তাকওয়া মুমিনের অমূল্য সম্পদ। এই সম্পদ যারা হারিয়ে ফেলে তারা চরম দুর্ভাগা। যার তাকওয়া বা আল্লাহর ভয় নেই, তার কিছুই নেই। খাঁটি মুসলিম হওয়ার অন্যতম উপায় হচ্ছে তাকওয়া। আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমের অনেক আয়াতে তাকওয়া অবলম্বনের কথা বলেছেন। যার যতবেশি তাকওয়া সে আল্লাহর কাছে ততবেশি মর্যাদাবান।
তাকওয়া অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর ওপর ফরজ। আল্লাহ তাআলার নির্দেশ, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, যেভাবে তাকে ভয় করা উচিত।’ (সুরা আলে ইমরান: ১২০)। তিনি আরো বলেন, হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকো। (সুরা তাওবা: ১১৯)। আরো ইরশাদ হয়েছে, হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক ও সত্য কথা বলো। (সুরা আহজাব: ৭০)। আর আল্লাহ তাআলার নির্দেশ পালন করা প্রত্যেকের জন্য আবশ্যক।
বিজ্ঞাপন
তাকওয়া এমন একটি গুণ যা অর্জন করলে জান্নাতের নিশ্চয়তা রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, নিশ্চয় মুত্তাকিরা থাকবে জান্নাতে ও নেয়ামতে, তারা উপভোগ করবে, যা তাদের পালনকর্তা দেবেন এবং তিনি জাহান্নামের আজাব থেকে তাদেরকে রক্ষা করবেন। (সুরা তুর: ১৭-১৮)
শুধু আখেরাত নয়, দুনিয়াতেও আল্লাহ তাআলা মুত্তাকিদের সসম্মানে রাখবেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, যে আল্লাহকে ভয় করবে আল্লাহ তাকে বিপদাপদ থেকে নিষ্কৃতি দেবেন এবং তাকে ধারণাতীত রিজিক দান করবেন। (সুরা তালাক: ২-৩)
আরও পড়ুন: আল্লাহর সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের উপায়
মহামূল্যবান সম্পদ তাকওয়া একটি গুনাহের কারণে হারিয়ে যায়। সেই গুনাহটি হলো গোপন পাপ। গোপনে পাপ করার সময় বান্দার সামনে থাকেন শুধুমাত্র আল্লাহ তাআলা। আর গোপনে পাপ করার অর্থই হলো, মহান আল্লাহকে ভয় পাওয়া তো দূরের কথা, আল্লাহর কোনো দামই নেই। নাউজুবিল্লাহ। সুতরাং সাধারণ গুনাহের চেয়ে গোপনে করা গুনাহের জঘন্যতা অনেক বেশি।
বিজ্ঞাপন
গোপনে যারা গুনাহ করেন, তারা কেউ না বুঝে করেন না। ভুল করেও করেন না। জেনে বুঝে এবং আয়োজন করেই করেন। কারো ক্ষেত্রে এমন হতে পারে যে, তুলনামূলক ছোট গুনাহ দিয়ে শুরু করেছিলেন, পরে ধীরে ধীরে শয়তানের জালে ফেঁসে গেছেন। এক্ষেত্রেও শুরুটা কিন্তু তিনি নিজেই করেন এবং ইচ্ছে করেই করেন।
গোপনে পাপ করায় অভ্যস্ত বান্দা তাকওয়া হারিয়ে ফেলার কারণে আল্লাহর ইবাদতে আর স্বাদ পান না। অন্তর হয়ে যায় পাথর। কোরআন তেলাওয়াত করতে ইচ্ছে করে না; করলেও মধুর লাগে না। ধীরে ধীরে তিনি দ্বীন থেকেই ছিটকে পড়েন। এক পর্যায়ে ধ্বংস আর অধঃপতনের চরম সীমায় পৌঁছে যান।
ইমাম ইবনুল কাইয়িম (রহ) বলেন, أجمع العارفون بالله ان ذنوب الخلوات هي أصل الانتكاسات، وأن عبادات الخفاء هي أعظم أسباب الثبات অর্থাৎ ‘সকল আউলিয়ায়ে কেরাম একমত যে, বান্দার গোপন গুনাহ দ্বীনের পথে তার পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ। আবার দ্বীনের পথে অবিচল থাকার অন্যতম উপায় হচ্ছে গোপন ইবাদত।’
আরও পড়ুন: গুনাহ হয়ে গেলে দ্রুত তাওবা করা জান্নাতিদের গুণ
এছাড়াও গোপন গুনাহের জঘন্য পরিণতি হলো, ঈমানহারা অবস্থায় তার মৃত্যু হওয়ার আশঙ্কা বেশি। হজরত সাহল বিন সাদ আস সায়েদি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি বাহ্যিকভাবে জান্নাতিদের মতো আমল করবে; অথচ সে জাহান্নামী। আর কোনো ব্যক্তি বাহ্যিকভাবে জাহান্নামীদের মতো আমল করবে, অথচ সে জান্নাতি।’ (সহিহ মুসলিম: ৬৬৩৪)
আরও ইরশাদ হয়েছে, আমি আমার উম্মতের কতক দল সম্পর্কে অবশ্যই জানি, যারা কেয়ামতের দিন তিহামার শুভ্র পর্বতমালা সমতুল্য নেক আমল নিয়ে উপস্থিত হবে, কিন্তু মহামহিম আল্লাহ সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করবেন। সাওবান (রা.) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! তাদের পরিচয় পরিষ্কারভাবে আমাদের নিকট বর্ণনা করুন, যাতে অজ্ঞাতসারে আমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত না হয়ে যাই। তিনি বললেন, তারা তোমাদেরই ভ্রাতৃগোষ্ঠী এবং তোমাদের সম্প্রদায়ভুক্ত। তারা রাতের বেলা তোমাদের মতোই ইবাদত করবে। কিন্তু তারা এমন লোক, যারা একান্ত গোপনে আল্লাহর হারামকৃত কর্মে লিপ্ত হবে।’ (ইবনে মাজা: ২/১৪১৮)
লক্ষ্য করুন, ভালো মানুষ হলেও আসলে তিনি ছিলেন গুনাহগার। গোপন গুনাহে লিপ্ত থাকতেন, যা পরিচিতরা জানতেন না। এরা আসলে মুনাফিক। তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘তারা মানুষের কাছ থেকে নিজেকে গোপন করে আর আল্লাহর কাছ থেকে গোপন করে না, অথচ তিনি তাদের সঙ্গেই থাকেন, যখন তারা রাতের বেলা এমন কথার পরিকল্পনা করে, যা আল্লাহ পছন্দ করেন না। তারা যা করছে, আল্লাহ সবই বেষ্টন করে আছেন।’ (সুরা নিসা: ১০৮)
ইবনুল জাওযি (রহ.) বলেন, গুনাহ থেকে পরিপূর্ণরূপে বেঁচে থাকো; বিশেষত গোপন গুনাহ থেকে। কেননা, আল্লাহর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, বান্দাকে তার নজর থেকে ফেলে দেয়। আল্লাহ ও তোমার মাঝে গোপনীয় বিষয় সংশোধন করো; তাহলে তিনি তোমার বহিরাগত বিষয় সংশোধন করে দেবেন।’ (সাইদুল খাতির : ২০৭) শায়খ ইবনুল আরাবি বলেন, সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও ক্ষতিগ্রস্ত সে-ই, যে মানুষের সামনে ভালো আমল করে, কিন্তু যে মহান সত্ত্বা তার শাহরগ থেকেও অধিক নিকটবর্তী, তার সামনে বদ আমল করে। (তারিখু দিমাশক: ৫/৩৫৬)
আরও পড়ুন: আল্লাহ পছন্দের বান্দাদের পবিত্র করেন যেভাবে
গোপন পাপ বিভিন্নভাবে হতে পারে। গোপনে গাইরুল্লাহর নাম নিয়ে পশু জবাই করা, অন্যকে দেখানোর জন্য ইবাদত করা, অথবা অপ্রকাশ্য ব্যভিচার বা জিনা করা ইত্যাদি। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘বলে দাও, নিশ্চয়ই আমার রব হারাম করেছেন প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতা আর পাপ এবং অসংগত বিরোধিতা এবং কোনো কিছুকে আল্লাহর শরিক করা—যার কোনো সনদ তিনি প্রেরণ করেননি। আর আল্লাহ সম্পর্কে এমন কিছু বলা, যা তোমরা জানো না।’ (সুরা আরাফ: ৩৩)
সুতরাং গোপন পাপ থেকে বেঁচে থাকা জরুরি। সর্বদা এ কথা অন্তরে জাগ্রত রাখতে হবে যে আল্লাহ আমাকে পর্যবেক্ষণ করছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘..নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ওপর পর্যবেক্ষক।’ (সুরা নিসা: ১)
গোপন গুনাহের ইচ্ছা দমন করতে হলে অন্তরের সঙ্গে মুজাহাদা করতে হবে বা নিজেকে পরিশুদ্ধ করার আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘শপথ প্রাণের এবং যিনি তা সুবিন্যস্ত করেছেন, তার। অতঃপর তাকে অসৎকর্ম ও সৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন। যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে, সেই সফলকাম হয়। আর যে নিজেকে কলুষিত করে, সে ব্যর্থ মনোরথ হয়।’ (সুরা শামস: ৭-১০)
গুনাহ করার সময় এ কথা চিন্তা করা উচিত যে, কেউ কি দেখলে আমি এমন গুনাহ করতে পারতাম? নিশ্চয়ই পারতাম না। আল্লাহ তাআলা তো সবকিছুই দেখছেন। এভাবে নিজের ভেতরের লজ্জাবোধ জাগ্রত করতে হবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি তোমার পরিবারের কোনো প্রভাবশালী সদস্যকে যেমন লজ্জা পাও, আল্লাহকে (কমপক্ষে) তেমন লজ্জা করো।’ (মুসনাদুল বাজ্জার: ৭/৮৯)
বেশি বেশি আল্লাহর কাছে দোয়া করা গোপন পাপ থেকে বেঁচে থাকার অন্যতম উপায়। আল্লাহ যেন নাফরমানি ও সব গুনাহ থেকে হেফাজত করেন। শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে হেফাজত করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, আর আমার বান্দারা যখন তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে; বস্তুত আমি তো রয়েছি সন্নিকটেই। যারা প্রার্থনা করে, তাদের প্রার্থনা কবুল করি, যখন তারা আমার কাছে প্রার্থনা করে। কাজেই আমার হুকুম মান্য করা এবং আমার প্রতি নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করা তাদের একান্ত কর্তব্য, যাতে তারা সৎপথে আসতে পারে।’ (সুরা বাকারা: ১)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে গোপন গুনাহ থেকে বাঁচার তাওফিক দান করুন। তাকওয়ার গুণ অর্জনের তাওফিক দান করুন। দ্বীনের পথে অবিচল থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।

