকালের কথা জানাতে গিয়ে এভাবেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি।

শৈশবে কাটানো সময়ের কথা বলতে গিয়ে একই কথা জানালেন টাঙ্গাইলের সোহাইবও। তিনি বলেন, ‘সেই দিনগুলো ছিল অন্যরকম। যা বলে বোঝানো যাবে না। সবথেকে আনন্দের বিষয় ছিল- হাফ প্যান্ট পরে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ফুটবল খেলা। তখন আমাদের বই বহনে জন্য ব্যাগ ছিল না। বৃষ্টির দিনে সবাই একটা পলিথিন ব্যাগ সাথে রাখতাম। স্কুল ছুটির পর বৃষ্টি হলে বইগুলো পলিথিন ব্যাগে ভরে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বাড়িতে চলে আসতাম। আবার বইগুলো রেখে অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজে খেলাধুলা করতাম। দীর্ঘসময় বৃষ্টিতে ভিজলেও জ্বর-সর্দি কিছুই আসত না। আমরা যে পরিমাণ খেলাধুলা করেছি, এখনকার ছেলে-মেয়ে সেই খেলার নামই জানে না।’

Special News
ছবি: সংগৃহীত।

শুধু রুবেল বা সোহাইব-ই নয়, ১৫ থেকে ২০ বছর আগের শিশুদের শৈশবগুলা ঠিক এমনই ছিল। তখন বৃষ্টি হলেই আনন্দে নেচে উঠত শিশুরা। বাবা-মা নিষেধ করার স্বত্বেও লুকিয়ে মাঠে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজত ছোট-বড় সব শিশু। মাত্র ২০ বছরে শিশুদের শৈশবে এসেছে আমূল পরিবর্তন। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে মাঠে খেলাধুলা করা, পুকুরে গোসল করা, ঝরের দিনে আম কুড়ানো- এসব যেন এখনকার শিশুদের জন্য ‘ঠাকুমার ঝুলির’ গল্পের মতো।


বিজ্ঞাপন


তখনকার শিশুদের ছিল অসাধারণ এক শৈশব। তবে সেই বৃষ্টিভেজা শৈশব হারিয়ে ফেলেছে এখনকার শিশুরা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৃষ্টিতে ভেজার আনন্দ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে তারা। তার ওপর এখন কোনো কারণে সামান্য একটু বৃষ্টিতে ভিজলেই জ্বর-সর্দিতে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। শুধু বৃষ্টিভেজা শৈশবই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আরও অনেক কিছু থেকই বঞ্চিত হচ্ছে শিশুরা। সেই সঙ্গে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতেও পড়ছে। এতে কমছে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ। সবমিলিয়ে জন্ম থেকে শুরু করে জীবনভর জলবায়ু পরিবর্তনের ভুক্তভোগী হচ্ছে বর্তমানে বেড়ে ওঠা শিশুরা।

গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরত, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত এই ছয় ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। বছর ঘুরে এখন ঋতুর নামের পরিবর্তন হচ্ছে ঠিকই কিন্তু আবহাওয়ার সঠিক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। বর্ষাকালে যখন মাসের অধিকাংশ দিন রিমঝিম বৃষ্টি হওয়ার কথা, তখন বৃষ্টির অভাবে মাঠ ফেটে চৌচির! আবার যেই সময়ে আকাশে থাকার কথা মেঘের ঘনঘটা, সেই সময়ে থাকছে প্রচণ্ড তাপদাহ। সেই সঙ্গে যখন-তখন দেখা দিচ্ছে অস্বাভাবিক বন্যা।

Special News
ছবি: সংগৃহীত।

এদিকে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এখন যে বৃষ্টিপাত হয় তা স্বাস্থ্যের জন্য মোটেও উপযোগী নয়। যে বৃষ্টিতে ভিজলে নানা ধরনের অসুখ-বিসুখ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আবার জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে বজ্রপাতও। যার করণে হালকা বৃষ্টি হলেও ভয়ে ভিজতে চায় না শিশুরা। আর বাবা-মাও কঠোরভাবে শিশুদের বৃষ্টিতে ভিজতে বারণ করেন।

গবেষকরা বলছেন- জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। আর এই ঝুঁকির অধিকাংশ ভুক্তভোগী শিশুরা। আগামী প্রজন্মের জন্য বড় ঝুঁকি হয়ে উঠছে জলবায়ু পরিবর্তন। এর ফলে মাতৃগর্ভে থাকা শিশুরাও ঝুঁকিতে আছে। ইউনিসেফের শিশুদের জন্য জলবায়ু ঝুঁকি সূচক বা চিলড্রেনস ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৩ দেশের মধ্যে ১৫তম।

জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক তহবিলটির (ইউনিসেফ) তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রায় দুই কোটি শিশু বিরূপ আবহাওয়া, বন্যা, নদী ভাঙন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিবেশগত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের অনেকেরই ঠাঁই হয় শহরের বস্তিতে। তাদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সম্ভাবনা নস্যাৎ হয়ে যায়। সেই সঙ্গে শোষণমূলক শিশুশ্রম, বাল্যবিয়ে ও পাচারের ফাঁদে আটকা পড়ে লাখ লাখ শিশু।

Special News
ছবি: ইউনিসেফ।

সংস্থাটি আরও বলছে, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের তিন জেলা- খুলনা, সাতক্ষীরা ও ভোলায় জলবায়ু পরিবর্তন ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলছে। ঘনঘন দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছে এই জেলাগুলো। বঙ্গোপসাগরের উপকূল ঘেঁষে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এই সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে। সেই সঙ্গে পানির লবণাক্ততাও অন্যতম প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপকূলের অনেক এলাকা এখন এই সমস্যায়। এছাড়া অতিরিক্ত গরমও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ফসলের ক্ষেত নষ্ট হয়ে মানুষের জীবিকা সংকটের মুখে পড়ে।

প্রতি পাঁচ বছরে একবার খরার কারণে বিপদে পড়ে বাংলাদেশের মানুষ, আর এ ক্ষেত্রে দেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের বাসিন্দারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব অঞ্চলের শিশুদের ঝুঁকি বড়দের চেয়ে বেশি। গরম ও অন্যান্য জলবায়ু সংক্রান্ত সমস্যার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সক্ষমতা বড়দের তুলনায় তাদের কম। সেই সঙ্গে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ায় তাদের ডায়রিয়া ও অন্যান্য প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বেশি থাকে। পাশাপাশি পুষ্টিহীনতায় ভোগারও ঝুঁকি থাকে এসব শিশুদের। আর দুর্যোগে স্কুল, সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও জীবিকার ক্ষতি তো থাকেই।

তিনি বলেন, বিভিন্ন শিল্পায়ন বা ইন্ডাস্ট্রিয়ালের ফলে গ্রিন হাউজের গ্যাস নিঃসরণ বাড়ছে। গ্রিন হাউজের কাজ হচ্ছে তাপ আটকে রাখা। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ফলে আইস গলে যাচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমুদ্রের পানি প্রসারিত হয়ে তার আয়তন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাপমাত্রা যদি বাড়ে, তবে পানির ভলিয়ম বাড়ে। এটাকে বলে থার্মাল এক্সপানশন।

সমুদ্রের বিশাল জলরাশির ওপর পানি বাষ্পায়নের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ফলে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বাড়ছে। এতে বিভিন্ন এলাকায় আবহাওয়া ও জলবায়ু রিলেটেড বিপর্যয়গুলোর পরিমাণও বাড়ছে। আর সবথেকে বড় বিষয় হচ্ছে এই আবহাওয়া বিপর্যয়ের সবথেকে বড় ভুক্তভোগী চরাঞ্চলের মানুষ। বিশেষ করে নারী ও শিশুরা। কোথাও বন্যা হলে নারী শিশুদের ভোগান্তি বেশি হয়। আবার অনাবৃষ্টির ফলে সৃষ্ট তাপদাহেও বেশি কষ্ট হয় তাদের।

Special News
ছবি: ইউনিসেফ।

প্রফেসর ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, আরেকটি বিষয় হলো- শিশুরা স্কুলে বা বিভিন্ন জায়গায় যখন যায় তখন অত্যধিক গরমের কারণে তারা অস্বস্তিতে থাকে এবং তাদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এছাড়াও মশাবাহিত রোগগুলো বেড়ে যায়। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নানা রোগ-শোক দেখা দেয়, যেখানে শিশুরাই বেশি আক্রান্ত হয়।

স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক আরও বলেন, গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায় এবং নদী ভাঙন বৃদ্ধি পায়, সাইক্লোন জলোচ্ছ্বাসসহ বিভিন্ন রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পায়। লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং নদী ভাঙন বৃদ্ধির কারণে যে পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ওই পরিবারের অর্থনৈতিক সক্ষমতা কমে যায়। তখন পরিবারের কনিষ্ঠতম সদস্য হিসেবে শিশুরাই এই সমস্যা বেশি সাফার করে। শিশুদের বেসিক যে চাহিদাগুলা আছে সেগুলা ফুলফিল করা পরিবারের পক্ষে কঠিন হয়ে যায়। ফলে শিশুরা আবার বঞ্চিত হয়।

সবথেকে বড় বিষয় হলো- জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শিশুরা মানসিকভাবে যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাতে আগামী দিনের সক্ষমতা নিয়ে তারা বেড়ে উঠতে পারছে না। ফলে তাদের সুনাগরিক বা সুস্বাস্থ্যবান হওয়াটা আগামী দিনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সারা বিশ্বই ব্যাপক উদ্বিগ্ন। এবং এটা নিয়ে বারবার সচেতন করা হচ্ছে। আমাদেরকেও সচেতন হতে হবে। কাউন্সিলিং করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণগুলো কমাতে হবে। দূষণ কমাতে হবে। সব থেকে বড় বিষয় হচ্ছে গাছ লাগাতে হবে।’

টিএই/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর