রমজানের রোজা ফরজ ও ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনরা, তোমাদের ওপর রোজাকে ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যেন তোমরা আল্লাহভীরু হতে পারো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৩)
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে বলতে শুনেছি, ‘পাঁচটি জিনিসের ওপর ইসলামের বুনিয়াদ রাখা হয়েছে, সাক্ষ্য দেওয়া আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো সত্য মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ আল্লাহর রাসুল; নামাজ কায়েম করা; জাকাত আদায় করা; আল্লাহর ঘরের হজ করা এবং রমজানের রোজা রাখা।’ (সহিহ বুখারি: ৮)
বিজ্ঞাপন
ইচ্ছাকৃত রোজা ত্যাগকারী ইসলামের ভিত্তি বিনষ্টকারী হিসেবে গণ্য
শরিয়তসম্মত কারণ ছাড়া যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত একটি রোজাও পরিত্যাগ করে সে নিকৃষ্ট পাপী। দ্বীনের মৌলিক ফরজ লঙ্ঘনকারী এবং ঈমান ও ইসলামের ভিত্তি বিনষ্টকারীরূপে পরিগণিত। আর এ কারণে তার যে ক্ষতি হবে তা কস্মিণকালেও পূরণ হবে না। এমনকি পরে কাজা করে নিলেও রমজানের রোজার কল্যাণ ও বরকত থেকে সে বঞ্চিত হবে। হাদিস শরিফে এসেছে ‘যে ব্যক্তি কোনো ওজর বা অসুস্থতা ব্যতিরেকে রমজানের একটি রোজা পরিত্যাগ করবে সে যদি ওই রোজার পরিবর্তে আজীবন রোজা রাখে তবুও ওই এক রোজার ক্ষতি পূরণ হবে না।’ (জামে তিরমিজি: ৭২৩)
অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের সমাজে অনেক সবল-সুঠাম দেহের অধিকারীও সামান্য কারণে এবং অসুস্থ হওয়ার অমূলক আশংকায় রোজা পরিত্যাগ করে। এতে তারা কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা একটু ভেবেও দেখে না। অথচ আল্লাহ তাআলা বলছেন, ‘রমজান মাস, এতে মানুষের দিশারি এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এই মাস পাবে তারা যেন এই মাসে রোজা পালন করে। কেউ অসুস্থ হলে বা সফরে থাকলে অন্য সময় এই সংখ্যা পূরণ করবে।’ (সুরা বাকারা: ১৮৫)
আরও পড়ুন: ঋতুবর্তীসহ ৬ শ্রেণির মানুষের রোজা না রাখার অনুমতি
ইচ্ছাকৃত রোজা ত্যাগকারীর ব্যাপারে কঠিন কথা বলা হয়েছে হাদিসে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘ইসলামের হাতল ও দ্বীনের মূল বিষয় তিনটি; যার ওপর ইসলামের ভিত্তি। যে ব্যক্তি তার একটি ত্যাগ করল, সে এমন অবিশ্বাসীতে পরিণত হলো, যার রক্তপাত বৈধ। সেগুলো হচ্ছে—আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই বলে সাক্ষ্য দেওয়া, ফরজ নামাজ ও রমজানের রোজা।’ (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ: ১/৪৮)
বিজ্ঞাপন
রোজা ত্যাগকারী মানুষটি মুসলিম কি না সে ব্যাপারে সংশয় থেকে যায়। ‘মুমিনদের কাছে এ কথা প্রমাণিত—যে ব্যক্তি কোনো অসুস্থতা ও শরিয়ত অনুমোদিত কারণ ছাড়া রোজা ছেড়ে দেয় সে মদ্যপ ও ব্যভিচারীর চেয়েও নিকৃষ্ট; বরং তারা তার ইসলামের ব্যাপারে সন্দেহ করে এবং তাকে জিন্দিক তথা ধর্মদ্রোহী বলে সন্দেহ করে।’ (আল-কাবায়ির, পৃষ্ঠা-৬৪)
রোজা ভেঙে ফেলার যে শাস্তি দেখানো হয়েছে নবীজিকে
আবু উমামা বাহিলি (রা.) বলেন, আমি রাসুল (স.)-কে বলতে শুনেছি, একবার আমি ঘুমিয়েছিলাম। এসময় দুজন মানুষ এসে আমার দুই বাহু ধরে আমাকে দুর্গম পাহাড়ে নিয়ে গেল। সেখানে নিয়ে তারা আমাকে বলল, পাহাড়ে উঠুন। আমি বললাম, আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তারা বলল, আমরা আপনার জন্য সহজ করে দিচ্ছি। তাদের আশ্বাস পেয়ে আমি উঠতে লাগলাম এবং পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত গেলাম। সেখানে প্রচণ্ড চিৎকারে শব্দ শোনা যাচ্ছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এটা কিসের শব্দ? তারা বলল, এটা জাহান্নামিদের চিৎকার। এরপর তারা আমাকে এমন কিছু লোকের কাছে নিয়ে গেল যাদের পায়ের টাকনুতে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। তাদের গাল ছিন্নভিন্ন এবং তা থেকে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এরা কারা? তারা বলল, এরা হচ্ছে এমন রোজাদার যারা রোজা পূর্ণ করার আগে ইফতার করত।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান: ৭৪৯১)
আরও পড়ুন: যেসব কারণে রোজা ভাঙলে গুনাহ নেই
যেসব কারণে রোজা ভাঙলে কাফফারা দিতে হয় না
রোজার কাজা ও ফিদিয়া
যারা অবহেলায় বা অজ্ঞতাবশত রমজানের রোজা না রাখার গুনাহে জড়িয়েছেন, তাদের ব্যাপারে ফকিহ আলেমদের পরামর্শ হলো— প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর থেকে অদ্যাবধি রমজানের যত রোজা ছুটে গেছে তার তাওবা করা এবং আনুমানিক হিসাব করে কাজা আদায় করা জরুরি। কাজা লাগাতার করা আবশ্যক নয়। বার্ধক্য বা কোনো কারণে কাজা না করতে পারলে ফিদিয়া দেবে। রোজা রাখার সামর্থ্য না থাকলে প্রত্যেক রোজার জন্য এক ফিতরা পরিমাণ কাফফারা দেবে। (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া: ১/২০৫, ফতোয়ায়ে ফকিহুল মিল্লাত: ২/৪৬৪)
কাজা ও ফিদিয়া কোনটি কখন
ফিদিয়া ও কাজা দুটির অবস্থা ভিন্ন। যদি কেউ অসুস্থতার দরুন অভিজ্ঞ ডাক্তারের বিবেচনায় রোজা রাখতে অক্ষম এবং পরে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে সুস্থ হওয়ার পর রোজার কাজা আদায় করতে হবে। ওই ব্যক্তির জন্য ফিদিয়া নয়।
যদি অসুস্থ ব্যক্তির আরোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে কিংবা এমন বৃদ্ধ, যে কখনোই রোজা রাখার মতো সামর্থ্য ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, তাহলে ফিদিয়া আদায় করবে। (ফতোয়ায়ে ফকিহুল মিল্লাত: ৫/৪৫৫)
ফিদিয়ার পরিমাণ হচ্ছে- একজন দরিদ্রকে পেট ভরে দুই বেলা খাবার খাওয়ানো। কেউ চাইলে নগদ টাকাও দিয়ে দিতে পারে। প্রত্যেক রোজার জন্য ফিদিয়ার ন্যূনতম পরিমাণ হলো, সদকাতুল ফিতরের সমান। (আল ইনায়া: ২/২৭৩)
ফিদিয়া সম্পর্কে আরও জানতে পড়ুন: বদলি রোজা নয়, ইসলামি বিধান ফিদিয়া
কাফফারার বিধান
শরিয়তসম্মত কোনো কারণ ছাড়া ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার বা সহবাসের মাধ্যমে রমজানের রোজা ভেঙে ফেললে তার কাজা ও কাফফারা আদায় করতে হবে। পানাহার ও সহবাস ছাড়া অন্য পদ্ধতিতে ইচ্ছাকৃত ভাঙলেও কাফফারা দিতে হবে না, তবে কাজা করতে হবে। (মাবসুতে সারাখসি: ৩/৭২)
রোজার কাফফারা আদায়ের ক্ষেত্রে টানা ৬০ দিন রোজা রাখতে হবে। টানা ৬০টি রোজা রাখার মাঝখানে যদি এক দিনও বাদ যায়, তাহলে পুনরায় শুরু থেকে গণনা আরম্ভ করতে হবে, আগেরগুলো বাদ হয়ে যাবে। (মাবসুতে সারাখসি: ৩/৮২)
অথবা ৬০ জন মিসকিনকে দুবেলা খানা খাওয়ালেও কাফফারা আদায় হবে। কোনো ব্যক্তির ইচ্ছাকৃতভাবে একাধিকবার একই রমজানের রোজা ভাঙার কারণে এক কাফফারাই যথেষ্ট হবে। অর্থাৎ ভেঙে ফেলা সব রোজার জন্য ৬০ জন মিসকিনকে দুবেলা খানা খাওয়াবে, অথবা প্রতি মিসকিনকে এক ফিতরা পরিমাণ সম্পদ সদকার মাধ্যমেও কাফফারা আদায় করা যাবে। (বাদায়েউস সানায়ে: ২/১০১, রদ্দুল মুহতার: ২/৪১৩)
আরও পড়ুন: জীবনের সকল কাজা রোজা আদায়ের বিধান কেমন
রোজা রাখার পুরস্কার
যারা নিষ্ঠার সঙ্গে রোজা পালন করে, তাদের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর ঘোষণা হলো, ‘যে ব্যক্তি বিশ্বাস ও নিষ্ঠার সঙ্গে রমজানের রোজা রাখে তার পূর্ববর্তী পাপ ক্ষমা করা হয়।’ (সহিহ বুখারি: ১৯০১)
হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘মানুষের প্রতিটি কাজ তার নিজের জন্য, কিন্তু রোজা এর ব্যতিক্রম। রোজা শুধু আমার জন্য, আমিই এর প্রতিদান দেব।’ (মুসলিম: ২৭৬০)
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সঠিকভাবে রমজানের রোজা রাখার তাওফিক দিন। আমিন