আহলে কোরআন মূলত একটি মর্যাদাপূর্ণ দ্বীনি পরিভাষা। আহলে কোরআন বা আহলুলল কুরআন এর শাব্দিক অর্থ কোরআনের পক্ষের বিশেষ ব্যক্তি বা কোরআনওয়ালা বা কোরআনের অনুসারী। আহলে কোরআনের পরিচয় দিতে গিয়ে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, নিশ্চয়ই মানুষদের মধ্যে অনেকে আল্লাহর ‘আহল’ (আল্লাহর বিশেষ ব্যক্তি)।’ সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন- ‘হে আল্লাহর রাসুল! তারা কারা?’ রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন- ‘তারা আহলুল কোরআন বা কোরআনওয়ালা। তারাই আল্লাহর ‘আহল এবং তাঁর ঘনিষ্ঠজন।’ (মুসনাদে আহমদ: ১২২৭৯; সুনানে কুবরা, নাসায়ি: ৭৯৭৭; ইবনে মাজাহ: ২১৫)
অতএব রাসুলুল্লাহ (স.) হলেন সর্বপ্রথম ও সবচে বড় ‘আহলে কোরআন’ বা কোরআনওয়ালা। কেননা পুরো কোরআনই হলো রাসুল (স.)-এর চরিত্র। আল্লাহ তাআলা সেই স্বীকৃতি দিয়ে নবীজিকে বলছেন, নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত। (সুরা কলম: ০৪) দ্বিতীয় পর্যায়ের আহলে কোরআন হলেন সাহাবায়ে কেরাম। এরপরের অবস্থানে আছেন যারা নবীজি ও সাহাবিদের যথাযথ অনুসরণ করেন।
বিজ্ঞাপন
বর্তমান যুগে নবীজির হাদিস ও সুন্নতকে অস্বীকার করার পরও নিজেদের আহলে কোরআন পরিচয় দিচ্ছে কিছু মানুষ। তারা অনুধাবন করতে পারছে না যে হাদিস অস্বীকার করে কোরআনের অনুসারী হওয়ার সুযোগ নেই। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, وَ اَطِیۡعُوا اللّٰهَ وَ الرَّسُوۡلَ لَعَلَّکُمۡ تُرۡحَمُوۡنَ ‘আর তোমরা আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য কর যাতে কৃপা লাভ করতে পার।’ (সুরা নিসা: ১৩২)
আরও ইরশাদ হয়েছে - مَنۡ یُّطِعِ الرَّسُوۡلَ فَقَدۡ اَطَاعَ اللّٰهَ ۚ وَ مَنۡ تَوَلّٰی فَمَاۤ اَرۡسَلۡنٰکَ عَلَیۡهِمۡ حَفِیۡظًا ‘যে রাসুলের আনুগত্য করল, সে আল্লাহরই আনুগত্য করল। আর যে মুখ ফিরিয়ে নিল, তবে আমি তোমাকে তাদের উপর তত্ত্বাবধায়ক করে পাঠাইনি।’ (সুরা নিসা: ৮০)
আরও পড়ুন: মহানবী (স.)-এর আদর্শ অনুসরণ ছাড়া মুক্তি নেই
সুরা নাজমের ৩-৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- وَ مَا یَنۡطِقُ عَنِ الۡهَوٰی اِنۡ هُوَ اِلَّا وَحۡیٌ یُّوۡحٰی ‘তিনি নিজ প্রবৃত্তি থেকে কিছু বলেন না, বরং তার বক্তব্য শুধুই ওহি, যা প্রত্যাদেশ হয়। এ আয়াতে স্পষ্ট যে, নবী (স.) যা কিছু বলেন, তা তাঁর প্রতি নাজিলকৃত ওহি।
সুরা হাশর ৭ নম্বর আয়াতে আছে- وَ مَاۤ اٰتٰىکُمُ الرَّسُوۡلُ فَخُذُوۡهُ وَمَا نَهٰىکُمۡ عَنۡهُ فَانۡتَهُوۡا وَاتَّقُوا اللّٰهَ اِنَّ اللّٰهَ شَدِیۡدُ الۡعِقَابِ ‘রাসুল (স.) যা কিছু তোমাদের প্রদান করেন, তা গ্রহণ কর। আর যা থেকে তোমাদের বারণ করেন, তা হতে তোমরা বিরত থাক এবং তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর; নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি দানে কঠোর।’ (সুরা হাশর: ০৭)
পবিত্র কোরআনে এরকম অনেক দলিল আছে, যেখানে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর আনুগত্য করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে এটাও বলে দেওয়া হয়েছে যে, রাসুলের আনুগত্য মানেই আল্লাহর আনুগত্য। প্রখ্যাত ইসলামিক স্কলার শাইখ আহমাদুল্লাহ বলেন, ‘পবিত্র কোরআনে যেখানেই আল্লাহর আনুগত্যের কথা আছে, সেখানেই তাঁর রাসুলের আনুগত্যের কথা আছে। রাসুলুল্লাহ (স.)-কে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ‘আল্লাহর আনুগত্য করো’ এমন কথা কোরআনের কোথাও বলা হয়নি। বরং আলাদা করে শুধুমাত্র ‘রাসুলের আনুগত্য করো’ এমন কথা কোরআনে বলা হয়েছে, যাতে নবীজির আনুগত্য নিয়ে মানুষের বিভ্রান্ত হওয়ার ও করার সুযোগ না থাকে।’
নবীজির আনুগত্য শুধু শাসক হিসেবে যারা দাবি করেন, তাদের জবাবে শাইখ আহমাদুল্লাহ সুরা নিসার ৫৯ নম্বর আয়াত উল্লেখ করে বলেন, এই আয়াতটিতে আলাদাভাবে আল্লাহর আনুগত্য, রাসুলের আনুগত্য ও উলুল আমর-এর (ক্ষমতাশীলদের বা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিতদের) আনুগত্য করার কথা বলা হয়েছে। সুতরাং নবীজিকে শুধু শাসক হিসেবে অনুসরণ করার দাবিটি অবাস্তব।
আরও পড়ুন: কোরআন যাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করে না
আয়াতটি হলো— یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَطِیۡعُوا اللّٰهَ وَ اَطِیۡعُوا الرَّسُوۡلَ وَ اُولِی الۡاَمۡرِ مِنۡکُمۡ ۚ فَاِنۡ تَنَازَعۡتُمۡ فِیۡ شَیۡءٍ فَرُدُّوۡهُ اِلَی اللّٰهِ وَ الرَّسُوۡلِ اِنۡ کُنۡتُمۡ تُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰهِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ ؕ ذٰلِکَ خَیۡرٌ وَّ اَحۡسَنُ تَاۡوِیۡلًا ‘হে ঈমাদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর, আরও আনুগত্য কর তোমাদের মধ্যকার ক্ষমতাশীলদের, অতঃপর কোনো বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটলে তা উপস্থাপিত করো আল্লাহ ও রাসুলের নিকট, যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতে ঈমান এনে থাক। এ পন্থাই উত্তম এবং পরিণামে প্রকৃষ্টতর। (সুরা নিসা: ৫৯)
উল্লেখিত সবগুলো আয়াতই স্পষ্টভাবে প্রমাণ করছে যে আল্লাহ তাআলা আলাদাভাবে রাসুলুল্লাহ (স.)-কে অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয়- কিছু মানুষ নবীজির সিরাত ও আসহাবে রাসুলকে অবজ্ঞা করেই আহলে কোরআন হওয়ার দাবি করে। বস্ত্তত তারা রাসুল (স.)-এর ভবিষ্যদ্বাণীরই একটি বাস্তব চিত্র।
রাসুল (স.) তাদের সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেন, ‘জেনে রাখো আমাকে কিতাব (কোরআন) এবং তার সাথে অনুরূপ একটি বস্ত্ত দেওয়া হয়েছে। অচিরেই এমন এক সময় আসবে যখন কোনো পেটপুরে খাদ্য গ্রহণকারী (প্রাচুর্যবান) ব্যক্তি তার আসনে বসে বলবে, তোমরা শুধু এ কোরআনকেই গ্রহণ করো, তাতে যা হালাল পাবে তা হালাল আর তাতে যা হারাম পাবে তা হারাম মনে করো।’ (আবুদাউদ: ৪৬০৫; মেশকাত: ১৬২)
আরও পড়ুন: নবীজির দৃষ্টিতে শ্রেষ্ঠ যারা
অন্য হাদিসে এসেছে, ‘আমি যেন তোমাদের মধ্যে কাউকে এমন অবস্থায় না পাই যে, সে তার সুসজ্জিত আসনে হেলান দিয়ে বসে থাকবে এবং তার নিকট আমার আদিষ্ট কোনো বিষয় অথবা আমার নিষেধ সম্বলিত কোনো কিছু (হাদিস) উত্থাপিত হলে সে বলবে, আমি তা জানি না, আল্লাহ তাআলার কিতাবে আমরা যা পেয়েছি, তারই অনুসরণ করব।’ (আবুদাউদ: ৪৬০৪; মেশকাত: ১৬৩)
মহানবী (স.)-এর উক্ত ভবিষ্যদ্বাণী হিজরী দ্বিতীয় শতকের শেষের দিকে বাস্তবে দেখা দেয়। এসময় এমন কিছু লোকের আবির্ভাব ঘটে, যারা সুন্নতকে অস্বীকার করে। ইমাম শাফেয়ি এমন এক হাদিস অস্বীকারকারী ব্যক্তির সাথে তার মুনাজারার কথা উল্লেখ করেছেন। (কিতাবুল উম্ম: ৭/২৮৭-২৯২)
সেখানে তিনি তার দাবীর অসারতা প্রমাণ করেছেন। অতঃপর দীর্ঘ ১১শত বছর হাদিস অস্বীকারকারীদের অস্তিত্বের কোনো প্রমাণ মেলেনি। বিগত শতাব্দী তথা ত্রয়োদশ হিজরিতে এই ফেতনার পুনরাবির্ভাব ঘটে মিসর, ইরাক এবং ভারতে (বিস্তারিত দ্র: ‘হাদিসের প্রামাণিকতা’ বই)। বর্তমানে বাংলাদেশেও এই আকিদার কিছু ব্যক্তির আবির্ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা থেকে মুসলিমদের সতর্ক থাকা জরুরি।
ইমাম সুয়ুতি (রহ) বলেন, ‘তারা কাফের এবং ইসলাম হতে খারিজ। তাদের হাশর হবে ইহুদি ও নাসারা বা অন্যান্য ভ্রান্ত মতাবলম্বীদের সাথে।’ (মিফতাহুল জান্নাহ, পৃ-৫)
কেয়ামতের দিন তাদের দুরবস্থার কথা বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেছেন— یَوۡمَئِذٍ یَّوَدُّ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا وَعَصَوُا الرَّسُوۡلَ لَوۡ تُسَوّٰی بِهِمُ الۡاَرۡضُ وَلَا یَکۡتُمُوۡنَ اللّٰهَ حَدِیۡثًا ‘যারা কুফরি করেছে এবং রাসুলের অবাধ্য হয়েছে তারা সেদিন কামনা করবে, যদি জমিনকে তাদের সাথে (মিশিয়ে) সমান করে দেওয়া হত..।’ (সুরা নিসা: ৪২) যেমনটি অন্য সুরায় বলা হয়েছে, ‘আর কাফেররা বলবে, কতই না উত্তম হত যদি আমরা মাটি হয়ে যেতাম।’ (সুরা নাবা: ৪০)
সুতরাং প্রমাণিত হলো- যারা হাদিস মানে না, তারা মূলত পবিত্র কোরআনকেই মানে না। তাদের মনে রাখা উচিত, কোরআন যে আল্লাহর কালাম সে কথাটিও রাসুলুল্লাহ (স.)-এর নিজের। তিনিই জানিয়েছেন পবিত্র কোরআন সম্পর্কে। কেউ যদি কোরআনকে আল্লাহর কালাম হিসেবে মেনে নিয়ে রাসুলুল্লাহর (স.) হাদিসকে ফেলে রাখতে চায়, তারা কীভাবে নবীজির এই কথাটি মেনে নেয়? এটি কেমন হাস্যকর চিন্তা?
তাছাড়া কোরআনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করার দায়িত্ব নবীজির। সুরা নাহলে ৪৪ নং আয়াতে তাআলা ইরশাদ করেছেন, وأنزلنا إليك الذكر لتبين للناس ما نزل إليهم ‘আমি এই কোরআন আপনার প্রতি নাজিল করেছি। যাতে যা তাদের প্রতি নাজিল হয়েছে, আপনি তা তাদের স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেবেন।’ এর অর্থ হলো—রাসুল (স.)-এর ব্যাখ্যা আল্লাহরই ব্যাখ্যা হবে। বিষয়টি এমন নয় যে আল্লাহর নাজিলকৃত কোরআন শুধু মানুষের হাতে তুলে দেওয়াই নবীজির দায়িত্ব। নাউজুবিল্লাহ।আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সঠিক বোধ ও উপলব্ধি দান করুন। আমিন।
কোরআন মানি হাদিস মানি না, আহলে কুরআনদের নামাজ, কোরআন শরীফ শব্দের অর্থ কি, কুরআন রিসার্চ ফাউন্ডেশন photos আল কোরআনের অলৌকিকতা, শায়খ আহমাদুল্লাহ কি আহলে হাদিস, আহলে কোরআন বাংলাদেশ, কোন শব্দ কোরআনে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়েছে, কোরআনওয়ালা, কোরআনের অনুসারী, হাদিস অস্বীকারকারী

