সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ঘুমানোর আগে জিকির

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৯ নভেম্বর ২০২২, ০৩:৩১ পিএম

শেয়ার করুন:

ঘুমানোর আগে জিকির

জিকির ইবাদতের প্রাণ। জিকির শব্দের অর্থ স্মরণ করা, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। অর্থাৎ নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে সবসময় আল্লাহকে স্মরণ করা, তাঁর আনুগত্য করা। জিকির এমন ইবাদত যার কোনো সময়, সীমা, পরিমাণ ও শর্ত নেই। আল্লাহর জিকির দিনে-রাতে, অজু অবস্থায়, অজু ছাড়া, সকাল-সন্ধ্যায়, দাঁড়িয়ে, বসে, এমনকি শুয়েও করা যায়।

আল্লাহ তাআলা বান্দাদের সর্বাবস্থায় অধিক হারে তাঁর জিকির করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা আল্লাহকে বেশি পরিমাণে স্মরণ করো এবং সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করো।’ (সুরা আহজাব: ৪১-৪২)


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন: আল্লাহর প্রশংসায় গোটা সৃষ্টিজগত, তাসবিহ দিয়ে শুরু ৭ সুরা 

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং চিন্তা-গবেষণা করে আসমান ও জমিন সৃষ্টি বিষয়ে (তারা বলে) হে আমাদের রব! এসব আপনি অনর্থক সৃষ্টি করেননি।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৯১)

ঘুমানোর আগে জিকির করা বিশেষ ফজিলতপূর্ণ আমল। রাতে যেকোনো নফল ইবাদতের গুরুত্ব বেশি। তাহাজ্জুদের মতো মহান ইবাদতও রাতে সীমাবদ্ধ। এজন্যই পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই রাতে জাগরণ ইবাদতের জন্য গভীর মনোনিবেশ, হৃদয়ঙ্গম এবং স্পষ্ট উচ্চারণে অনুকূল।’ (সুরা মুজ্জাম্মিল: ৬)

আরও পড়ুন: তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম কানুন


বিজ্ঞাপন


আল্লাহর জিকিরের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম জিকির হলো পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করা। রাতে আমল করার মতো কোরআন তেলাওয়াতসহ কিছু ফজিলতপূর্ণ জিকিরের বর্ণনা এসেছে সহিহ হাদিসে। এমন কিছু জিকির নিচে তুলে ধরা হলো—

১) সুরা বাকারার শেষ দুই আয়াত তেলাওয়াত
বদরি সাহাবি আবু মাসউদ আনসারি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, যে ব্যক্তি রাতে সুরা বাকারার শেষ দুই আয়াত তেলাওয়াত করে, তবে তা তার জন্য যথেষ্ট হবে। (সহিহ বুখারি: ৫০৪০)
‘তার জন্য যথেষ্ট হবে’ বাক্যটির ব্যাখ্যায় একদল আলেম বলেন, এই দুই আয়াত তাহাজ্জুদের বিপরীতে যথেষ্ট হবে। অন্যরা বলেন, আয়াতদ্বয় রাতের বেলা শয়তান, জিন ও মানুষের ক্ষতি থেকে রক্ষায় যথেষ্ট হবে। (শরহুন নববি: ৬/৯১)

২) সুরা মুলক তেলাওয়াত
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, কোরআনে ৩০ আয়াতবিশিষ্ট একটি সুরা আছে। যে সুরাটি কারো পক্ষে সুপারিশ করলে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়। সুরাটি হলো—তাবারাকাল্লাজি বিয়াদিহিল মুলক..(অর্থাৎ সুরা মুলক)। (সুনানে তিরমিজি: ২৮৯১)
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, যে ব্যক্তি প্রতি রাতে তাবারাকাল্লাজি পাঠ করবে আল্লাহ তার বিনিময়ে তাকে কবরের শাস্তি থেকে রক্ষা করবেন। আমরা রাসুলুল্লাহ (স.)-এর যুগে এই সুরাকে ‘মানিআ’ (প্রতিহতকারী বা রক্ষাকারী) বলতাম। (সুনানে নাসায়ি: ১০৫৪৭)

আরও পড়ুন: কঠিন সময়ের বন্ধু 'সুরা মুলক'

৩) সাইয়িদুল ইস্তেগফার পাঠ
শাদ্দাদ ইবনুল আউস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি দিনে (সকালে) দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে এই ইস্তেগফার পড়বে আর সন্ধ্যা হওয়ার আগেই মারা যাবে, সে ব্যক্তি জান্নাতি হবে। আর যে ব্যক্তি রাতে (প্রথম ভাগে) দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে এই দোয়া পড়ে নেবে আর ভোর হওয়ার আগে মারা যাবে, সে জান্নাতি হবে। আর সাইয়িদুল ইস্তেগফার হলো বান্দার এই দোয়া পড়া— اَللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّىْ لآ إِلهَ إلاَّ أَنْتَ خَلَقْتَنِىْ وَأَنَا عَبْدُكَ وَأَنَا عَلى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ، أَعُوْذُبِكَ مِنْ شَرِّمَا صَنَعْتُ، أبُوْءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَىَّ وَأَبُوْءُ بِذَنْبِىْ فَاغْفِرْلِىْ، فَإِنَّهُ لاَيَغْفِرُ الذُّنُوْبَ إِلاَّ أَنْتَ ‘আল্লা-হুম্মা আনতা রাব্বি লা ইলা-হা ইল্লা আনতা খালাকতানি, ওয়া আনা আবদুকা ওয়া আনা আলা আহদিকা ওয়া ওয়াদিকা মাসতাতাতু, আউজুবিকা মিন শাররি মা সানাতু। আবুউ লাকা বিনিমাতিকা আলাইয়া ওয়া আবুউ বিজাম্বি ফাগফিরলি ফাইন্নাহু লা ইয়াগফিরুজ জুনুবা ইল্লা আনতা।’

