পাকিস্তানের কিংবদন্তি পেসার ওয়াসিম আকরাম। ‘সুলতান অব সুইং’ খ্যাত এই পেসার লম্বা সময় ধরে বাইশ গজে রাজত্ব করেছেন। ১৯৯২ সালে পাকিস্তানের হয়ে তিনি জিতেছেন বিশ্বকাপ। তবে ভয়ানক পেসার আর খ্যাতিমান ক্রিকেটার হলেও তার জীবনেও আছে এক অন্ধকার অধ্যায়। কোকেনের মত ভয়ঙ্কর নেশায় আসক্ত হয়ে পড়া, তারপর স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে দূরত্ব, শেষ পর্যন্ত স্ত্রীর মৃত্যু- জীবনের অন্ধকার এই অধ্যায় নিয়েই ওয়াসিম আকরাম মুখ খুলেছেন তার আত্মজীবনী সুলতান: অ্যা মোমোয়ার Sultan: A Memoir-এ।
২০০৩ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানানো আকরাম, পাকিস্তানের হয়ে টেস্ট ও ওয়ানডে দুই ফরম্যাটেই সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। অবসরের পরও কমেন্ট্রি ও কোচিংয়ের কাজে ঘুরে বেড়িয়েছেন দুনিয়া জুড়ে। কিন্তু সেই সময়েই শুরু হয় তার কোকেইনের প্রতি ঝোঁক, যা এক পর্যায়ে হয়ে দাঁড়ায় ভয়ংকর আসক্তি। আকরামের ভাষায়, “প্রতিযোগিতার উত্তেজনার বিকল্প খুঁজতেই এই পথে পা বাড়িয়েছিলাম।” ২০০৯ সালে স্ত্রী হুমার মৃত্যুর পরই শেষ হয় সেই অধ্যায়।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন- কোন ৩ বোলারের বল খেলা বেশি কঠিন, জানালেন কোহলি
পার্টি, খ্যাতি আর আসক্তির ফাঁদে আটকে পড়া, ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘দ্য টাইমস’-এ প্রকাশিত বইয়ের কিছু অংশ ও একটি সাক্ষাৎকারে খোলামেলা ভঙ্গিতে নিজের জীবনের এই অন্ধকার দিক তুলে ধরেছেন আকরাম।
তিনি লেখেন, “নিজেকে একটু বেশি ভালোবাসতাম, পার্টি করতে পছন্দ করতাম। দক্ষিণ এশিয়ার খ্যাতির সংস্কৃতি খুবই মোহময়, কিন্তু সেটা ধ্বংসাত্মকও। এক রাতে দশটা পার্টিতেও যাওয়া সম্ভব, কেউ কেউ যায়ও। আমিও গিয়েছি। ধীরে ধীরে আমার নেশা হয়ে দাঁড়ায় এসব।”

বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন- আইপিএলে একটি ম্যাচ খেলে কত টাকা পান ক্রিকেটাররা?
“সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল কোকেইনের প্রতি আসক্তি। প্রথমে ইংল্যান্ডের এক পার্টিতে এক লাইন কোকেইন দেওয়া হয়, তখন তা কিছুই মনে হয়নি। ধীরে ধীরে এটা এমন পর্যায়ে চলে যায়, যেটা ছাড়া মনে হতো চলাই অসম্ভব।”
“এটা আমাকে উত্তেজিত করত, আমার ভেতরের মানুষটাকে বদলে দিত। হুমা তখন অনেক সময় একা অনুভব করত... প্রায়ই বলত করাচিতে যেতে চায়, নিজের মা-বাবা আর ভাইবোনদের কাছে থাকতে চায়। আমি রাজি হতাম না। কারণ করাচি গেলে আমি পার্টি করতাম, কাজের নাম করে দিনের পর দিন মজা করতাম।”
আরও পড়ুন- লাস্যময়ী অভিনেত্রীর ছবিতে ‘লাভ রিয়্যাক্ট’ দিয়ে বিপাকে কোহলি
স্ত্রী হুমার চোখে ধরা পড়ে আসল সত্য
“একদিন হুমা আমার ওয়ালেট থেকে কোকেইনের প্যাকেট বের করে ফেলে। বলে, ‘তোমার সাহায্য দরকার।’ আমি মানি, কারণ তখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এক লাইন থেকে শুরু হয়ে দুই, তারপর চার, তারপর এক গ্রাম, এরপর দুই গ্রাম। আমি ঠিকমতো ঘুমাতে পারতাম না, খেতেও পারতাম না। ডায়াবেটিস নিয়েও ছিলাম উদাসীন। মাথা ধরত, মেজাজ খারাপ হতো। অনেক আসক্ত মানুষের মতো আমিও মনে মনে চাইছিলাম কেউ এটা জেনে যাক, গোপন রাখার যন্ত্রণা ছিল ভয়ংকর।”

চিকিৎসার নামে প্রতারণা, আবারও ফিরলেন সেই নেশায়
আকরাম যান পুনর্বাসন কেন্দ্রে, কিন্তু অভিজ্ঞতা ছিল হতাশাজনক। “যে ডাক্তার ছিলেন, তিনি পুরো প্রতারক। রোগী নয়, পরিবারের কাছ থেকে টাকা আদায় করাই ছিল তার কাজ।”
আরও পড়ুন- দলের ক্রিকেটারদের চাহিদা মেটাতে যা করেছিলেন প্রীতি জিনতা
ফলাফল? চিকিৎসা বাদ দিয়ে আবারও তিনি ফিরে যান পুরোনো অভ্যাসে
“যতই চেষ্টা করি, ভিতরে ভিতরে রাগে পুড়ছিলাম। গর্বে আঘাত লেগেছিল। আগের জীবনের টানও ছিল। কিছু সময় ভেবেছিলাম বিচ্ছেদও হতে পারে। শেষ পর্যন্ত হুমার নজরদারির বাইরে গিয়ে ২০০৯ সালের আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে অংশ নিতে যাই। সেখানেই আবার শুরু হয় কোকেইন সেবন।”

স্ত্রীর মৃত্যু বদলে দিল জীবন
২০০৯ সালের অক্টোবর, বিরল এক ফাঙ্গাল ইনফেকশনে মারা যান হুমা। সেই মৃত্যুই হয়ে যায় আকরামের জীবনের মোড় ঘোরানো ঘটনা। তিনি বলেন, “হুমার শেষ নিঃস্বার্থ কাজ ছিল আমাকে এই নেশা থেকে মুক্তি দেওয়া। সেই জীবন এখন অতীত, আর আমি কখনোই পেছনে তাকাইনি।”
নতুন জীবন, সন্তানদের জন্যই লেখা বই
বর্তমানে আকরাম আবারও বিবাহিত। আগের ঘরে দুটি ছেলে, নতুন সংসারে একটি মেয়ে রয়েছে। The Times-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, এই বইটি লিখেছেন মূলত তার সন্তানদের জন্য।
“বইটা নিয়ে আমি একটু চিন্তিত। কিন্তু মনে করি, বের হলে একটা ভার নেমে যাবে। আমি এখন ৫৬ বছরের, ২৫ বছর ধরে ডায়াবেটিসে ভুগছি, বয়সে তো চাপ থাকবেই। আবার সব স্মৃতি ফিরে দেখা কঠিন ছিল। কিন্তু আমি করেছি আমার দুই ছেলে—২৫ আর ২১ বছর বয়স, আর আমার সাত বছরের মেয়ের জন্য। যেন তারা আমার গল্পটা জানতে পারে, আমার দিকটা বুঝতে পারে।”

