পৃথিবীর বয়স যত বাড়ছে, ততই আমরা কেয়ামতের নিকটবর্তী হচ্ছি। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- فَهَلْ يَنظُرُونَ إِلَّا السَّاعَةَ أَن تَأْتِيَهُم بَغْتَةً فَقَدْ جَاء أَشْرَاطُهَا فَأَنَّى لَهُمْ إِذَا جَاءتْهُمْ ذِكْرَاهُمْ ‘তারা শুধু এই অপেক্ষাই করছে যে, কেয়ামত অকস্মাৎ তাদের কাছে এসে পড়ুক। বস্তুত কেয়ামতের লক্ষণসমূহ তো এসেই পড়েছে। সুতরাং কেয়ামত এসে পড়লে তারা উপদেশ গ্রহণ করবে কেমন করে?’ (সুরা মুহাম্মদ: ১৮)
কেয়ামত কাকে বলে
আরবি কিয়াম শব্দ থেকে কেয়ামত। এর অর্থ উঠে দাঁড়ানো। ইসলামি আকিদা অনুসাররে ফেরেশতা ইসরাফিল (আ.)-এর শিঙ্গায় ফুঁ দেওয়ার মাধ্যমে কেয়ামত শুরু হবে। মানুষের অবাধ্যতা যখন চরমে পৌঁছবে, আল্লাহর নাম নেওয়ার মতো পৃথিবীতে একটি লোকও থাকবে না, সেদিন আল্লাহ এই বিশ্বজগৎ এবং সবকিছু ধ্বংস করে দেবেন। একেই বলে কেয়ামত। বিশুদ্ধ বর্ণনামতে, ইসরাফিল (আ.) শিঙ্গায় দু’বার ফুঁ দেবেন। (সুরা ঝুমার: ৬৮) প্রথম ফুঁৎকারে আকাশ ফেটে যাবে, তারকাসমূহ খসে পড়বে, পাহাড়-পর্বত ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে তুলার মত উড়তে থাকবে। সকল মানুষ ও জীব-জন্তু মরে যাবে, আকাশ ও সমগ্র পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। দ্বিতীয় ফুঁৎকার দেওয়ার সাথে সাথে পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে যত জীবের সৃষ্টি হয়েছিল, তারা সকলেই জীবিত হয়ে উঠে দাঁড়াবে।
বিজ্ঞাপন
কেয়ামতের আলামত কাকে বলে
আলামত অর্থ নিদর্শন। কেয়ামতের আলামত বলতে কেয়ামত সংঘটিত হওয়ার আগে কিছু নিদর্শন প্রকাশ পাবে তাকে কেয়ামতের আলামত বলা হয়। কেয়ামতের আলামত দুই রকম। (এক) ছোট আলামত (দুই) বড় আলামত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছোট আলামতগুলো কেয়ামত সংঘটিত হওয়ার অনেক আগে থেকে প্রকাশিত হতে থাকবে। আর বড় আলামতগুলো প্রকাশ পাবে অচিরেই।
আরও পড়ুন: যে ফেতনাকে সাহাবিরাও ভয় পেতেন
কেয়ামতের বড় আলামত
রাসুলুল্লাহ (স.) কেয়ামতের অনেক আলামত বা নিদর্শনের বর্ণনা দিয়েছেন। বড় আলামতগুলো হলো- ইমাম মাহদির আত্মপ্রকাশ, মিথ্যুক দাজ্জালের আবির্ভাব, ঈসা (আ.) এর আগমন, ইয়াজুজ-মাজুজের আত্মপ্রকাশ, পূর্ব-পশ্চিম ও আরব অঞ্চলে বড় ধরণের তিনটি ভূমিধ্বস, বিশাল ধোঁয়া, পশ্চিম গগণে সূর্যোদয়, অদ্ভুত জন্তুর প্রকাশ, ইয়েমেন থেকে আগুন বের হয়ে মানুষকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
কেয়ামতের ছোট আলামত
ছোট আলামত যেমন—প্রচুর ধন-সম্পদ হওয়া এবং জাকাত খাওয়ার লোক না-থাকা, নানারকম গোলযোগ (ফিতনা) সৃষ্টি হওয়া, আমানতদারিতা না-থাকা, ইলম উঠিয়ে নেওয়া ও অজ্ঞতা বিস্তার লাভ করা, সুদ-ব্যভিচার-মদ-বাদ্যযন্ত্রের ব্যাপকতা, রাখাল শ্রেণির অট্টালিকা নির্মাণ, কৃতদাসী কর্তৃক স্বীয় মনিবকে প্রসব, মা-বাবার অবাধ্যতা, হত্যা, বেশি ভূমিকম্প হওয়া, মানুষের আকৃতি রূপান্তর, আকাশ থেকে পাথর পড়া, মুমিনের স্বপ্ন সত্য হওয়া, মিথ্যা সাক্ষ্য বেড়ে যাওয়া, নারীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া, আরব ভূখণ্ড তৃণভূমি ও নদনদীতে ভরে যাওয়া, ফোরাত (ইউফ্রেটিস) নদীতে স্বর্ণের পাহাড় প্রকাশ পাওয়া, হিংস্র জীবজন্তু ও জড় পদার্থ মানুষের সঙ্গে কথা বলা ইত্যাদি।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: মহানবী (স.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী: ফোরাত থেকে স্বর্ণের খনি বের হবে
কেয়ামতের যেসব নিদর্শন প্রকাশিত
কেয়ামতের আলামতগুলোর মধ্যে বেশ কিছু নিদর্শন ইতোমধ্যে প্রকাশ পেয়েছে বলে অনেক স্কলার বলছেন। ইসলামবিষয়ক ওয়েবসাইট দি ইসলামিক ইনফরমেশনের তথ্যানুযায়ী এখানে তেমই ১০টি নিদর্শন তুলে ধরা হলো।
১) আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, আমার পরে পৃথিবীতে সর্বপ্রথম ইরাকে ফিতনা সৃষ্টি হবে। নবীজি (স.)-এর এ ভবিষ্যদ্বাণী আজ সত্যে পরিণত হয়েছে।
২) নবীজি (স.) বলেছেন, তাবুকের যে স্থানটিতে কূপ রয়েছে, সেটি কেয়ামতের আগে ফুলে-ফলে ভরে উঠবে। আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি, তাবুকের ওই স্থানটি রীতিমতো বাগানে পরিণত হয়েছে।
৩) হাদিসের ভাষ্যমতে, লোকেরা এত পরিমাণ সম্পদশালী হয়ে উঠবে যে, কেউই জাকাত গ্রহণ করতে চাইবে না। আজ এর সত্যতা আমাদের কাছে স্পষ্ট।
৪) বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, তীব্র ঠাণ্ডা ও দাবদাহসহ ব্যাপক হারে দেখা দেবে; এতে করে মাঠঘাট ফসলহীন হয়ে পড়বে। আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসলের উৎপাদন কী পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
আরও পড়ুন: দুর্যোগের ক্ষতি এড়াতে নবীজির আমল
৫) আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, মানুষের মধ্য থেকে যখন আমানতদারিতা উঠে যাবে, তখন তোমরা কেয়ামতের অপেক্ষায় থাকো। এর অর্থ হলো— সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী থেকে আমানতদারিতা দূর হয়ে যাবে। আর বর্তমানে ধোঁকাবাজি, প্রতারণা, অযোগ্য ব্যক্তির ক্ষমতা ও চুরি-চামারি এত পরিমাণ বেড়ে গেছে যে, পৃথিবীতে আমানতদারিতা নেই বললেই চলে।
৬) একটা সময় আসবে যখন পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপ্রধানগণ বলতেই পারবে না যে, ইরাক আসলে কোথায় আছে। (এখানে ভৌগলিকভাবে ইরাকের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়াকে বোঝানো হয়নি। বরং এখানে বোঝানো হয়েছে, একটা সময় আসবে যখন অমানবিক জুলুম-নির্যাতনের স্বীকার হয়ে ইরাকের অধিবাসীরা পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেবে (যার প্রমাণ আমাদের কাছে স্পষ্ট। আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি, ইরাকের অধিবাসীরা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অন্যান্য দেশে রিফিউজি হিসেবে বসবাস করছে), ফলে ইরাক কার্যত জনশূন্য হয়ে পড়বে। অথচ বিশ্ব মোড়লরা ইরাকের ওপর করা এই আক্রমণ ও জুলুম-নির্যাতনের ব্যাপারে একেবারে চুপ থাকবে; কেমন যেনো তারা জানেই না বা বেমালুম ভুলে গেছে যে, ইরাক নামে আদৌ কোনো ভূখণ্ড ছিল অথবা আছে।)
৭) চতুর্দিক থেকে ইসলামের ওপর এত পরিমাণ হামলা আসবে, যেভাবে নেকড়ের দল শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
৮) লোকেরা ব্যাপকভাবে ব্যভিচারে লিপ্ত হবে; তবে তারা স্বীকার করবে, এটি একটি গর্হিত কাজ।
৯) লোকেরা কাজকর্মে হালাল-হারামের তোয়াক্কা করবে না। সুদের চর্চা সমাজে অধিক পরিমাণে ব্যাপৃত হবে।
১০) লোকেরা ষাঁড়ের লেজের ন্যায় এক ধরনের চাবুক (লাঠি) ব্যবহার করবে; এবং তা দ্বারা একে অপরকে প্রহার করবে।
উল্লেখিত আলামতগুলো ছাড়াও ইসলামিক স্কলারদের মতে কেয়ামতের আরও অনেক আলামত যেমন- আকস্মিক মৃত্যু, মাদক-গান-বাজনার বৃদ্ধি, মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যে লড়াই, ধর্মীয় জ্ঞান ধীরে ধীর উঠে যাওয়া, সময়ের বরকত উঠে যাওয়া, অন্যায় হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন আলামত ইতোমধ্যে প্রকাশ পেয়েছে।
কেয়ামত কবে হবে?
কেয়ামত বা কিয়ামত কবে হবে—তা একমাত্র আল্লাহ তাআলাই জানেন। হাদিসে এসেছে, হজরত জিব্রাঈল (আ.) একদা ছদ্মবেশে মহানবী (স.)-এর কাছে হাজির হয়ে আরজ করেন, কেয়ামত কখন অনুষ্ঠিত হবে? মহানবী (স.) বলেন, জিজ্ঞাসিত ব্যক্তি থেকে জিজ্ঞাসাকারী অধিক জ্ঞাত নয়। অর্থাৎ কেয়ামত কখন অনুষ্ঠিত হবে, তা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানেন না। আল্লাহ ইরশাদ করেন, কেয়ামতের জ্ঞান কেবল তাঁরই জানা। তাঁর জ্ঞানের বাইরে কোনো ফল আবরণমুক্ত হয় না এবং কোনো নারী সন্তান প্রসব ও গর্ভধারণ করে না। (সুরা হা-মিম-সাজদা: ৪৭)
অপর আয়াতে বলা হয়েছে, তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করে, কেয়ামত কখন হবে? আপনি বলে দিন, এর খবর তো আপনার পালনকর্তার কাছেই রয়েছে। নির্ধারিত সময়ে তিনি তা পরিষ্কারভাবে দেখাবেন (সুরা আরাফ: ১৮৭)
মহানবী (স.) বলেন, গুপ্ত জ্ঞানের বিষয় পাঁচটি—১. কেয়ামত। তা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানেন না। ২. আগামী দিন কী ঘটবে আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। ৩. কখন বৃষ্টি হবে, তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। ৪. কার কোথায় মৃত্যু হবে, আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। ৫. কখন কেয়ামত হবে, আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। (সহিহ বুখারি)
কেয়ামত যেহেতু অত্যাসন্ন, তাই প্রত্যেকেরই উচিত সর্বদা সৎকর্ম সম্পাদন করার মাধ্যমে কেয়ামতের প্রস্তুতি গ্রহণ করা। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফিক দান করুন। আমিন।