বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

খাওয়া-দাওয়া নিয়ে মাতামাতি নয়, ইবাদতে প্রতিযোগিতা কাম্য

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৬ মার্চ ২০২৩, ০১:৫৮ পিএম

শেয়ার করুন:

খাওয়া-দাওয়া নিয়ে মাতামাতি নয়, ইবাদতে প্রতিযোগিতা কাম্য

মাহে রমজান মুমিন জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। এ মাস আখেরাতের পাথেয় গোছানোর মাস। এই মাসে বর্ষিত হয় রহমতের বারিধারা। রমজানের বরকতময় সময়কে কাজে লাগান একজন মুমিন। অন্যদিকে অবহেলায় কাটিয়ে দিয়ে অভিশপ্তদের তালিকায় নাম লিপিবদ্ধ করেন কিছু হতভাগা। কেউ কেউ রমজান মাস এলেই খাওয়ার আয়োজনে নেমে পড়েন। তারা রমজানকে সেহেরি-ইফতারে, তারাবির আগে-পরে দামি ও মজার খাবার খাওয়া, রাত জেগে স্যাটেলাইট চ্যানেল উপভোগ করার মৌসুম বানিয়ে ফেলেছে। এর জন্য তারা রমজান মাসের আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতেও শুরু করে; এই আশংকায় যে- কিছু খাদ্যদ্রব্য কেনা বাদ পড়ে যেতে পারে অথবা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেতে পারে। এভাবে তারা শুধুমাত্র খাদ্যদ্রব্য কেনা ও হরেক রকম পানীয় প্রস্তুত করার জন্যই প্রস্তুতি নেয়। 

অথচ পবিত্র রমজান মাসের সঙ্গে এসবের সম্পর্ক নেই। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ ‘হে ঈমানদারগণ তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমনটি ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়া (পরহেজগারি) অবলম্বন করতে পারো। 


বিজ্ঞাপন


তাকওয়া কী? তাকওয়ার মূল কথা হলো—সুন্নাহর বিপরীত কাজগুলো থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া এবং আল্লাহর আদেশকে যথাযথ পালন করা। তাকওয়া হলো এমন এক গুণ যা দুনিয়া-আখেরাতে সাফল্যের চাবিকাঠি। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, হে বুদ্ধিমানগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা সফল হও। (সূরা মায়েদা: ১০০)

যারা তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে সংশোধন হয়েছেন, তাদের কোনো ভয় নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো আর জেনে রেখো আল্লাহ মুত্তাকিদের সঙ্গে আছেন। (সুরা বাকারা: ১৯৫)। পবিত্র কোরআনে আরো বলা হয়েছে, যে আল্লাহকে ভয় করবে আল্লাহ তাকে বিপদাপদ থেকে নিষ্কৃতি দেবেন এবং তাকে ধারণাতীত রিজিক দান করবেন। (সুরা তালাক: ২-৩)

আরও পড়ুন: রাসুলুল্লাহ (স.) কী দিয়ে ইফতার করতেন?

পবিত্র রমজান সেই তাকওয়া অর্জনের শিক্ষা দেয়। কোনোরকম বাড়াবাড়ি রমজানের শিক্ষার পরিপন্থী। এছাড়াও রমজানকে বলা হয়েছে সহমর্মিতার মাস, অসহায়-দরিদ্রদের দুঃখ-কষ্ট উপলব্ধি করার মাস। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের পার্থিব কষ্টের একটি দূর করে দেয়, আল্লাহ কেয়ামতের দিন তার একটি কষ্ট দূর করে দেবেন। যে ব্যক্তি কোনো অভাবীর অভাবের কষ্ট লাঘব করে, আল্লাহ তার দুনিয়া ও আখেরাতের অভাবের কষ্ট লাঘব করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের দোষ গোপন রাখবে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন। আল্লাহ বান্দার সহায়তায় থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সহায়তায় থাকে।’ (সহিহ মুসলিম: ৩৮)


বিজ্ঞাপন


রমজানে একজন রোজাদারকে সামর্থ্য অনুযায়ী ইফতার করানো অনেক সওয়াবের কাজ। ইরশাদ হয়েছে, ‘কেউ যদি কোনো রোজাদারকে ইফতার করায়, তবে তার জন্যও অনুরূপ (রোজার) সওয়াব হবে। কিন্তু এতে রোজাপালনকারীর সওয়াবে কোনো ঘাটতি হবে না।’ (জামে তিরমিজি: ৮০৭)

নেক কাজে সহযোগিতা করাও রমজানের বিশেষ দিক। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে একে অন্যকে সহযোগিতা করবে। গুনাহ ও জুলুমের কাজে একে অন্যের সহযোগিতা করবে না। আল্লাহকে ভয় করে চলো। নিশ্চয়ই আল্লাহর শাস্তি অতি কঠিন।’ (সূরা মায়েদা: ২)

আরও পড়ুন: রমজানে মূল্যবৃদ্ধি, রোজাদার যেভাবে প্রতিবাদ করবেন

সুতরাং, রমজানে নেক আমলে অগ্রগামী হওয়ার মধ্যেই কল্যাণ। অযথা কাজ-কর্ম থেকে দূরে থাকতে হবে। যারা খাওয়া-দাওয়ার পেছনে মূল্যবান সময়গুলো নষ্ট করেন, তাদেরকে রমজানের শিক্ষাগুলো নিয়ে সচেতন হতে হবে। খাওয়া-দাওয়ার পেছনে সময় নষ্ট মানে এই নয় যে, রমজানে সেহেরি-ইফতারের জন্য কিছুই করা যাবে না। সবই করা যাবে। তবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু নয়। অযথা কাজে রমজানের পবিত্র সময়গুলো নষ্ট করা একজন প্রকৃত মুমিনের জন্য বাঞ্ছনীয় নয়। এতে করে রমজানের মূল শিক্ষা যেমন— তাকওয়া, সংযম, ধৈর্য, ভ্রাতৃত্ববোধ ও ইখলাস অর্জন কঠিন হয়ে যায়। এই গুণগুলো পরিপূর্ণভাবে অর্জন করেছিলেন সাহাবায়ে কেরামরা। তাদের পারস্পরিক সহানুভূতি ও সহমর্মিতা সম্পর্কে আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তারা তাদের নিজেদের ওপর অগ্রাধিকার দেয়; নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও। যাদের অন্তর কার্পণ্য থেকে মুক্ত রাখা হয়েছে তারাই সফলকাম। (সুরা হাশর: ৯)

ইবাদতে ইখলাস অর্জনও রমজানের অন্যতম শিক্ষা। কেননা আল্লাহর দরবারে বান্দার আমল কবুল হওয়ার প্রধান শর্ত হচ্ছে ইখলাস। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তাদের কেবল একনিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর ইবাদতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ (সুরা বাইয়িনা: ৫)

রমজানের আরেকটি বিশেষ দিক হলো—কোরআন তেলাওয়াত ও চর্চা। কেননা রমজানের সঙ্গে কোরআনের সম্পর্ক নিবিড়। এই মাসেই কোরআন নাজিল হয়েছে। হাশরের ময়দানে বান্দার মুক্তির জন্য রোজা ও কোরআনের ভূমিকা থাকবে বেশি।

নবীজী (স.) বলেন, ‘কোরআন ও রোজা আল্লাহ তাআলার কাছে সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, ‘আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও মনের খায়েশাত মিটানো থেকে বিরত রেখেছিলাম। কোরআন বলবে, আমি তাকে রাতের ঘুম থেকে বিরত রেখেছিলাম। অতএব আমাদের সুপারিশ কবুল করুন। তখন আল্লাহ তাআলা সুপারিশ কবুল করে নিবেন।’ (মুসনাদে আহমদ) সহিহ মুসলিমে আবু উমামা আল বাহিলি (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত, নবীজি (স.) বলেন, ‘ তোমরা কোরআন পড়ো, কেননা তেলাওয়াতকারীদের জন্য কোরআন সুপারিশকারী হিসেবে আসবে।’ (সহিহ মুসলিম: ৮০৪) 

সহিহ ইবনে হিব্বানে এসেছে, ‘কোরআন এমন সুপারিশকারী যার সুপারিশ কবুল করা হবে। যে ব্যক্তি কোরআনকে পথপ্রদর্শক বানাবে কোরআন তাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে। যে ব্যক্তি কোরআনকে পশ্চাতে ফেলে রাখবে কোরআন তাকে জাহান্নামে পাঠাবে।’ (ইবনে হিব্বান: ১২৪)

এছাড়া রমজানে ধৈর্যের গুণ অর্জন করতে হবে। আল্লাহর রাসুল (স.) বলেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যেন রোজা পালনের দিন অশ্লীলতায় লিপ্ত না হয় এবং ঝগড়া-বিবাদ না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সঙ্গে ঝগড়া করে, তাহলে সে যেন বলে, আমি একজন রোজাদার।’ (বুখারি: ১৯০৪)

যে ব্যক্তি সিয়াম পালন করেছন, কিন্তু সংযমী হয়নি, বাড়াবাড়ি ও নাফরমানি ত্যাগ করেনি, আল্লাহর অসন্তুষ্টির যেকোনো বিষয় ত্যাগ করেননি—এমন ব্যক্তির ব্যর্থতা সম্পর্কে রাসুলে কারিম (স.) বলেন, كَم من صائمٍ ليسَ لهُ من صيامِهِ إلَّا الظَّمَأُ، وَكَم من قائمٍ ليسَ لهُ من قيامِهِ إلَّا السَّهرُ ‘এমন বহু রোজাদার আছে, তার এই রোজা রাখা বা পানাহার বর্জনের ফলাফল শুধুই উপোস থাকা। এমন বহু ইবাদতকারী আছে, যাদের এমন ইবাদত করার পেছনে ফলাফল শুধুই তার রাত্রি জাগরণ, সার্থকতা কিছুই নেই।’ রাসুলুল্লাহ (স.) আরও ইরশাদ করেছেন, ‘রোজা ঢালস্বরূপ, যতক্ষণ না তা ত্রুটিযুক্ত করা হয়।’ (সুনানে নাসায়ি: ২২৩৩)

তাই আমাদের যেন কোনোরকম ত্রুটি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। নফসের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তা না হলে রোজা ফলশূণ্য হয়ে যাবে। রোজার যে সার্থকতা অর্জন করার কথা, সেটি অর্জন হবে না।

অতএব আমরা রোজা রাখব নিজেদেরকে পরিশুদ্ধ করার জন্য। সংযমের শিক্ষা অর্জন করার জন্য। নিজেকে নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনে অভ্যস্ত করার জন্য। আল্লাহ তাআলা আমাদের সেই তাওফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর