শুক্রবার, ৩ মে, ২০২৪, ঢাকা

শবে কদরের এত মর্যাদা কেন, ফজিলত কী?

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ২০ এপ্রিল ২০২২, ০৩:৪৬ পিএম

শেয়ার করুন:

শবে কদরের এত মর্যাদা কেন, ফজিলত কী?

আরবি ‘লাইলাতুল কদর’ এর ফারসি হলো ‘শবে কদর’। লাইলাতুন বা শব-এর অর্থ হচ্ছে রাত। কদর-এর অনেক অর্থ, যেমন- পরিমাপ, পরিমাণ, নির্ধারণ, ভাগ্য নিরূপণ, সম্মান, গৌরব, মর্যাদা ও মহিমা। সুতরাং ‘লাইলাতুল কদর’ বা ‘শবে কদর’ অর্থ সম্মানিত, মর্যাদাপূর্ণ, মহিমান্বিত ও ভাগ্যনির্ধারণী রজনী।

এ রাতকে ‘লাইলাতুল কদর’ বলার কারণ হচ্ছে, এ রাতের পূর্বে আমল না করার কারণে যাদের কোনো সম্মান মর্যাদা, মূল্যায়ন ছিল না তারাও তওবা-ইস্তেগফার ও ইবাদতের মাধ্যমে এ রাতে সম্মানিত ও মহিমান্বিত হয়ে যান। (তাফসিরে মারেফুল কোরআন)


বিজ্ঞাপন


আল্লাহ তায়ালা মানব জাতির হেদায়াতের জন্য একশ চারখানা আসমানি কিতাব নাজিল করেছেন। এর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ হলো কোরআনুল কারিম, যা সর্বশ্রেষ্ঠ ও শেষ নবী মুহাম্মদ (স.)-এর ওপর নাজিল করেছেন। আর এ মহাগ্রন্থ লাইলাতুল কদরেই নাজিল করা হয়। তাই কোরআনুল কারিমের সম্মানেই এ রজনীর এত বড় মরতবা। কোরআনের বিভিন্ন সুরায় আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আমি কোরআনকে মোবারকময় রজনী ও রমজান মাসে অবতীর্ণ করেছি।’

অতি পূণ্যময় এ রাতের সম্মানে পবিত্র কোরআনে একটি পূর্ণাঙ্গ সুরা ‘সুরাতুল কদর’নাজিল হয়েছে। এ সুরায় বলা হয়েছে, লাইলাতুল কদরে কোরআন নাজিল হয়েছে, এটি হাজার মাসের চেয়েও উত্তম এবং এ রাতে ফজর পর্যন্ত কল্যাণ, রহমত, বরকত ও শান্তি বর্ষণ করা হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় আমি কোরআন নাজিল করেছি লাইলাতুল কদরে। আপনি কি জানেন, লাইলাতুল কদর কী? লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ রাতে ফেরেশতারা ও জিব্রাইল (আ.) আল্লাহর নির্দেশে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে অবতরণ করেন। এ রাতের ফজর পর্যন্ত প্রশান্তি বর্ষিত হয়।’ (সুরা কদর: ১-৫)

হাজার মাসের চেয়ে উত্তম অর্থ শুধু যে একহাজার মাসের চেয়ে উত্তম-বিষয়টি এমন নয়, বরং অনেক বেশি বোঝাতেও হাজার শব্দটা ব্যবহার করা হয়। তারপরও আমরা যদি এখানে শুধু এক হাজার মাসই ধরি এর সময় দাঁড়ায় ৮৩ বছর ৪ মাস। তার মানে ৮৩ বছর ৪ মাস পর্যন্ত ইবাদত করার যে ফজিলত বা সওয়াব পাওয়া যায় তা এ এক রাতের ইবাদতের দ্বারাই মহান আল্লাহ প্রদান করে থাকেন।

সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম শরিফের হাদিসে বর্ণিত হয়েছে— ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে (ঈমানসহ) এবং সওয়াব প্রাপ্তির প্রত্যাশায় এ রাতে জেগে ইবাদত বন্দেগি করবে, তার পূর্ববর্তী জীবনের সব পাপ মোচন করে দেওয়া হবে।’

আয়াতে ‘গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেরেশতাদের অবতরণ’ বলতে পরবর্তী এক বছরের অবধারিত বিধিলিপি ব্যবস্থাপক ও প্রয়োগকারী ফেরেশতাগণের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এতে প্রত্যেক মানুষের বয়স, মৃত্যু, রিজিক, বৃষ্টি ইত্যাদির ফরমান নির্দিষ্ট ফেরেশতাগণকে লিখে দেওয়া হয়। এমনকি এ বছর কে হজ করবে তাও লিখে দেওয়া হয়। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.)-এর বক্তব্য মতে, চার ফেরেশতাকে এসব কাজ বুঝিয়ে দেওয়া হয়। তারা হলেন— ইসরাফিল, মিকাইল, আজরাইল ও জিবরাইল (আ.) (কুরতুবি)।

লাইলাতুল কদরে কোরআন নাজিলের এক ব্যাখ্যা হচ্ছে, এ রাতে আল্লাহ তাআলা পুরো কোরআনকে লাউহে মাহফুজ থেকে প্রথম আসমানে নাজিল করেন। অন্য আরেকটি মতে, এ রাতে কোরআন নাজিল শুরু হয়। পরবর্তী ২৩ বছরে বিভিন্ন সুরা বা সুরার অংশবিশেষ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঘটনা ও অবস্থার প্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হয়।

সুরা কদরের শানে নুজুল হচ্ছে, একবার রাসুলুল্লাহ (স.) বনী ইসরাইলের একজন সাধকের কথা আলোচনা করেন। যিনি একহাজার মাস যাবত দিনের বেলা রোজা রেখে আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করতেন এবং রাত জেগে আল্লাহর ইবাদত করতেন। এ কথা শুনে সাহাবারা খুব নিরাশ হয়ে পড়লেন। তারা বললেন, আমাদের বয়স পূর্বের উম্মতদের তুলনায় খুবই কম। আমরা কীভাবে তাদের মতো নেকআমল করে সওয়াব অর্জন করব। এ প্রেক্ষিতে এ সুরাটি অবতীর্ণ হয়। যাতে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর উম্মতদের মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য প্রমাণিত হয়।

কিন্তু শবে কদর কবে? এর উত্তরে হাদিস শরিফে এসেছে, ‘তোমরা শেষ দশকের বেজোড় রাতে শবে কদর তালাশ করো।’(বুখারি: ২০১৭)

অর্থাৎ রমজানের শেষ ১০ দিনে শবে কদর তালাশ করতে বলেছেন রাসুলুল্লাহ (স.)। মহিমান্বিত রাতটির পরিচয় সুস্পষ্ট করে কি তিনি প্রিয় উম্মতকে বলে দিতে পারতেন না? এর উত্তর জানার আগে নিচের হাদিসটি দেখে নেই।

উবাদা ইবনে সামিত (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসুল (স.) ‘লাইলাতুল কদর’ এর ব্যাপারে খবর দিতে বের হলেন। এ সময় দুইজন মুসলমান ঝগড়া করছিলেন। তখন নবী কারিম (স.) বললেন, ‘আমি আপনাদের ‘লাইলাতুল কদর’ এর ব্যাপারে অবহিত করতে বের হয়েছিলাম। কিন্তু অমুক অমুক ব্যক্তি বিবাদে লিপ্ত হওয়ায় তা (সেই জ্ঞান) উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। আশা করি, উঠিয়ে নেওয়াটা আপনাদের জন্য বেশি ভালো হয়েছে। আপনারা সপ্তম (২৭ তম), নবম (২৯ তম) এবং পঞ্চম (২৫ তম) তারিখে এর সন্ধান করুন।’ (সহিহ বুখারি: ৪৯)

উপরোক্ত হাদিস থেকে সহজেই অনুমেয় যে, শবে কদরের নির্দিষ্ট দিনক্ষণ অজানা রাখার পেছনে আল্লাহ তাআলার বিশেষ হিকমত নিহিত। হয়তো এতেই উম্মতের কল্যাণ, তাই নবীজি (স.)-কে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাফসিরের কিতবগুলোতেও এটাই সার সংক্ষেপ। আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেন, ‘আলেমগণ বলেন, এই রাতটির নির্দিষ্ট তারিখ গোপন রাখার পিছনে হিকমত হলো— মানুষ যেন এ রাতের মর্যাদা লাভের জন্য চেষ্টা সাধনা করে। নির্দিষ্ট তারিখ জানা থাকলে— মানুষ শুধু নির্দিষ্টভাবে সেই রাতে ইবাদত-বন্দেগি করতো। (ফাতহুল বারি: ৪/২৬৬)

তবে, শবে কদরের সম্ভাব্য হিসাবে রমজানের ২৭তম রাতকে অগ্রগণ্য ধরা হয়। হাদিসের গবেষকরা বলেন, রমজান মাসে নির্দিষ্ট কোনো রাতকে লাইলাতুল কদর হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য সুস্পষ্ট দলিলের প্রয়োজন। তবে অন্যান্য রাতের চেয়ে শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোর কোনো একটিতে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আর এর মধ্যে ২৭তম রাতে হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। বিভিন্ন হাদিস থেকে এ ইঙ্গিত পাওয়া যায়। (ফাতাওয়াউল লাজনাহ আদ্-দায়িমা; সৌদি আরবের ফতোয়াবিষয়ক স্থায়ী কমিটির ফতোয়াসমগ্র: ১০/৪১৩)

বাংলাদেশে ২৭ রমজানের রাতটি আসবে আগামি ২৮ এপ্রিল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত। (সূত্র: ইসলামিক ফাউন্ডেশন)

কিন্তু একজন মুসলিমের নির্দিষ্ট কোনো রাতকে লাইলাতুল কদর হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত নয়। বরং শেষ দশকের সবরাতেই যথাসম্ভব শবে কদরের তালাশ করা উচিত। বিশেষত শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলো। এটিই নবী (স.)-এর আদর্শ। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত যে তিনি বলেন—

‘রমজানের শেষ) দশ রাত শুরু হলে— নবী (স.) কোমর বেঁধে নামতেন। তিনি নিজে রাত জেগে ইবাদত করতেন এবং তার পরিবারের সবাইকে (ইবাদতের জন্য) জাগিয়ে দিতেন।’ (সহিহ বুখারি: ২০২৪; সহিহ মুসলিম: ১১৭৪)

মহিমান্বিত এ রজনীর সব নেয়ামত হাসিলের জন্য প্রথমেই শিরকমুক্ত ঈমান পরিশুদ্ধ নিয়ত ও বেদআতমুক্ত আমলের মাধ্যমে রাতযাপন করতে হবে। কদর লাভের আশায় শেষ দশ দিনে ইতেকাফ করা, বেশি বেশি নফল নামাজ পড়া, তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া, কোরআন তেলাওয়াত করা, দোয়া-দরুদ, দান-সদকা ও তওবা-ইসতেগফার করা উচিত।

এ রাতকে কেন্দ্র করে মনগড়া কিছু আমলের প্রচলন দেখা যায়, যা শরিয়তসম্মত নয়। যেমন লাইলাতুল কদরের নামাজ বলে নির্দিষ্ট কোনো নামাজ পড়া, দলবদ্ধভাবে একেক মসজিদে ঘুরে ইবাদত করা, কবর জিয়ারত করা, আতশবাজি ফোটানো ইত্যাদি। এ রাত যাপন উপলক্ষে অহেতুক কোনো অনুষ্ঠান বা মসজিদে কোনো ভোজের আয়োজন করা ইসলামসম্মত নয়।

রাসুল (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদর পেল কিন্তু ইবাদত-বন্দেগিতে সময় কাটাতে পারল না, তার মতো হতভাগা দুনিয়াতে আর কেউ নেই। সুতরাং লাইলাতুল কদর তালাশ করে সঠিক ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে রাত যাপনে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা আমাদের একান্ত কর্তব্য।

কেউ শবে কদর পেলে, তার জন্য একটি বিশেষ দোয়ার উল্লেখ রয়েছে হাদিসে। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- হে আল্লাহর রাসুল, আমি যদি জানতে পারি যে, কোন রাতটি লাইলাতুল কদর— তাহলে তখন কোন দোয়া পড়বো? তখন তিনি বললেন, তুমি বলো—

اللَّهمَّ إنَّك عفُوٌّ كريمٌ تُحِبُّ العفْوَ، فاعْفُ عنِّي

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন কারিমুন তুহিব্বুল আফওয়া ফা'ফু আন্নি।

অর্থ: ‘হে আল্লাহ, আপনি মহানুভব ক্ষমাশীল। আপনি ক্ষমা করতে পছন্দ করেন। অতএব আমাকে ক্ষমা করুন।’ (তিরমিজি: ৩৫১৩)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সবাইকে শবে কদর নসিব করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর