প্রিয়নবী (স.) উম্মতকে ফজিলতপূর্ণ অনেক আমল শিক্ষা দিয়েছেন। এর মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল হলো—ফরজ নামাজের পর নিয়মিত আয়াতুল কুরসি পড়া। সুরা বাকারার ২৫৫ নম্বর আয়াতটিকে আয়াতুল কুরসি বলা হয়। প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর আয়াতটি পাঠ করা সুন্নত। প্রসিদ্ধ এই আয়াতে আল্লাহর একত্ববাদ, মর্যাদা ও গুণের বর্ণনা থাকার কারণে আল্লাহ তাআলা এ আয়াতের মধ্যে অনেক ফজিলত রেখেছেন।
হজরত আবু উমামা (রা.) করেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর আয়াতুল কুরসি পাঠ করবে, তার জান্নাতে প্রবেশের পথে মৃত্যু ছাড়া আর কোনও অন্তরায় থাকবে না।’ (শুআবুল ঈমান: ২৩৯৫; নাসায়ি: ৯৪৪৮, তাবারানি: ৭৮৩২)
আরও পড়ুন: জান্নাতের সুখ শান্তি
আয়াতুল কুরসি পবিত্র কোরআনের সবচেয়ে সম্মানিত আয়াত। উবাই বিন কাব (রা.) বর্ণনা করেন, একদিন রাসুল (স.) আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আবুল মুনজির, তুমি কি জানো, কোরআনের কোন আয়াত সবচেয়ে সম্মানিত?’ আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই সবচেয়ে ভালো জানেন। রাসুল (স.) আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আবুল মুনজির, তুমি কি জানো, কোরআনের কোন আয়াত সবচেয়ে সম্মানিত?’ আমি বললাম, ‘আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লাহ হুয়াল..’ অর্থাৎ আয়াতুল কুরসি। রাসুলুল্লাহ (স.) আমার বুকে হাত দিয়ে বললেন, হে আবুল মুনজির! তোমাকে উত্তম জ্ঞানের জন্য শুভেচ্ছা।’ অন্য বর্ণনা এসেছে, তিনি বলেন, ‘সেই সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার প্রাণ, এ সুরার একটি জিহ্বা ও দুটো ঠোঁট আছে, যা দিয়ে সে আরশের অধিপতির পবিত্রতা বর্ণনা করে।’ (সহিহ মুসলিম: ৮১০)
সাহাবির হাতে শয়তান বন্দি ও মুক্তির ঘটনা
আয়াতুল কুরসি সম্পর্কে একটি সুন্দর ঘটনা সহিহ বুখারিতে বর্ণিত হয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক রমজান মাসে রাসুল (স.) আমাকে জাকাতের সম্পদ পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তখন দেখতে পেলাম এক আগন্তুক সদকার মাল চুরি করছে। তখন আমি তার হাত ধরে ফেললাম এবং বললাম- আল্লাহর কসম, আমি তোমাকে আল্লাহর রাসুলের কাছে নিয়ে যাব। তখন আগন্তুক বলল, আমি খুব অভাবী আর আমার অনেক প্রয়োজন। তার এ কথা শুনে দয়া করে তাকে ছেড়ে দিলাম।
বিজ্ঞাপন
পরদিন সকালে রাসুল (স.) আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, গতকাল তোমার অপরাধী কী করেছে? আমি উত্তর দিলাম, হে আল্লাহর রাসুল, লোকটি নাকি অনেক অভাবী তাই তাকে দয়া করে ছেড়ে দিয়েছি। রাসুল (স.) বললেন, অবশ্যই সে তোমাকে মিথ্যা বলেছে আর সে আবার আসবে। পরদিন আমি আবার অপেক্ষা করতে লাগলাম। যখন সে আবারও চুরি করতে আসল, তখন তাকে পাকড়াও করে বললাম, এবার অবশ্যই আমি তোমাকে আল্লাহর রাসুলের কাছে নিয়ে যাব। সে বলল, আমাকে ছেড়ে দাও, আমি খুব অভাবী, আমার পরিবার আছে, আমি আর আসব না। আমি তাকে দয়া করে এবারও ছেড়ে দিলাম।
পরদিন আবারও রাসুল (স.) আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, গতকাল তোমার অপরাধী কী করেছে? আমি এবারও উত্তর দিলাম, হে আল্লাহর রাসুল, লোকটি নাকি অনেক অভাবী— তাই তাকে দয়া করে ছেড়ে দিয়েছি। রাসুল (স.) এবারও বললেন, অবশ্যই সে তোমাকে মিথ্যা বলেছে, আর সে আবার আসবে। তৃতীয় দিনও আমি চোরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। যখন সে আবারও চুরি করতে আসল, তখন তাকে পাকড়াও করে বললাম, এবার অবশ্যই আমি তোমাকে আল্লাহর রাসুলের কাছে নিয়ে যাব, তুমি বার বার প্রতিশ্রুতি করেও চুরি করতে এসে থাকো। তখন (অবস্থা বেগতিক দেখে) সে বলল, আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি তোমাকে এমন কিছু কথা জানাবো— যার মাধ্যমে আল্লাহ তোমাকে কল্যাণ দান করবেন। আমি বললাম, সেগুলো কী? তখন সে বলল, যখন ঘুমাতে যাবে তখন আয়াতুল কুরসি পড়ে ঘুমাবে তাহলে আল্লাহ তোমার জন্য একজন পাহারাদার নিযুক্ত করবেন, যিনি তোমার সঙ্গে থাকবেন। আর কোনো শয়তান সকাল পর্যন্ত তোমার কাছে আসতে পারবে না। এটা শুনে আবু হুরায়রা (রা.) তাকে ছেড়ে দিলেন।
আরও পড়ুন: ইবলিস কোন শয়তানের ধোঁকায় পড়ে আদমকে সেজদা করেনি?
পরদিন রাসুল (স.) আবার অপরাধীর কথা জানতে চাইলে তিনি আগের রাতের কথা বললেন। তখন রাসুল (স.) বললেন, যদিও সে চরম মিথ্যাবাদী কিন্তু সে সত্য বলেছে। রাসুল (স.) আবু হুরায়রা (রা.)-কে আরও বললেন, তুমি কি জান সে কে? আবু হুরায়রা (রা.) বললেন, না। রাসুল (স.) আবু হুরায়রাকে বললেন, সে ছিল শয়তান। (সহিহ বুখারি: ২৩১১)
উচ্চারণ ও অর্থসহ আয়াতুল কুরসি
اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ ۚ لَا تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ ۚ لَّهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ ۗ مَن ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِندَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ ۚ يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ ۖ وَلَا يُحِيطُونَ بِشَيْءٍ مِّنْ عِلْمِهِ إِلَّا بِمَا شَاءَ ۚ وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ ۖ وَلَا يَئُودُهُ حِفْظُهُمَا ۚ وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ ‘আল্লাহু লা ইলা-হা ইল্লা হুওয়াল হাইয়্যুল কাইয়ুম, লা তা’খুজুহু সিনাতুঁও ওয়ালা নাউম। লাহু মা-ফিসসামা-ওয়া-তি ওয়ামা ফিল আরদ্ব। মান জাল্লাজি ইয়াশফা’উ ইনদাহু ইল্লা বিইজনিহি। ইয়া’লামু মা বাইনা আইদিহিম ওয়ামা খালফাহুম। ওয়ালা ইয়ুহিতুনা বিশাইইম মিন্ ইলমিহি ইল্লা বিমা- শাআ। ওয়াসি‘আ কুরসিয়্যুহুস সামা-ওয়াতি ওয়াল আরদ্ব। ওয়ালা ইয়াউদুহু হিফজুহুমা ওয়া হুয়াল আলিয়্যূল আজিম।’
অর্থ: ‘আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য নেই, তিনি চিরঞ্জীব, সবকিছুর ধারক। তাঁকে তন্দ্রা ও নিদ্রা স্পর্শ করতে পারে না। আসমান ও জমিনে যা কিছু রয়েছে, সবই তাঁর। কে আছ, যে সুপারিশ করবে তাঁর কাছে তাঁর অনুমতি ছাড়া? দৃষ্টির সামনে কিংবা পেছনে যা কিছু রয়েছে, সে সবই তিনি জানেন। তাঁর জ্ঞানসীমা থেকে তারা কোনো কিছুকেই পরিবেষ্টিত করতে পারে না, কিন্তু যতটুকু তিনি ইচ্ছা করেন। তাঁর কুরসি সমস্ত আসমান ও জমিনকে পরিবেষ্টিত করে আছে। আর সেগুলোকে ধারণ করা তাঁর পক্ষে কঠিন নয়। তিনিই সর্বোচ্চ এবং সর্বাপেক্ষা মহান।’
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর নিয়মিত আয়াতুল কুরসি পাঠ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।