কেয়ামত কবে হবে- এ সম্পর্কে আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। মহানবী (স.)-কেও কেয়ামতের সময় সম্পর্কে জানানো হয়নি। আল্লাহ বলেন, ‘কেয়ামতের জ্ঞান কেবল আল্লাহর কাছে আছে।’ (সুরা লোকমান: ৩৪)
তবে, হাদিসের ভাষ্যমতে ছোট-বড় আলামতগুলো প্রকাশ পাবে কেয়ামতের আগে। বড় আলামত প্রকাশের আগে ছোট ছোট অনেক আলামত প্রকাশ পাবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘..কেয়ামতের আগে ধর্মীয় জ্ঞান উঠে যাবে, ভূমিকম্প বেড়ে যাবে, সময়ের বরকত উঠে যাবে, ফেতনা-ফাসাদ চরম আকার ধারণ করবে, আর অন্যায় হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাবে এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ বেড়ে যাবে।’ (বুখারি: ১০৩৬)
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: অনর্থক হত্যা কেয়ামতের আলামত, নিহত ব্যক্তিও জাহান্নামি!
কেয়ামতের আগে সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘যখন লোকেরা আল্লাহর সম্পদকে (যুদ্ধলব্ধ মাল) নিজের সম্পত্তি মনে করবে, আমানতকে নিজ সম্পদ বলে গণ্য করবে, জাকাত দেওয়াকে অত্যন্ত ভারি বোধ করবে, ধর্মীয় জ্ঞান ছাড়া অন্য জ্ঞান শিখবে, পুরুষরা নারীদের তাঁবেদারি করবে, সন্তান নিজ মায়ের নাফরমানি করবে, বন্ধুবান্ধবকে ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বলে ধারণা করবে, আর নিজ পিতাকে দূরবর্তী লোক বলে বুঝবে, মসজিদে উচ্চৈঃস্বরে দুনিয়াবি কথাবার্তা হবে, পাপী লোক সমাজের সর্দার হবে, নিকৃষ্ট প্রকৃতির লোক সমাজের প্রাধান্য ও কার্যভারপ্রাপ্ত হবে, জালিমকে তার জুলুমের ভয়ে মানুষ সম্মান করবে, গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্র প্রচুর পরিমাণে বিস্তার লাভ করবে, মদপান বেড়ে যাবে, পরবর্তী লোকেরা পূর্বপুরুষদের মন্দ বলবে, তখন তোমরা এমন বিপদের অপেক্ষা করতে থাকবে যে লালবর্ণের প্রচণ্ড বায়ু বা ভূমিকম্প হবে। জমিন দেবে যাবে। লিঙ্গের রূপান্তর হবে। আসমান থেকে পাথর বর্ষণ হবে। আরো অনেক আপদ-বিপদ তাড়াতাড়ি এমনভাবে উপর্যুপরি আসতে থাকবে, যেভাবে মণিমুক্তার মালা ছিঁড়ে গেলে দানাগুলো ধারাবাহিক খসে পড়তে থাকে।’ (তিরমিজি: ২২১০; বুখারি : ৮১)
কেয়ামতের আগে আমানতের খেয়ানত হবে বেশি। হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, ‘যখন আমানতদারিতা উঠে যাবে, তখন তোমরা কেয়ামত সংঘটিত হওয়ার অপেক্ষা করো। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, আমানতদারি কিভাবে উঠে যাবে? রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, আমানতদারি উঠে যাওয়ার একটি উদাহরণ হচ্ছে, যে ব্যক্তি যে দায়িত্ব পালনের যোগ্য নয়, তাকে সে দায়িত্ব দেওয়া হবে।’ (বুখারি: ৬৪৯৬)
বিজ্ঞাপন
‘সন্তানদের মধ্যে মা-বাবার অবাধ্যতা ব্যাপকভাবে দেখা দেবে। সন্তান তার মায়ের সঙ্গে এমন অবমাননাকর ও অসম্মানজনক আচরণ করবে, যা একজন মনিব তার দাসীর সঙ্গে করে থাকে।’ (বুখারি: ৫০)
মুসলমানরা বিধর্মীদের মাধ্যমে অতিরিক্ত জুলুম নির্যাতনের শিকার হবে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, খাদ্য গ্রহণকারীরা যেভাবে খাবারের পাত্রের চতুর্দিকে একত্র হয়, অচিরেই বিজাতিরা তোমাদের বিরুদ্ধে সেভাবেই একত্র হবে। এক ব্যক্তি বললেন, সেদিন আমাদের সংখ্যা কম হওয়ার কারণে কি এরূপ হবে? তিনি বললেন, তোমরা বরং সেদিন সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে; কিন্তু তোমরা হবে প্লাবনের স্রোতে ভেসে যাওয়া আবর্জনার মতো। আর আল্লাহ তোমাদের শত্রুদের অন্তর থেকে তোমাদের আতঙ্ক দূর করে দিবেন, তিনি তোমাদের অন্তরে ভীরুতা ভরে দিবেন। এক ব্যক্তি বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! ‘আল-ওয়াহান’ কী? তিনি বললেন, দুনিয়ার মোহ এবং মৃত্যুকে অপছন্দ করা। (আবু দাউদ: ৪২৯৭)
মুসলমানরা পরস্পরের মধ্যে লড়াইয়ে লিপ্ত হবে। নিজেদের মধ্যে এমন বিবাদে জড়ানোকে নবীজি (স.) ফেতনা বলে আখ্যায়িত করেছেন। আহনাফ ইবনে কায়স (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি (সিফফিনের যুদ্ধে) এক ব্যক্তিকে (আলী রা.)-কে সাহায্য করতে যাচ্ছিলাম। আবু বাকরাহ্ (রা.)-এর সঙ্গে আমার দেখা হলে তিনি বললেন, ‘তুমি কোথায় যাচ্ছ?’ আমি বললাম, ‘আমি এ ব্যক্তিকে সাহায্য করতে যাচ্ছি। ’ তিনি বললেন, ‘ফিরে যাও। কারণ আমি আল্লাহর রাসুল (সা.) কে বলতে শুনেছি- দুজন মুসলমান তাদের তরবারি নিয়ে মুখোমুখি হলে হত্যাকারী এবং নিহত ব্যক্তি উভয়ে জাহান্নামে যাবে।’ আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল! এ হত্যাকারী (তো অপরাধী), কিন্তু নিহত ব্যক্তির কী অপরাধ? তিনি বললেন, (নিশ্চয়ই) সেও তার সাথিকে হত্যা করার জন্য উদগ্রীব ছিল।’ (বুখারি: ৩১)
আরও পড়ুন: ঘরে ঘরে পাপের উপকরণ নিয়ে নবীজির ভবিষ্যদ্বাণী
কেয়ামতের আগে প্রযুক্তিগত দিক থেকে মানুষ অনেক দূর এগিয়ে যাবে। বড় বড় দালানকোঠা তৈরির প্রতিযোগিতা হবে, পাহাড় কেটে সুড়ঙ্গ পথ নির্মাণ করা হবে। যা বর্তমানে আমরা খুব স্বাভাবিক বিষয় হিসেবেই দেখছি। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেন, যখন মক্কা শরিফের টিলার উদর বিদীর্ণ করা হবে আর নির্মিত ভবনগুলো মক্কা শহরের পাহাড়গুলোর চেয়ে উঁচু হবে তখন মনে কর ফেতনার সময় সন্নিকটে। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা: ৭/৪৬১)
এমন কঠিন পরিস্থিতিতে কারো কারো জন্য দীনের ওপর অটল-অবিচল থাকা কঠিন হয়ে উঠবে। হাদিসের ভাষায়, ‘..যখন দীনের ওপর অবিচল থাকা হাতের মধ্যে জ্বলন্ত অঙ্গার রাখার মতো কঠিন হবে।’ (তিরমিজি: ২২৬০)
আকস্মিক মৃত্যু কেয়ামতের আলামতগুলোর একটি। বর্তমানে হঠাৎ মৃত্যু স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নবী (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘কেয়ামতের অন্যতম আলামত হচ্ছে হঠাৎ মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।’ (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ: ৭/৩২৫)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে পাকাপোক্ত ঈমান ও নেক আমলের সঙ্গে কঠিন সময় অতিবাহিত করার এবং ঈমান নিয়ে মৃত্যুর তাওফিক দান করুন। আমিন।