অর্থ: হে আল্লাহ! তুমি আমার প্রতিপালক। তুমিই আমাকে সৃষ্টি করেছ। আমি তোমারই গোলাম। আমি যথাসাধ্য তোমার সঙ্গে কৃত প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকারের ওপর আছি। আমি আমার সব কৃতকর্মের কুফল থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি। তুমি আমার প্রতি তোমার যে নেয়ামত দিয়েছ তা স্বীকার করছি। আর আমার কৃত গুনাহের কথাও স্বীকার করছি। তুমি আমাকে ক্ষমা করো। (সহিহ বুখারি: ৬৩০৬)

৪) আয়াতুল কুরসি পাঠ
প্রিয়নবী (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি শোয়ার সময় আয়াতুল কুরসি পড়বে, শয়তান সারারাত তার কাছে আসবে না।’ (বুখারি: ২৩১১)

আরও পড়ুন: নিয়মিত আয়াতুল কুরসি পড়ার পুরস্কার

৫) তিন ক্বুল পড়ে ফুঁ দেওয়া
দুই হাতের তালু একত্রে মিলিয়ে সুরা ইখলাস, সুরা ফালাক ও সুরা নাস পড়ে তাতে ফুঁ দেবে। তারপর দুই হাতের তালুর মাধ্যমে দেহের যতোটা অংশ সম্ভব— মাসেহ করবে। মাসেহ শুরু করবে— মাথা, মুখমণ্ডল ও দেহের সামনের দিক থেকে (এভাবে ৩ বার করবে)। (বুখারি: ৫০১৭)

৬) আলাদাভাবে সুরা ইখলাস পাঠ
একবার রাসুল (স.) সাহাবিদের বললেন, ‘তোমাদের কেউ কি এক রাতে এক তৃতীয়াংশ কোরআন পড়তে অসমর্থ হবে?’ এতে সকলকে বিষয়টি ভারী মনে করল। বলল, এই কাজ আমাদের মধ্যে কে পারবে হে আল্লাহর রাসুল! তখন তিনি বললেন, ‘সুরা ইখলাস হলো- এক-তৃতীয়াংশ কোরআন।’ (বুখারি: ৫০১৫)

আরও পড়ুন: ১০ বার সুরা ইখলাস পড়ার পুরস্কার

৭) সুরা কাফিরুন পাঠ
প্রিয়নবী (স.) বলেছেন, ‘রাতে (কুল ইয়া আইয়্যু হাল কা-ফিরুন) (অর্থাৎ সুরা কা-ফিরুন) পাঠ করা শিরক থেকে মুক্তি পেতে উপকারী।’ (সহিহ তারগিব: ৬০২)

৮) তাসবিহ পাঠ
রাসুল (স.) তাঁর মেয়ে ফাতেমা (রা.) ও জামাতা আলী (রা.)- কে বলেন, ‘আমি কি তোমাদের এমন কিছু বলে দেবো না—যা তোমাদের জন্য খাদেম অপেক্ষাও উত্তম হবে? যখন তোমরা তোমাদের বিছানায় যাবে, তখন তোমরা ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবার বলবে; তা খাদেম অপেক্ষাও তোমাদের জন্য উত্তম হবে।’ (বুখারি: ৩৭০৫)

৯) ঘুমানোর দোয়া পাঠ
রাসুলুল্লাহ (স.) যখন ঘুমানোর ইচ্ছা করতেন, তখন তাঁর ডান হাত গালের নীচে রাখতেন, তারপর এ দোয়াটি বলতেন—ﺍﻟﻠَّﻬُﻢَّ ﺑِﺎﺳْﻤِﻚَ ﺃَﻣُﻮﺕُ ﻭَﺃَﺣْﻴَﺎ ‘আল্লাহুম্মা বিসমিকা আমু-তু ওয়া আহইয়া’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আপনার নাম নিয়েই আমি মরছি (ঘুমাচ্ছি) এবং আপনার নাম নিয়েই জীবিত (জাগ্রত) হব।’ (বুখারি: ৬৩২৪)

আরও পড়ুন: মানসিক চাপে ঘুম না আসলে যে দোয়া পড়বেন

মহানবী (স.) জিকির থেকে গাফেল ব্যক্তিদের জীবিত থাকতেও মৃত বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জিকির করে এবং যে আল্লাহর জিকির করে না তাদের দৃষ্টান্ত হলো জীবিত ও মৃতদের মতো।’ (বুখারি: ৬৪০৭, মুসলিম: ৭৭৯)। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি আমার বান্দার ধারণা মোতাবেক হই এবং আমি তার সঙ্গে থাকি যখন সে আমার জিকির করে। যদি সে তার মনে মনে আমার জিকির করে আমি তাকে আমার কুদরতি মনে জিকির করি। আর যদি সে আমাকে মজলিসে গণজমায়েতে জিকির করে তাহলে আমি তাকে তাদের চেয়ে উত্তম মজলিসে স্মরণ করি। (বুখারি: ৭৪০৫, মুসলিম: ২৬৭৫)

অতএব আল্লাহর সন্তুষ্টি পেতে হলে সর্বদা জিকির করা মুমিন মুসলমানের জন্য বাঞ্ছনীয়। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে উপরোক্ত আমলগুলো প্রতিরাতে করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর