সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

উম্মে আয়মন: নবীজিকে আমৃত্যু মায়ের মমতা দিয়েছেন যিনি

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৪ অক্টোবর ২০২২, ০২:১৬ পিএম

শেয়ার করুন:

উম্মে আয়মন: নবীজিকে আমৃত্যু মায়ের মমতা দিয়েছেন যিনি

ইসলামের ইতিহাসে এক মহীয়সী নারীর নাম উম্মে আয়মন (রা.)। যিনি নবীজিকে আমৃত্যু মায়ের স্নেহ-মমতা ও আদর-সোহাগ দিয়ে দেখাশোনা করেছিলেন। তাঁর জন্ম আফ্রিকার আবিসিনিয়ায়। প্রিয়নবী (স.)-এর জন্মের ৫০ দিন আগে কাবাঘর ধ্বংসের জন্য যখন আবরাহার বাহিনী অভিযান চালায়, সেই কাফেলার সঙ্গে আসেন এই বালিকা। 

প্রাচীন ইতিহাসবিদদের মধ্যে ইবনে সাদ তাঁর শিক্ষক ইমাম ওয়াকিদি (রহ.) থেকে বর্ণনা করেছেন, ‘আবদুল্লাহ বিন আবদুল মুত্তালিব উম্মে আয়মন নামে এক দাসী, পাঁচটি উট ও এক পাল বকরি রেখে গেছেন। রাসুলুল্লাহ (স.) উত্তরাধিকার সূত্রে এগুলো পেয়েছেন।’ (ইবনে সাদ, আত-তাবকাতুল কুবরা, বৈরুত, ১৯৫৭, প্রথম সংস্করণ, পৃষ্ঠা-১০০)


বিজ্ঞাপন


আবরাহা বাহিনী ধ্বংস হওয়ার পরের ঘটনা। আমাদের নবী (স.)-এর বাবা আব্দুল্লাহ একদিন মক্কার বাজারে গিয়েছিলেন কেনাকাটা করার জন্য। এক জায়গায় তিনি দেখলেন, এক লোক কিছু দাস-দাসী নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বিক্রি করছে। আব্দুল্লাহ দেখলেন, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি ছোট্ট ৯ বছরের কালো আফ্রিকান মেয়ে । মেয়েটিকে দেখে আব্দুল্লাহর অনেক মায়া হলো, একটু রুগ্ন, হালকা পাতলা; কিন্তু কেমন মায়াবী ও অসহায় দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। তিনি ভাবলেন ঘরে আমেনা একা থাকেন, মেয়েটা পাশে থাকলে তার একজন সঙ্গী হবে। এই ভেবে তিনি মেয়েটিকে কিনে নিলেন। আব্দুল্লাহ ও আমেনা তাকে অনেক ভালোবাসতেন, স্নেহ করতেন। তারা লক্ষ্য করলেন যে, তাদের সংসারে মেয়েটি আসার পর বেশি রহমত ও বরকত চলে এসেছে। এই কারণে আব্দুল্লাহ ও আমেনা আদর করে তার নাম দিলেন বারাকা। মানে সৌভাগ্য, প্রাচুর্য, বরকত।

একদিন আব্দুল্লাহ ব্যবসায়িক কাজে সিরিয়া রওনা দিলেন। বিবি আমেনার সঙ্গে সেটাই ছিল তার শেষ বিদায় । তার যাত্রার দুই-একদিন পর আমেনা একরাতে স্বপ্নে দেখলেন, আকাশের ঝলমল উজ্জ্বল এক তারা যেন তার কোলে এসে পড়লো। পরদিন ভোরে তিনি বারাকাকে এই স্বপ্নের কথা বললেন। উত্তরে বারাকা মৃদু হেসে বললেন, আমার মন বলছে, আপনার কোল বেয়ে এক সুন্দর শিশু জন্ম নেবে। আমেনা তখনও জানতেন না তিনি গর্ভধারণ করেছেন; কিন্তু কিছুদিন পর তিনি বুঝতে পারলেন, বারাকার ধারণাই সত্য।

আব্দুল্লাহ আর ফিরে আসেননি। সিরিয়া যাওয়ার পথেই মদিনায় মৃত্যুবরণ করেন। আমেনার সেই বিরহ ও কষ্টের সময়ে বারাকা ছিলেন সবচেয়ে কাছের ও একমাত্র সঙ্গী। একসময় আমেনার অপেক্ষা শেষ হয় এবং তিনি জন্ম দিলেন আমাদের প্রিয়নবী (স.)-কে। শেখ ওমর সুলাইমানের বর্ণনা অনুযায়ী, সর্বপ্রথম আমাদের নবীকে দেখার ও স্পর্শ করার সৌভাগ্য হয়েছিল যে মানুষটির, সে হলো এই আফ্রিকান ক্রীতদাসী ছোট্ট কালো মেয়েটির। আমাদের নবীকে নিজ হাতে আমেনার কোলে তুলে দিয়েছিলেন, আনন্দে ও খুশিতে বলেছিলেন, আমি কল্পনায় ভেবেছিলাম সে হবে চাঁদের মতো; কিন্তু এখন দেখছি, সে যে চাঁদের চেয়েও সুন্দর।

নবীজির জন্মের সময় বারাকার বয়স ছিল তের বছর। ছোটবেলায় বারাকা আমেনার সঙ্গে শিশু নবীর যত্ন নিয়েছেন, গোসল দিয়েছেন, খাওয়াতে সাহায্য করেছেন, আদর করে ঘুম পাড়িয়েছেন ও কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন। নবীজি (স.)-এর বয়স যখন ৬ বছর তখন আমেনা শিশু মুহাম্মদকে নিয়ে তার বাপের বাড়ি মদিনা মনোয়ারা থেকে ফেরার পথে আবওয়া নামক স্থানে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় আমেনা বারাকার হাত ধরে অনুরোধ করেছিলেন, তিনি যেন তার সন্তানকে দেখেশুনে রাখেন এবং সুদূর আবওয়া থেকে মক্কায় নিয়ে আবদুল মুত্তালিবের হাতে তুলে দেন। উম্মে আয়মন সেই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আবওয়াতে মা আমেনার মাজার রয়েছে।


বিজ্ঞাপন


বাবা-মা দু’জনকেই হারিয়ে ইয়াতিম নবী চলে এলেন দাদা আবদুল মুত্তালিবের ঘরে। উত্তরাধিকার সূত্রে নবী (স.) হয়ে গেলেন বারাকার নতুন মনিব। কিন্তু তিনি একদিন বারাকাকে মুক্ত করে দিলেন। বললেন, আপনি যেখানে ইচ্ছে চলে যেতে পারেন, আপনি স্বাধীন। শিশুকাল থেকেই নবী (স.) এই ক্রীতদাস প্রথাকে দূর করতে চেয়েছিলেন ।

বারাকা নবীকে ছেড়ে কোথাও যেতে রাজি হলেন না; বরং মায়ের ছায়া হয়ে পাশে থেকে গেলেন। এমনকি নবীজির দাদা তাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু তিনি কিছুতেই রাজি হলেন না। তার সাফ কথা, আমি আমেনাকে কথা দিয়েছি, আমি কোথাও যাব না। তারপর একদিন খাদিজা (রা.)-এর সঙ্গে নবীজির বিয়ে হলো। বিয়ের দিন রাসুল (স.) খাদিজা (রা.)-এর সঙ্গে বারাকাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, তিনি হলেন আমার মায়ের পর আরেক মা।

বিয়ের পর রাসুল (স.) একদিন বারাকাকে ডেকে বললেন, উম্মি! আমাকে দেখাশোনা করার জন্য এখন খাদিজা আছে, আপনাকে এখন বিয়ে করতেই হবে। নবীজি তাকে উম্মি ডাকতেন, নাম ধরে ডাকতেন না।

তারপর রাসুল (স.) ও খাদিজা মিলে তাকে উবাইদ ইবনে জায়েদের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলেন। কিছুদিন পর বারাকার নিজের একটা ছেলে হলো, নাম আয়মন। এরপর থেকে বারাকার নতুন নাম হয়ে গেল উম্মে আয়মন।

একদিন বারাকার স্বামী উবাইদ মৃত্যুবরণ করেন। নবীজি গিয়ে আয়মন ও বারাকাকে সঙ্গে করে নিজের বাড়ি নিয়ে আসেন এবং সেখানেই থাকতে দিলেন। কিছুদিন যাওয়ার পর নবীজি একদিন বেশ কয়েকজন সাহাবিকে ডেকে বললেন, আমি একজন নারীকে জানি, যার কোনো সম্পদ নেই, বয়স্ক এবং সঙ্গে একটা এতিম সন্তান আছে। কিন্তু তিনি জান্নাতি, তোমাদের মধ্যে কেউ কি একজন জান্নাতি নারীকে বিয়ে করতে চাও? এই কথা শুনে জায়েদ ইবনে হারিসা (রা.) নবীজির কাছে এসে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। নবীজি উম্মে আয়মনের সঙ্গে কথা বলে বিয়ের আয়োজন করলেন। বিয়ের দিন রাসুল (স.) জায়েদকে বুকে জড়িয়ে আনন্দে ও ভালোবাসায়, ভেজা চোখে, কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, তুমি কাকে বিয়ে করেছ জানো জায়েদ? হ্যাঁ, উম্মে আয়মনকে- জায়েদের উত্তর। নবীজি (স.) বললেন, না, তুমি বিয়ে করেছ, আমার মাকে। তার কোলেই জন্মগ্রহণ করেন হজরত উসামা ইবনে জায়েদ।

সাহাবিরা বলতেন- রাসুল (স.)-কে খাওয়া নিয়ে কখনও জোর করা যেত না। তিনি সেটা পছন্দ করতেন না। কিন্তু উম্মে আয়মান একমাত্র নারী, যিনি রাসুল (স.)-কে খাবার দিয়ে খাও... খাও... বলে তাড়া দিতেন। আর খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত পাশে বসে থাকতেন । নবীজি মৃদু হেসে, চুপচাপ খেয়ে নিতেন।

রাসুল (স.) তাঁর দুধ মাতা হালিমাকে দেখলে যেমন করে নিজের গায়ের চাদর খুলে বিছিয়ে তার ওপর হালিমাকে বসতে দিতেন; ঠিক তেমনি মদিনায় হিজরতের পর দীর্ঘ যাত্রাশেষে উম্মে আয়মন যখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন, নবীজি তাঁর গায়ের চাদরের একটা অংশ পানিতে ভিজিয়ে, উম্মে আয়মনের মুখের ঘাম ও ধুলোবালি নিজ হাতে মুছে দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, উম্মি! জান্নাতে আপনার এরকম কোনো কষ্ট হবে না।

নবীজি (স.) ইন্তেকালের আগে সাহাবিদের অনেক কিছুই বলে গিয়েছিলেন। সেসব কথার মধ্যে একটা ছিল, উম্মে আয়মনের কথা। বলেছেন, তোমরা উম্মে আয়মনের যত্ন নেবে, তিনি আমার মায়ের মতো ও তিনিই একমাত্র নারী, যিনি আমাকে জন্ম থেকে শেষ পর্যন্ত দেখেছেন। আমার পরিবারের একমাত্র সদস্য, যিনি সারাজীবন আমার পাশে ছিলেন। সাহাবিরা সেই কথা রেখেছিলেন। গায়ের রং নয়, এক সময়ের কোনো ক্রীতদাসী নয়, তার পরিচয় তিনি প্রিয়নবীর (স.) আরেক মা। মায়ের মতোই রাসুলুল্লাহর সাহাবারা এই বৃদ্ধা নারীকে ভালোবেসে আগলে রেখেছিলেন।

উম্মে আয়মন (রা) উহুদ যুদ্ধে সৈনিকদের পানি পান ও আহতদের সেবাশুশ্রূষায় নিযুক্ত ছিলেন। মুসলিম বাহিনীর লোকেরা যখন পলায়ন করছিলেন, তিনি অস্থির হয়ে পলায়নকারীদের মুখে মাটি নিক্ষেপ করতে থাকেন, যাচ্ছ কোথায়, ধরো ঢাল তলোয়ার নাও, রাসুলের চারপাশ থেকে শত্রুদের হটাও। তারপর রাসুলের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে তিনি শান্ত হন।

হিবান ইবনে আরাকার নিক্ষিপ্ত তিরে তার সতর অনাবৃত হলে সে আনন্দে অট্টহাসি দিতে থাকে। এতে রাসুল (স.) দারুণ কষ্ট পান এবং হজরত সাদ বিন আবু ওয়াক্কাসকে ধারবিহীন একটা তির নিক্ষেপ করতে বলেন, তিরের প্রচণ্ড আঘাত চিৎপটাং অবস্থায় সে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে পড়লে রাসুল (স.) এমন অট্টহাসি দেন, যাতে তাঁর মাড়ির দাঁতগুলো স্পষ্ট দেখা যায়। নবীজি (স.) বলেন, সাদ বিন আবু ওয়াক্কাস উম্মে আয়মন (রা.) এর পক্ষে প্রতিশোধ গ্রহণ করল।

এছাড়া তিনি খায়বার ও হুনাইন যুদ্ধসহ অনেক যুদ্ধে অংশ নেন। হুনাইন যুদ্ধে তিনি ও তাঁর ছেলে আয়মন মুসলমানদের বিপর্যয়ের সময় রাসুলুল্লাহ (স.)-এর পাহারায় ছিলেন। আয়মন এ যুদ্ধে শহীদ হন এবং মুতার যুদ্ধে উম্মে আয়মনের দ্বিতীয় স্বামী মহান সেনাপতি হজরত জায়েদ বিন হারিসা শহীদ হন। তিনি সব ক্ষেত্রে ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন; কিন্তু নবীজি (স.)-এর ইন্তেকালে তিনি খেই হারিয়ে ফেলেন। হজরত আবু বকর ও ওমর (রা) তাকে দেখতে এলে তিনি অঝোর ধারায় কান্না করছিলেন। এত কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, নবীজি (স.) ইন্তেকালের সঙ্গে সঙ্গে ওহি নাজিলের সিলসিলা যে বন্ধ হয়ে গেল। তার এ কথায় হজরত আবু বকর ও ওমর (রা.) উভয়ে অঝোর ধারায় কেঁদেছিলেন।

উম্মে আয়মন হজরত উসমান (রা.)-এর খেলাফতকালে ইন্তেকাল করেন। জান্নাতুল বাকিতে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর জানাজায় হজরত উসমান (রা.) ইমামতি করেন।

(সূত্র: সিরাতে ইবনে হিশাম ও শেখ ওমর সুলাইমান)

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর