শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

যেমন কেটেছিল নবীজির যৌবন

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৬:১১ পিএম

শেয়ার করুন:

যেমন কেটেছিল নবীজির যৌবন

প্রবীণদের মতো বোধশক্তিসম্পন্ন হিসেবে কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে প্রবেশ করেন মুহাম্মদ (স.)। যে সমাজে প্রতিটি মজলিশ ছিল কলুষিত সেই সমাজে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। পুরো সমাজে অপসংস্কৃতির সয়লাব, অথচ তিনি এর ধারে কাছেও নেই। আল্লাহ তাআলা তাঁর হাবিবের শ্রেষ্ঠ চারিত্রিক গুণাবলী অক্ষুণ্ণ রেখেছেন পুরো জীবনজুড়ে। এজন্যই পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী।’ (সুরা কলম: ০৪) এর অর্থ হলো, এমন শিষ্টাচার, ভদ্রতা, নম্রতা, দয়া-দাক্ষিণ্য, বিশ্বস্ততা, সততা, সহিষ্ণুতা এবং দানশীলতাসহ অন্য যাবতীয় চারিত্রিক ও নৈতিক গুণাবলি যার অধিকারী তিনি নবুয়তের আগেও ছিলেন। নবুয়তের পর তা আরো উন্নত হয় ও সৌন্দর্য-সমৃদ্ধ হয়। 

খাদিজা (রা.)-এর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী কর্মকর্তা
৫৯১ খ্রিস্টাব্দ। বিশ্বনবীর বয়স তখন ২০। কিশোর থেকে যৌবনে পদার্পণ করছেন মুহাম্মদ (স.)। চাচা আবু তালিবের পরামর্শে মক্কার ধনবতী নারী খাদিজা (রা.)-এর ব্যবসায় নিযুক্ত হলেন। ব্যবসায় নিযুক্ত হয়ে তিনি খাদিজার প্রতিনিধি হয়ে সিরিয়া গমন করেন। ‘ইসলামী বিশ্বকোষ’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে, খাদিজা (রা.)-এর প্রতিনিধি হিসেবে ব্যবসা উপলক্ষে তিনি ইয়েমেনও গিয়েছিলেন। (ইসলামী বিশ্বকোষ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৯৩-২৯৪)।


বিজ্ঞাপন


সিরিয়া যাত্রাকালে মুহাম্মদ (স.) একটি গির্জার পাশে অবস্থিত গাছের নিচে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। গির্জার ধর্মযাজক এ দৃশ্য দেখে মন্তব্য করেন, ‘এই গাছের নিচে নবী ছাড়া আর কেউ কখনো বিশ্রাম নেননি’ (সিরাতে ইবনে হিশাম, পৃষ্ঠা-১৭৭) ইতিহাসবিদরা বলেন, পাঁচ শ বছর আগে ঈসা (আ.) একবার এ পথে যাত্রাকালে এই গাছের নিচে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। সে কথা স্মরণে রেখেই পাদ্রি উপরোক্ত মন্তব্য করেন। 

মুহাম্মদ (স.) তাঁর ২৩ বছর বয়স পর্যন্ত খাদিজা (রা.)-এর ব্যবসার নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে বিশ্বস্ততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। মুহাম্মদ (স.)-এর তত্ত্বাবধানে খাদিজা (রা.)-এর ব্যবসার দ্রুত প্রসার ও শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। আরবের আনাচে-কানাচে তাঁর সততা ও সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা, আমানতদারিতা ও কর্মদক্ষ হিসেবে সুখ্যাতির সুবাস ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বস্ত ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে তিনি ঘোষণা করেন, ‘সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ী কেয়ামতের দিন নবী, সত্যবাদী ও শহীদদের সঙ্গে থাকবে।’ (তিরমিজি: ১২০৯; দারিমি: ২৫৩৯)

হিলফুল ফুজুল
তৎকালীন আরবে কারণে-অকারণে গোত্র থেকে গোত্রে বছরের পর বছর নানা রকম লড়াই ও যুদ্ধ চলতেই থাকত। একটি যুদ্ধ মুহাম্মদ (স.) তাঁর চাচা জুবায়ের ইবনে মুত্তালিবের সঙ্গে থেকে প্রত্যক্ষ করেন। ভ্রাতৃঘাতী এই যুদ্ধের মধ্যে বিভিন্ন গোত্রপ্রধানদের নিয়ে একটি সভা হয়। এতে মুহাম্মদ (স.)-এর অনুপ্রেরণায় হিলফ-আল-ফুজুল নামক একটি সংগঠনের জন্ম হয়। এই প্রথমবারের মতো হিজাজে গোত্রানুগত্যের গণ্ডি অতিক্রম করে ন্যায়ানুগত্যের সংকল্পে আন্তঃগোত্রীয় একটি সংঘ স্থাপিত হলো। হিলফ-আল-ফুজুলের সদস্যরা শপথ করলেন, তাঁরা দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা, অত্যাচারীর প্রতিরোধ, বিদেশিদের জান-মাল রক্ষা এবং অসহায়দের সাহায্য করবেন। এভাবে অক্ষরজ্ঞানহীন এক যুবক (মুহাম্মদ স.) কৈশোরে মক্কার জনপদে, সন্নিহিত পাহাড়-উপত্যকা-প্রান্তরের উন্মুক্ত চারণভূমিতে, যুদ্ধক্ষেত্রে এবং দেশ-বিদেশের বাজারে চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের কারণে গ্রহণযোগ্যতা তুলে ধরতে সমর্থ হন। অথচ তখনও তিনি নবী হননি।

দাসপ্রথাবিরোধী অভিযানের শুরু
মহানবী (স.) মানবজাতির মুক্তির জন্য পরবর্তী সময়ে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে ইসলামের যেসব সনদ উপস্থাপন করেছিলেন, তা ছিল সব মানুষের জন্য সাম্য প্রতিষ্ঠা লাভ। সবাই সবার ভাই, কেউ কারো প্রভু নয়। নবুয়তপ্রাপ্তির আগ থেকেই মহান আল্লাহ তাঁর অন্তরে এই চেতনা ঢেলে দিয়েছিলেন। এর একটি প্রমাণ দেখা যায় জায়েদ (রা.)-এর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ককে কেন্দ্র করে। বিবাহের পর খাদিজা (রা.) জায়েদ বিন হারিসা নামক তাঁর ক্রীতদাসকে নবীজির সেবায় নিয়োজিত করেন। প্রথমবারের মতো মুহাম্মদ (স.) ক্রীতদাসের মালিক হলেন। আরবের দাসপ্রথা তাঁর হৃদয়কে আগেই ভারাক্রান্ত করে রেখেছিল। তিনি জায়েদকে মুক্ত করে দিলেন। পরে যখন জায়েদ তাঁর পিতার সঙ্গে স্বগৃহে ফিরতে অসম্মত হলেন, তখন তাঁর দাসত্বজনিত গ্লানি মুছে দেওয়ার জন্য মুহাম্মদ (স.) কাবায় সমবেত ব্যক্তিদের সম্বোধন করে বলেন, উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ! তোমরা সাক্ষী থাকো যে, জায়েদ এখন থেকে আমার পুত্র; সে আমার উত্তরাধিকারী হবে, আমি তার উত্তরাধিকার পাবো। পরবর্তী সময়ে জায়েদ এবং তাঁর পুত্র উসামা (রা.) মুসলিম ইতিহাসে বহু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। (ইসলামী বিশ্বকোষ, পৃষ্ঠা: ২৯৪-২৯৫)


বিজ্ঞাপন


পৌত্তলিকতাবিরোধী মন
প্রথম থেকেই মুহাম্মদ (স.) পৌত্তলিকতাবিরোধী মনোভাবের ছিলেন। মুসনাদে আহমদের বর্ণনামতে, খাদিজা (রা.)-এর এক প্রতিবেশিনী এক রাতে মুহাম্মদ (স.)-কে বলতে শুনেছিলেন, হে খাদিজা, আল্লাহর কসম, আমি কখনো লাত আর উজ্জার পূজা করব না, আল্লাহর কসম, কখনোই তাদের অর্চনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তখন খাদিজা (রা.) বলেন, দূর হোক লাত আর উজ্জা। লাত ও উজ্জা ছিল আরবদের দুটি প্রতিমা, যাদের অর্চনা করে তারা ঘুমাতে যেত। আরবের সেই ঘোর পৌত্তলিকতার যুগেও ‘হানিফ’ নামে খ্যাত কিছু লোক ছিলেন, যাঁরা এক আল্লাহর বিশ্বাসমূলক লুপ্তপ্রায় ‘মিল্লাতে ইবরাহিম’-এর অনুসারী ছিলেন এবং মূর্তিপূজার বিরোধিতা করতেন। মুহাম্মদ (স.)-এর পূর্বপুরুষরা বেশির ভাগ এই মতাবলম্বী ছিলেন।

ইসলামের দাওয়াতের আগে আরবে কাবাঘরের পুনর্নির্মাণের পর কুরাইশ গোত্র তাদের কৌলীন্য এবং পৌরহিত্যের মর্যাদা বৃদ্ধির পরিকল্পনায় একটি নতুন নিয়ম চালু করল যে হজের সময় অন্যদের মতো তারা ‘আরাফাত’-এ যাবে না। রাসুল (স.) এই নিয়ম লঙ্ঘন করে আরাফাত প্রান্তরে যান এবং কৌলীন্যগত প্রাধান্যের এমন দাবির সক্রিয় বিরোধিতা প্রকাশ করেন। এই বিরোধিতা ছিল মুহাম্মদ (স.)-এর একটি সাহসী পদক্ষেপ।

পরবর্তীকালে পবিত্র কোরআনের সুরা বাকারার ১৯৮-১৯৯ আয়াতে নবী (স.)-এর এই প্রতিবাদের সমর্থন করা হয়। জীবনে তিনি কোনোদিন প্রতিমা পূজা যেমন করেননি, তেমনি কোনো দেব-দেবীর প্রসাদ ভক্ষণ করেননি। একবার কুরাইশ পৌত্তলিকরা তাদের কোনো দেবীর নামে বলি দেওয়া পশুর গোশত তাঁকে খেতে দিয়েছিল। মুহাম্মদ (স.) প্রত্যাখ্যান করেন এবং তা খেতে অস্বীকার করেন। এভাবে নবুয়তের আগেই পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধাচরণ করে একটি বিশেষ অবস্থানে তিনি নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন।

অদৃশ্যের আওয়াজ শ্রবণ ও পাথরের সালাম প্রদান
নবুয়তের সময় ঘনিয়ে এলে তিনি অদৃশ্যের আওয়াজ শুনতে পেতেন। গাছ, তরুলতা ও পাথর তাঁকে সালাম প্রদান করত। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘আমি মক্কার একটি পাথরকে চিনি, যেটি নবুয়ত লাভের আগেই আমাকে সালাম করত। আমি এখনো সেটিকে চিনতে পারি।’ (সহিহ মুসলিম: ২২৭৭)

অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজের প্রতিকূলে গিয়ে মহান প্রভুর জন্য সেরাটি করেছেন যুবক মুহাম্মদ (স.)। কুসংস্কার আর অপসংস্কৃতির প্রভাবে গা ভাসিয়ে দেননি; মহান আল্লাহও তাঁর হাবিবকে হেফাজত করেছেন। আর তাঁর আদর্শ পর্যালোচনার পরে আমরা যারা তরুণ, যুবক রয়েছি তাদের জন্য এটাই সুযোগ যে, তাঁর পবিত্র সিরাতমুখী হওয়া। জীবনাদর্শের জ্বলজ্বলে প্রদীপকে মনে-প্রাণে গ্রহণ করা, আঁকড়ে ধরা। যেই প্রদীপ দেখিয়ে দেবে জান্নাতের রাস্তা। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে নবীজির পবিত্র জীবনী থেকে অনুপ্রেরণা ও শিক্ষা নেওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর