শুক্রবার, ১৭ মে, ২০২৪, ঢাকা

নবীর শহর মদিনা

হারুন জামিল
প্রকাশিত: ২৫ মার্চ ২০২৩, ০৪:১৮ পিএম

শেয়ার করুন:

নবীর শহর মদিনা

মদিনার প্রাচীন নাম ইয়াসরিব। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা. মক্কা থেকে এই শহরে হিজরতের পর এর নাম রাখা হয় মদিনা মুনাওয়ারা। অর্থাৎ আলোকিত শহর। এর আরেক নাম মদিনাতুন্নবী বা নবীর শহর। মক্কা থেকে মদিনার দূরত্ব প্রায় ৪৭০ কিলোমিটার। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা.  তাঁর সাথী আবু বকর রা.কে নিয়ে এই দীর্ঘ পথ ১৩ দিনে পাড়ি দিয়ে মদিনার উপকণ্ঠ কোবায় পৌঁছান।

সিরাতগ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, মহানবী সা. ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর মক্কা মুকাররামা থেকে মদিনার উদ্দেশে হিজরত করেন। ২৩ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিষ্টাব্দ মোতাবেক ৮ রবিউল আওয়াল মদিনার পার্শ্ববর্তী কোবায় পৌঁছান তিনি। ২৭ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মোতাবেক মদিনা মুনাওয়ারায় পৌঁছান তিনি।


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন: কাবা বায়তুল্লাহ: আল্লাহর কুদরতি নিদর্শন

মক্কা এবং মদিনার পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। মক্কায় নবীজী সা.-এর জীবনযাপন এবং দীনের দাওয়াত প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। এমনকি আবু জাহেলসহ কতিপয় গোত্রপতি তাঁর প্রাণসংহারের জঘন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এমনই এক কঠিন পরিস্থিতিতে রাসুলে করিম সা. মহান আল্লাহর নির্দেশে মদিনাগমন করেন। মহানবী সা. যেদিন মদিনায় প্রবেশ করছিলেন সেদিন মদিনাবাসীর আনন্দের সীমা ছিল না। তারা মহানবী সা.-এর আগমনপথের প্রায় ৫০ কিলোমিটার অতিক্রম করে তাকে স্বাগত জানাতে প্রতীক্ষা করছিলেন বলে কোনো কোনো ঐতিহাসিক উল্লেখ করেছেন। মহানবীর সা. আগমন উপলক্ষে মদিনার অলিগলিতে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায়। মহামানবকে একনজর দেখতে রাস্তা-ঘাট ও বাড়ির ছাদে ভিড় জমিয়েছিল মানুষ। তাকবির ধ্বনিতে মুখর হয়ে ওঠেছিল চারপাশ। শিশুরা গেয়ে ওঠেছিল ‘তালাআল বাদরু আলাইনা’- ‘ওই দেখো, আমাদের আকাশে আজ পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে! আল্লাহর পথে আহ্বানকারী যতদিন আহ্বান করবে, ততদিন কৃতজ্ঞতা আদায় করা আমাদের দায়িত্ব। আমাদের মধ্যে প্রেরিত হে মহান রাসুল সা. আপনি এসেছেন এমন বিষয় নিয়ে, যা আমাদের অনুসরণ করতেই হবে।’ রাসুলে করিম সা. মদিনার অনতিদূরে কুবায় যাত্রাবিরতি করেন।

কুবায় চার দিন মতান্তরে এক সপ্তাহ অবস্থান করে মদিনার উদ্দেশে বের হন। পথে জুমার নামাজ আদায় করে সন্ধ্যায় মদিনায় প্রবেশ করেন। মদিনার বিভিন্ন গোত্রের লোকেরা আশা করছিলেন, রাসুলুল্লাহ সা. তাদের বাড়িতে অতিথি হবেন। নবীজির যাত্রাপথে প্রত্যেক সাহাবি তাঁর বাড়ি অতিক্রম করার সময় প্রিয়নবী সা.কে সেখানে অবস্থানের অনুরোধ করছিলেন। এমনকি তাঁরা আবেগতাড়িত হয়ে তাঁর উটনির রশি ধরে গতিরোধ করতে চাচ্ছিলেন। তখন মহানবী সা. বলেন, তোমরা উটনির পথ ছেড়ে দাও। সে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশপ্রাপ্ত। উটনি বনু নাজ্জারের বসতিতে এসে থেমে যায়। তখন তিনি বলেন, ‘ইনশাআল্লাহ! এটাই হবে আমাদের মানজিল।’ এটা ছিল নবী সা.-এর নানাদের বসতি। তখন বনু নাজ্জারের কিশোর-কিশোরীরা তাঁর সম্মানে আবৃত্তি করে—‘আমরা বনু নাজ্জার গোত্রের মেয়েরা, কত খুশি ও আনন্দের কথা যে মুহাম্মদ সা. আমাদের প্রতিবেশী হয়েছেন।’তাদের জবাবে নবী করিম সা. বলেন, ‘আল্লাহ জানেন আমি তোমাদের ভালোবাসি।’


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন: জাবালে নুর: আজও দীপ্তিময়

বনু নাজ্জারের লোকেরা মহানবী সা.কে অতিথি হিসেবে পেতে অনুনয় করেন। আবু আইয়ুব আনসারি ও আসআদ ইবনে জুরারাহ রা. নবীজির উটনির লাগাম ধরেন। কিন্তু আবু আইয়ুব আনসারি রা.-এর বাড়ি নিকটবর্তী হওয়ায় তিনি তাঁর আবেদনে সম্মত হন।

মদিনায় যেখানে আল্লাহর নির্দেশে উটনি বসে পড়েছিল সেখানেই প্রিয়নবীর অংশগ্রহণে নির্মাণ করা হয় মসজিদে নববি। জায়গাটির মালিক ছিল সাহল ও সুহাইল নামক দুই এতিম বালক। তারা ছিলেন নবীজি সা.-এর মাতৃকুলের আত্মীয়। তিনি মসজিদ নির্মাণ করবেন জানার পর বালকদ্বয় জায়গাটি দান করে দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু নবী সা. উপযুক্ত মূল্য পরিশোধ করেই তা গ্রহণ করেন। রাসুলুল্লাহ সা. আবু বকর রা.কে মূল্য পরিশোধের নির্দেশ দিলে তিনি তাদের জমির বিনিময়ে ১০ দিনার প্রদান করেন। মসজিদ নির্মাণের আগে জায়গাটিতে খেজুর শুকানো হতো। তবে সেখানে কিছু খেজুর ও অন্য গাছ ছিল, মুশরিকদের কয়েকটি কবরও ছিল। মহানবী সা. গাছ কেটে, কবর ভেঙে স্থানটিকে সমতল করার নির্দেশ দেন। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা. মদিনায় আবু আইয়ুব আনসারির রা. বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেন। বর্তমান মসজিদে নববীর অনতিদূরে তাঁর গৃহ ছিল।

রাসুলুল্লাহ সা. দ্বিতল বাড়ির নিচতলায় থাকতে মনস্থির করেন। কিন্তু নবীজি সা.কে নিচতলায় রেখে তিনি দোতলায় থাকবেন—এটা তাঁর মনে সায় দিচ্ছিল না। তিনি রাসুলুল্লাহ  সা.কে দোতলায় অবস্থানের অনুরোধ করেন। জবাবে নবী সা. বলেন, ‘আবু আইয়ুব, আমি আমার ও সাক্ষাৎপ্রার্থীদের জন্য নিচতলায় থাকাকেই সুবিধাজনক মনে করি।’সাহাবি আবু আইয়ুব আনসারি রা. খুব বেশি সচ্ছল ছিলেন না। কিন্তু নবীজি সা.-এর আদর-আপ্যায়নে, সেবা-যত্নে তিনি কোনো ত্রুটি করেননি । তিনি বলেন, ‘আমরা রাসুলুল্লাহ সা.-এর জন্য রাতের খাবার প্রস্তুত করে পাঠাতাম। কোনো খাবার ‘অবশিষ্ট’ ফিরলে আমি ও আমার স্ত্রী যেখানে নবীজি  সা. মুখ লাগিয়ে খেয়েছেন, সেখান থেকে খেয়ে নিতাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘একবার রাতে পানির পাত্র ভেঙে যায়। তখন আমি ও আমার স্ত্রী আমাদের পরিধেয় একমাত্র চাদর দিয়ে পানি মুছে নিলাম। যেন পানি গড়িয়ে নিচে পড়ে রাসুলুল্লাহ সা. এর কষ্টের কারণ না হয়।’ নবীজি সা.আবু আইয়ুব আনসারি রা.-এর ঘরে সাত মাস অবস্থান করেন।

আরও পড়ুন: তায়েফ: যেখানে এখনো অশ্রু ঝরে

প্রসিদ্ধ সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা করেছেন। একবার রাসুল সা. আবুবকর সিদ্দিক রা. এবং ওমর রা. রোদ্রমুখর দুপুরে প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে বের হন। এরপর সবাই আবু আইয়ুব আনসারির বাড়িতে যান। আবু আইয়ুব রা.তখন পাশেই এক খেজুর বাগানে কাজ করছিলেন। রাসুল সা.-এর আওয়াজ শুনেই তিনি দৌড়ে আসেন। অসময়ে মেহমান নিয়ে রাসুল সা.-এর আগমনে তিনি খানিকটা বিস্মিত হন। দ্রুত তিনি খেজুর বাগানে গিয়ে একটি খেজুরের কাঁদি কেটে আনেন। কাঁদিতে কাঁচা, পাকা, আধা-পাকা সবধরনের খেজুরে ভরপুর ছিল। রাসুল সা. এ ধরনের কাঁদি আনার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি চাই আপনি আপনার পছন্দের খেজুর গ্রহণ করুন। আমি জানি না, এই মুহূর্তে আপনার কোন ধরনের খেজুর বেশি পছন্দ। তাই সবধরনের খেজুরের একটি কাঁদি কেটে এনেছি। এরপর তিনি একটা ছাগলছানা জবাই করলেন। স্ত্রীকে বললেন, ভালো করে রুটি বানাতে। ছাগলের অর্ধেক ঝোল করে রান্না করা হয়। বাকি অর্ধেক দিয়ে কাবাব তৈরি করা হয়। এখানেও তিনি রাসুল সা.-এর পছন্দকে প্রাধান্য দেন।

জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর