বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

রোজা যেভাবে জাহান্নাম থেকে বাঁচায় 

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৯ মার্চ ২০২৩, ০২:১২ পিএম

শেয়ার করুন:

রোজা যেভাবে জাহান্নাম থেকে বাঁচায় 

মহিমান্বিত মাস রমজান। পবিত্র রমজানে গুনাহমুক্ত হয়ে জাহান্নাম থেকে মুক্তির অবারিত সুযোগ লাভ করে থাকেন একজন ঈমানদার। এই মাসকে যারা নবীজির শিক্ষা অনুযায়ী কাজে লাগাতে পারেন, তাদের গুনাহ থাকে না, জাহান্নাম থেকে তারা মুক্তিলাভ করেন। আর জাহান্নাম থেকে রক্ষা পেয়ে জান্নাতে প্রবেশ করাই একজন ঈমানদারের বড় সাফল্য।

পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘জীবমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। কেবলমাত্র কেয়ামতের দিনই তোমাদেরকে তোমাদের কর্মফল পূর্ণমাত্রায় দেওয়া হবে। অতঃপর যাকে আগুন থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে সে-ই সফলকাম। আর পার্থিব জীবন ছলনাময় ভোগ ছাড়া আর কিছু নয়। (সুরা আলে ইমরান: ১৮৫)


বিজ্ঞাপন


মানুষ গুনাহের ভেতর জীবনযাপন করে। জেনে- না জেনে প্রতিনিয়ত গুনাহ করে। গুনাহের বোঝাকে সরিয়ে পবিত্র জীবন শুরু করতে এক সুন্দর সকাল আপনার সামনে তুলে ধরতে পারে রোজা। রোজা মানুষের গুনাহকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে দেয়। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানসহ সওয়াবের আশায় রমজানে সিয়াম পালন করবে, তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যাবে।’ (বুখারি: ১৯০১) 

জান্নাতে রোজাদারদের জন্য নির্ধারিত দরজা
পবিত্র রমজানের রোজা এমন এক আমল, যার জন্য রয়েছে নির্ধারিত জান্নাতের দরজা- যার নাম ‘রাইয়ান’। যে দরজা দিয়ে শুধু রোজা পালনকারী ব্যক্তিই প্রবেশ করবে। রোজাভঙ্গকারী ব্যক্তি এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। হাদিসে বিধৃত হয়েছে— রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘জান্নাতের রাইয়ান নামক একটি দরজা আছে। এ দরজা দিয়ে কেয়ামতের দিন সাওম পালনকারীরাই প্রবেশ করবে। আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। ঘোষণা দেওয়া হবে, সওম পালনকারীরা কোথায়? তখন তারা দাঁড়াবে। তারা ছাড়া আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না। তাদের প্রবেশের পরই দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে। যাতে করে এ দরজাটি দিয়ে অন্য কেউ প্রবেশ না করে।’ ( সহিহ বুখারি: ১৮৯৬)

আরও পড়ুন: শবে কদরে ৪টি আমল অবশ্যই করবেন

রমজানের রোজা জাহান্নামের প্রতিবন্ধক
জাহান্নাম শাস্তির প্রধান জায়গা; অপরাধীর আবাস্থল। রোজা মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়। রোজাকে বলা হয় জাহান্নামের প্রতিবন্ধক। রাসুল (স.) বলেন, ‘যুদ্ধের মাঠে ঢাল যেমন তোমাদের রক্ষাকারী, সিয়ামও তদ্রূপ জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাওয়ার ঢাল।’ (ইবনে মাজাহ: ১৬৩৯; বায়হাকি: ৪/২১০)


বিজ্ঞাপন


অপর একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় এক দিন রোজা রাখে, আল্লাহ তার বিনিময়ে জাহান্নাম থেকে তার মুখমণ্ডলকে ৭০ বছরের দূরত্বে রাখেন। (ইবনে মাজাহ: ১৭১৮)

রমজানে দান-সদকা জাহান্নাম থেকে মুক্তির বিশেষ আমল
রমজানে দান-সদকা করেও জাহান্নাম থেকে বাঁচার সুযোগ রয়েছে। অন্য সময়েও দান-সদকার সওয়াব কম নয়। তবে মহিমান্বিত মাস রমজানে দান-সদকার গুরুত্ব ও ফজিলত অনেক বেশি। রাসুলুল্লাহ (স.) রমজানে অনেক বেশি দান করতেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (স.) ছিলেন মানুষের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা। রমজানে তার দানশীলতা (অন্য সময় থেকে) অধিকতর বৃদ্ধি পেত..।’ (বুখারি: ০৬; মুসলিম: ২৩০৮; মুসনাদে আহমদ: ২৬১৬)

দান-সদকার ফজিলত সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, আদি ইবনে হাতিম (রা.) বলেন, নবী (স.) বলেন, তোমরা জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচো। এরপর তিনি পিঠ ফেরালেন এবং মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। আবার বলেন, তোমরা জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচো। এরপর তিনি পিঠ ফেরালেন এবং মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। তিনবার এরূপ করলেন। এমনকি আমরা ভাবছিলাম যে তিনি বুঝি জাহান্নাম সরাসরি দেখছেন। তিনি আবার বলেন, তোমরা এক টুকরা খেজুর দিয়ে হলেও জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচো। আর যদি কেউ সেটাও না পাও তাহলে উত্তম কথার দ্বারা হলেও (আগুন থেকে নিজেকে রক্ষা করো)। (বুখারি: ৬৫৪০)

রমজানে কোরআন তেলাওয়াতের উপকার
রমজান মাসের সঙ্গে কোরআনের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। এই মাসেই পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছে। তাই পবিত্র রমজানে কোরআনুল কারিম তেলাওয়াত করা কোরআনের হক। এই হক যারা আদায় করে তাদের জন্যও জাহান্নাম থেকে মুক্তির গ্যারান্টি রয়েছে। সহিহ মুসলিমের আবু উমামা আল বাহিলি (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত, নবীজি (স.) বলেন, ‘ তোমরা কোরআন পড়ো, কেননা তেলাওয়াতকারীদের জন্য কোরআন সুপারিশকারী হিসেবে আসবে।’ (সহিহ মুসলিম: ৮০৪) সহিহ ইবনে হিব্বানে এসেছে, ‘কোরআন এমন সুপারিশকারী যার সুপারিশ কবুল করা হবে। যে ব্যক্তি কোরআনকে পথপ্রদর্শক বানাবে কোরআন তাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে। যে ব্যক্তি কোরআনকে পশ্চাতে ফেলে রাখবে কোরআন তাকে জাহান্নামে পাঠাবে।’ (ইবনে হিব্বান: ১২৪)

আরও পড়ুন: প্রতিদিন কোরআন তেলাওয়াতের ফজিলত

পবিত্র রমজানে নবীজি (স.) অধিক পরিমাণে কোরআন অনুশীলনে ব্যস্ত থাকতেন। কোরআন শিক্ষায় রাসুলের সহপাঠী হওয়ার জন্য জিব্রাইল (আ.) নিয়োজিত ছিলেন। এ বিষয়ে হাদিসে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়— ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, জিবরাইল (আ.) রমজানের প্রতি রাতে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন এবং ফজর অবধি তার সাথে অবস্থান করতেন। (বুখারি: ১৯০২)

রাসুলুল্লাহ (স.) তাকে কোরআন শোনাতেন এবং তিনি রাতভর তারাবি ও কিয়ামুল লাইলে দীর্ঘক্ষণ কোরআন তেলাওয়াত করতেন। আরো এসেছে- রাসুলুল্লাহ (স.) তাঁর প্রিয়কন্যা ফাতেমাকে (রা.) গোপনে জানালেন যে, জিব্রাইল প্রতি বছর (রমজানে) আমাকে একবার কোরআন শোনাতেন এবং শুনতেন, এ বছর তিনি দুবার আমাকে শুনিয়েছেন-শুনেছেন। একে আমি আমার সময় সমাগত হওয়ার ইঙ্গিত বলে মনে করি। (বুখারি: ৩৬২৪)

অন্যান্য নেক আমলের ফজিলত
পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত, দান-সদকা ছাড়াও একজন রোজাদারের বিশেষ আরও আমল রয়েছে, যেমন রোজাদারকে ইফতার করানো, রাত জেগে ইবাদত করা, সামর্থ্য থাকলে ওমরা করা ইত্যাদি আমল গুনাহমুক্ত হওয়া, অসীম সওয়াব লাভ করা এবং জান্নাতে প্রবেশ করার মতো ফজিলতপূর্ণ আমল। ওমরার সওয়াবের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘রমজান মাসের ওমরা (সওয়াবের ক্ষেত্রে) হজের সমতুল্য।’ (ইবনে মাজাহ: ২৯৯১)

রোজাদারকে ইফতার করানোর ফজিলত সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, সে রোজাদারের সমপরিমাণ সওয়াব পাবে; রোজাদারের সওয়াব থেকে একটুও কমানো হবে না।’ (তিরমিজি: ৮০৭; ইবনে মাজাহ: ১৭৪৬)

রমজানে তাহাজ্জুদ পাঠও বিশেষ ফজিলতপূর্ণ আমল। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানের রাতে ঈমানসহ পুণ্যের আশায় রাত জেগে ইবাদত করে, তার আগের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’ (সহিহ বুখারি: ৩৬)

লাইলাতুল কদর উম্মতে মুহাম্মদির জন্য তোহফা
উম্মতে মুহাম্মদির জন্য একটি রাত আল্লাহর পক্ষ থেকে তোহফাস্বরূপ। সেই রাতটির নাম লাইলাতুল কদর বা শবে কদর। পবিত্র কোরআন এই রাতেই নাজিল হয়েছিল। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয় আমি কদরের রাতে কোরআন নাজিল করেছি।’ (সুরা কদর: ১) যেই রাতটি হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। যে ব্যক্তি এর কল্যাণ ও বরকত থেকে বঞ্চিত থাকল, সে যেন সকল কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হলো। আর কেবল অভাগাই এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত থাকে।’ (ইবনে মাজাহ: ১৬৪৪; নাসায়ি: ২১০৬)

আরও পড়ুন: শবে কদরের এত মর্যাদা কেন, ফজিলত কী?

রমজানের শেষ দশকেই রয়েছে এই রাত। হাদিসে এসেছে ‘রমজানের শেষ দশ রাত শুরু হলে নবী (স.) কোমর বেঁধে নামতেন। তিনি নিজে রাত জেগে ইবাদত করতেন এবং তার পরিবারের সবাইকে (ইবাদতের জন্য) জাগিয়ে দিতেন।’ (সহিহ বুখারি: ২০২৪; সহিহ মুসলিম: ১১৭৪)

ইতেকাফ করা
আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করতেন। তাঁর ওফাত পর্যন্ত এই নিয়মই ছিল। (সহিহ বুখারি: ২০২৬) ইতেকাফের ফজিলত সম্পর্কে হাদিসে এসেছে ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এক দিন ইতেকাফ করবে আল্লাহ তায়ালা তার ও জাহান্নামের মাঝে তিন পরিখা পরিমাণ দূরত্ব সৃষ্টি করবেন; যার দূরত্ব দুই দিগন্তের দূরত্বের থেকে বেশি দূরত্ব হবে।’ (কানযুল উম্মাল: ২৪০১৯)

রমজানের ব্যাপারে যারা গাফেল
রমজান মাস পেয়েও যারা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের রহমত থেকে বঞ্চিত থেকে গেল, নিজের গুনাহর জন্য মহান মাওলার ক্ষমালাভে ব্যর্থ থেকে গেল এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি অর্জন করতে পারল না তারা হতভাগা। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ওই ব্যক্তি ধ্বংস হোক যার সামনে আমার নাম উল্লেখ করা হলো আর সে আমার ওপর দরুদ পড়ল না এবং ওই ব্যক্তির ধ্বংস হোক যে তার মা-বাবাকে বৃদ্ধ অবস্থায় পেল কিন্তু জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল না। আর ওই ব্যক্তির ধ্বংস হোক যে রমজান মাস পেল অথচ তার গুনাহ মাফ করা হলো না। (মুসনাদে বাজ্জার: ৮৪৬৫)

অতএব, পবিত্র রমজানে নবীজির অনুসরণের মধ্যে রয়েছে, গুনাহ থেকে মুক্ত হয়ে সুন্দর জীবন শুরু করার সুযোগ, জান্নাতে প্রবেশ ও জাহান্নাম থেকে মুক্ত হওয়ার নিশ্চয়তা। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে পবিত্র রমজানকে এমনভাবে কাজে লাগানোর তাওফিক দান করুন, যাতে গুনাহমুক্ত হওয়া যায়, জাহান্নাম থেকে মুক্ত হওয়া যায়। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর